রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কর্মজীবী নারী সাহিদা সুলতানার ঘুম ভাঙে কে কী নাস্তা খাবে, দুপুরের খাবারে কে কী নেবে তা ভাবতে ভাবতে? তারপর অফিসের জন্য তৈরি হতে হতে ঠিক করতে হয় দুপুরের খাবারের কী ব্যবস্থা করতে হবে? কার কী পছন্দের মেনু?
সেগুলো ভেবেই অফিসে যাওয়ার আগে কাজের মেয়েকে ঠিকঠাক নির্দেশনা দিতে হয়। নাস্তার টেবিলে বসে আর খেতে খেতে চিন্তা আরেক রকম। যদি অফিস থেকে আসতে দেরি হয়? সময় মতো বিকেলের নাস্তাটা বড় ছোটদের কী হবে সেটাও কাজের মেয়েকে বলে দিতে হয়।
শুধু কি তাই, এরপর সাহিদা অফিসের মিটিং বা কাজের ফাঁকে খোঁজ নিয়ে নেয় বাসায় সব কিছু ঠিকমত চলছে কি না! ঘরে অসুস্থ শাশুড়ি ঠিক মতো ঔষুধ খেল কি না? যদি কোন সমস্যা হয় ফোনে যাবতীয় যোগাযোগ করে তাও তাকে মিটাতে হয়।
সাহিদার রোজনামচায় এর পরির্বতন কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না, পরিবর্তনের সুযোগ কোথায়? এসব কাজ কি সবাইকে দিয়ে সম্ভব?
সাহিদা বলছিলেন, কোথায় পাবো নির্ভরযোগ্য একজন? কারণ, কেউ সাংসারিক শত ঝামেলা মাথায় নিতে চায় না, এমনকি আংশিকভাবেও না।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, সন্তানের লেখাপড়া খোঁজ, ব্যাংকে টাকা তোলা, বিল জমা, সন্তানের বেতন, সময় পেলে স্কুলে নেওয়া আসা সঙ্গে তো সন্তান ও ঘরের সবার নিরাপদ খাদ্যের যোগান দেয়া থেকে শুরু করে সবই সামলাতে হয়। রোজগেরে পেশাজীবি নারী হলেও এর থেকে দায়মুক্ত হওয়া যায় না।
সাহিদার মতো হাজারো কর্মজীবী নারীরা শুধু ঘরে-বাইরে সমানতালে সামলাচ্ছেন তা না, তারা নিজের শখ আহ্লাদ, পছন্দ অপছন্দ পরিবারের ভালোর জন্য ত্যাগ করছেন মমতার জায়গা থেকে।
কিন্তু কর্মজীবী নারীর এই কাজের বোঝা শহর বা গ্রামের মেয়েদের ক্ষেত্রে বলাবাহুল্য আরো বেশী। কোন রকম মূল্যায়ন ছাড়া তারা দিনে রাতে মাস, বছর, জীবন কাটিয়ে দেন পরিবারের সবার কল্যাণে।
টাঙ্গাইলের গোপালপুরের গৃহিণী পারভীন সিদ্দিকী দিনের শুরুটাই হয় মেয়ে স্কুলে কী খাবার নিয়ে যাবে? নাস্তা তৈরি করে মেয়েকে স্কুলে রেখে টুকটাক বাজার করে বাসায় এসে দুপুরের খাবারে মন দেন। কোনো রকমে এসব তৈরি করে স্কুল থেকে মেয়ে আনতে চলে যান, মেয়ের স্কুলের লেখাপড়া বিষয়গুলো দেখা ছাড়াও যৌথ পরিবারে সংসার করায় সবার খোঁজ রাখতেই দিন চলে যায়।
এসব গৃহস্থালি সেবামূলক কাজে প্রতিদিন যতটুকু সময় খরচ করেন তার আর্থিক মূল্য হওয়া উচিত এটা ভাবতে পারেন না। তিনি বেশ রূঢ় কণ্ঠে বললেন, আর্থিক মূল্যের জন্য তো সংসারসহ সন্তানের লালন পালন করছি না, দায়িত্ববোধ আর ভালোবাসার টানে এটা করি। সবাই করে। এর কখনোই কোনো মূল্য হয় না, সেটা অমূল্য।
তবে তিনিও সাহিদার সাথে একমত, সাংসারিক কাজের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। সেইসাথে পরিবারের অন্য সদস্যদের বিশেষ করে পুরুষ সদস্যদের অংশগ্রহণ জরুরি।
গৃহস্থালির সেবামূলক কাজের মূল্য নিরূপণের প্রশ্নে উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সব নারীরাই বলেছেন, ঘরের কাজের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক নেই। আছে আবেগ, দায়িত্ববোধ আর ভালোবাসা, যার কোনো মূল্য হয় না।
তবে তাদের স্বীকৃতির বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীদের গৃহস্থালির কাজকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এ কাজ শুধু নারীর একার নয় সেটা নিয়েও প্রচারণা চালাতে হবে এবং নারীর গৃহস্থালির কাজে পুরুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
চলতি বছরের ১৬ মে নারী-পুরুষদের নিয়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তৈরি পরিসংখ্যান-বিষয়ক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে পুরুষদের তুলনায় সাড়ে তিন গুণ বেশি মজুরিবিহীন কাজ করেন এ দেশের নারীরা।
একজন নারী এক সপ্তাহে গড়ে ২৪ ঘণ্টা গৃহস্থালির কাজ করেন, কিন্তু কোনো মজুরি পান না। সেই হিসাবে দিনে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা মজুরিবিহীন কাজ করেন তিনি।এসব কাজের মধ্যে আছে রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া, বাজার-সদাই করা, বাচ্চাদের আদর-যত্ন, স্কুলে আনা-নেওয়া ইত্যাদি। অন্যদিকে একজন পুরুষ সপ্তাহে এমন কাজ করেন মাত্র সাত ঘণ্টা। দিনে করেন গড়ে এক ঘণ্টা।
বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী গত ২০১৭ সাল শেষে সারা দেশে ৭২ লাখ নারী-পুরুষ মজুরিবিহীন কাজ করতেন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫৪ লাখ। আর ১৮ লাখ পুরুষ এমন কাজ করেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, নারীর গৃহকর্মের স্বীকৃতি জরুরি, সেটা জিডিপিতে স্যাটেলাইট কাউনন্টিংয়ে নিয়ে আসেন সেটাও ভালো কিন্তু বাড়ির বাইরে নারীর গতিশীলতা,নিজের বলয়ের বাইরে গিয়ে কাজ করে কাজে সফলতা অনেক জরুরি।
কিন্তু তারপরেও বড় মাপের সুযোগগুলো নারীর গতিশীলতা বাড়া, অ্যাকসেস টু মার্কেট বাড়ানো এবং গ্রেইনফুল ইমপ্লয়মেন্টের (অর্জিত সফলতা) মাধ্যমে নিজের সম্পৃক্ত করা।
মোট কথা নারীদের কাজকে অর্থনীতির মূলধারায় আনতে হবে, তাই নারীর জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি যাতায়াত, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো সুবিধা তৈরি করতে হবে।
সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের এক গবেষণায় এসেছে নারী কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ, যারা গত এক দশকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে মজুরি বৈষম্যও কমিয়ে এনেছে উল্লেখযোগ্যহারে।
রাজধানীর নিম্নবিত্ত কর্মজীবী নারী শাহনাজ বেগম মেস বাসায় দু’বেলা বা তিনবেলায় রান্না করলে মাসে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পায়। ফ্যামিলি বাসায় সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন কাজ করলে, তারা ঘণ্টা হিসেবে ৫০০ টাকা দেয়, কেউ আবার একটু বেশিও দেয়।
নারীর গৃহস্থালির কাজ একটি সেবাখাত হিসেবে আসা দরকার জানিয়ে চ্যানেল আইয়ের বার্তা প্রধান, কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ বলেন, নারীর গৃহস্থালির কাজের মূল্য নিরূপণ জরুরি, যদি সেটা করা হয় তাহলে এখান থেকে বিশাল একটি টাকা সে পাবে এবং সারা দেশব্যাপী এটাকে যদি ধরা হয় তাহলে জিডিপিতে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।
‘নারীদের এই শ্রমটার আর্থিক বিনিময় নেই বলে জিডিপিতে হিসাব করা হচ্ছে না। অথচ এই নারীই যদি আবার গ্রামে কৃষিকাজ করে বা তার গৃহস্থালিতে একটা বাগান করে, তা থেকে সে যে ফসলটা হয়, তার বিনিময়ে যে অঙ্কটা আসছে তা কিন্তু জিডিপিতে সংযুক্ত হচ্ছে।’
নারীদের গৃহস্থালি কাজে স্বীকৃতি প্রয়োজন উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, যদি মূল্য নিরূপণ করতে হয় তবে যারা কর্মজীবী গৃহিণী তাদের জন্য একটা টোকেন মানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, এটা এক ধরনের স্বীকৃতি হতে পারে।
যারা পুরোপুরি গৃহিণী আছে তাদের একটা ভালো অঙ্কের টাকা দেওয়া যেতে পারে আর একটু নীচের দিকে যারা দুঃস্থ ও গরিব তাদের টাকার অঙ্কটা বড় হতে পারে।
নারীর গৃহস্থালির কাজে মূল্য নিরূপণের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সহকারী অধ্যাপক নাসিমা পারভীন বলেন, সরকার আমাদের যে স্কেল দেয়, সে স্কেলে আলাদা একটা স্কেল নির্ধারণ করা হোক। সেটা পঞ্চম গ্রেড হতে পারে, নবম গ্রেড হতে পারে কিংবা এগারোতম গ্রেড এভাবে দেওয়া যেতে পারে।
কর্মজীবি নারীরা অফিসে আট ঘণ্টা কাজ করলেও গৃহিণী হিসাবে তাকেও অন্য গৃহিণীদের মত ঘরে সব সময়ই কাজের মধ্যে থাকতে হয়।
গৃহস্থালির কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে মধুপুরের ইন্দুলপুর পাহাড়ের নারী জরিনা বেগম বলেন, সকালে ঘুম থেকে উঠেই রান্না ঘরের চুলা জ্বালানোর জন্য বেশ দূর থেকেই লাকড়ি বয়ে আনতে হয়, পুকুর থেকে রান্না ও থালা বাসন ধোয়ার জন্য পানি আনতে হয়। কোন রকমের রান্না বসিয়ে দিয়ে হাঁস মুরগী ও গরুর খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। মাঝে মাঝে গবাদি পশুর খাবারও সংগ্রহ করতে হয়। অসুস্থ শশুড় শাশুড়ির সেবা যত্নটাও দেখা লাগে।
টাঙ্গাইল সদরের গৃহিণী সুর্বণা আলম বলেন, সারাদিনে ঘরের এমন কোনো কাজ নেই যে করি না এরসঙ্গে যোগ হয় যদি সংসারে বয়োজোষ্ট থাকে, তাদের সেবা শুশ্রুষা করতে হয়, সব মিলিয়ে অনেক সময় নিজের খাওয়াটাও ঠিকমতো হয় না।
এছাড়াও যদি আপনার সংসার যৌথ হয় তাহলে তো কথাই নেই, শ্বশুর শাশুড়ি থেকে শুরু করে আত্মিয় স্বজন সবার ঠিক মতো খোঁজ খবর রেখে নিজের সংসার গোছাতে হয়।
নারীর গৃহস্থালির কাজগুলো টেকনোলজি বেইজ যদি করায় জোর দেন জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ইডেন মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা হক।
তিনি বলেন, নারীদের পরিশ্রম যদি কমানো যায় এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে যদি কাজটা করা যায় তাহলে শেয়ারিংটা বাড়ে। গৃহস্থালির কাজ শুধু নারীর নয়, ছেলে মেয়ে স্বামী সকলেই কাজটা সবাই মিলে করবে। নারীকে এককভাবে গৃহস্থালি কাজ থেকে মুক্ত করে দিলেই তার ক্ষমতায়ন ঘটবে।
ফাহমিদা হকের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, গৃহস্থালি কাজের চাপ কমানোর জন্য যত বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, তত বেশি নারীদের অবস্থার পরিবর্তন হবে। নারীদের সেবামূলক কাজের আর্থিক মূল্য অনেক, কিন্তু এর কোনো স্বীকৃতি তারা পান না।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সবাইকে একসেঙ্গ কাজ করতে হবে। নারীদের উন্নয়নে আমাদের মন্ত্রণালয় সর্বক্ষণ কাজ করছে। তাদের দারিদ্র্য বিমোচনে বিভিন্ন ধরনের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে।