
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী ও সমর্থনকারী সকলের শ্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। পাক হানাদারদের গুলিতে প্রাণ হারানোর মুহূর্তেও উচ্চারণ করতো জয় বাংলা। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ,কমিউনিস্ট পার্টি,ন্যাপসহ সকল দলেরই তখন শ্লোগান ছিল জয় বাংলা। কে স্বাধীনতার পক্ষে আর কে স্বাধীনতার বিপক্ষে তা যাচাই হতো জয় বাংলা বলা অথবা না বলাকে কেন্দ্র করেই।
কোনো জনস্রোতে জয় বাংলা উচ্চারিত হলেই পাকবাহিনী তাদের উপর গুলি চালাতো। জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে ইজ্জত হারিয়েছে অনেক বাঙালী নারীরা। দেশ স্বাধীন হলো আর জয় বাংলা বিভক্ত হলো। স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মানা না মানা নিয়ে বিভক্তি তৈরি হলো। সকল দল তাকে জাতির পিতা মানতে চাইলো না। স্বাধীনতার পক্ষের দাবিদার হয়েও স্বাধীনতার স্থপতিকে জাতির পিতা মানছে না অনেক সংগঠন। জয় বাংলাও বলছে না তারা। কেন বলছে না?
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির দাবীদার হয়েও এখনও অনেক সংগঠন পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে জিন্দাবাদ বলে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ও তার দল হতে নিজেদের ভিন্নতা দৃশ্যমান করানোর জন্য জিয়ার দল বিএনপি বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলতে শুরু করে। তারও অনেক আগে হতেই বামপন্থীরা ইনকিলাব জিন্দাবাদের আদলে জিন্দাবাদ বলে যাচ্ছে। জিয়া এক্ষেত্রে কাকে অনুসরণ করল বামদের না পাকিস্তানকে? জিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সুতরাং পাকিস্তানকে অনুসরণ করেছেন, তা কীভাবে বলি? তবে কি বামদের অনুসরণ করেছেন? সেটাও বলা যেতে পারে, কারণ অনেক বামনেতা জিয়ার দলে যোগ দিয়েছিল।এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে জিয়া বামদের অনুসরণ করেছিল অথবা বামেরা জিয়ার জিন্দাবাদ শ্লোগানের দিকে ছুটে গিয়েছিল।বলা যায় জিন্দাবাদের ঐক্যেই গড়ে ওঠে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট। সে ফ্রন্টে যোগ দেয় বাম, ডান মিলিয়ে সকল জিন্দাবাদ পন্থীরা। সমমনা না হলে যে কোনো জোট হয় না এটা সত্য নয় কি?

স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে জয় বাংলা বলে। পরবর্তীতে দেখা গেছে দল পাল্টে তারা শ্লোগানও পাল্টে দিয়েছে। কেন তারা দল পাল্টানোর সাথে সাথেও জয় বাংলা পাল্টে নিলো?দলীয় চেতনায় একটি কার্যকর শ্লোগান থাকতে পারে দেশীয় চেতনায় কেন নয়?একটা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকবে এটাই বাস্তব। কিন্তু দেশীয় চেতনা থাকবে না এটা কি অবাস্তব হওয়া কাম্য নয়?
বাংলাদেশে অনেক সক্রিয় জোট দেখা গেছে যেমন,৭ দল,৮ দল,৫ দল, ১৫ দল,২২ দল, ১৪ দল,২০ দল,৩১ দল,৫৮ দল প্রভৃতি। এসব জোটে দেখা যায় ঐক্যচিন্তায় একক প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে। নির্বাচনে জেতার জন্য তারা জোটগতভাবে একক প্রতীক নিয়েছে। বিসর্জন দিয়েছে নিজেদের দলীয় প্রতীক। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, সিপিবি তাদের কাস্তে হাতুড়ি প্রতীক বাদ দিয়ে নির্বাচন করেছে নৌকা মার্কা নিয়ে, জামায়াত-বিজেপি নির্বাচন করেছে ধানের শীষ নিয়ে, জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি নৌকা নিয়ে।
নির্বাচনী চেতনায় যদি একটি একক প্রতীকের দিকে ছুটতে পারে দেশীয় চেতনায় তারা কেন একটি একক শ্লোগানের দিকে ছুটতে পারছে না? নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে জিতে অনেকেই সংসদ সদস্য হয়েছেন কিন্তু তারা জয় বাংলা বলেনি। আওয়ামী লীগও জয় বাংলা না বলা লোককে কিভাবে তাদের দলীয় প্রতীক নৌকা দিয়ে দিল? প্রতীক দেয়ার আগে কি এটার ফায়সালা করা উচিত ছিল না? জয় বাংলা বলে নির্বাচনী প্রচারে যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আবার তাদের প্রার্থী জয় বাংলা বলে না এ দৃশ্যটা কি বেমানান নয়?
বিভিন্ন মত পথের রাজনীতি থাকতে পারে সেটা থাকুক কিন্তু একটি জাতীয় শ্লোগানতো থাকবে। তাই নয় কি? আওয়ামী লীগ কেন জয় বাংলাকে জাতীয় শ্লোগান হতে দলীয় শ্লোগানে রূপান্তরিত করল? আর অন্যান্য দলগুলোও কেন জাতীয় শ্লোগানকে এড়িয়ে চলতে লাগল? নৌকা মার্কা নেয়া যায় অথবা দেয়া যায় কিন্তু জয় বাংলা কেন নেয়া যায় না কিংবা দেয়া যায় না?
যে ধ্বনি দিয়ে লাখো বাঙালী জীবন দিয়েছে। সম্ভ্রম দিতে হয়েছিল নারীদের। যার মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে জাতিসত্তার পরিচয়।সেই জয় বাংলাকে কেন তার মর্যাদা ফিরে পেতে হলো হাইকোর্টের রায়ে? কিন্তু এ রায়ের কি কোনো প্রতিফলন আছে বাংলাদেশে? সব দল কি গ্রহণ করেছে জয় বাংলাকে? নাকি এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে তারা? আপিলও করবে না রায়ও মানবে না এ নিঃস্পৃহতা খুবই উদ্বেগের। জয় বাংলা বলা দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেও শ্লোগানটিকে জাতীয় শ্লোগানে রূপান্তরিত করতে পারলো না এটা ব্যর্থতা নয় কি?এবার হাইকোর্টের রায় ব্যর্থ হোক জাতি তা চায় না। যারা জয়বাংলা বলতে চাইবে না তারা আইনের দ্বারস্থ হতে পারে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে। যারা আপিল করবে না আবার জয় বাংলাও বলবে না তাদের এই উদাসীনতাকে কি বলা যায়? সেটা কি আইনী রায় মান্যতার প্রতি চরম উদাসীনতা নয়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)