আজ এখানে তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে ৩১ বছর আগের কথা মনে হচ্ছে। সেদিনও এরকম একটা শীতের দিন ছিল। দুপুর পেরিয়ে বিষন্ন এক বিকেল। আমরা ৬০/৬২ জন ছেলে অন্যদিনের মতোই স্কুলের বেঞ্চগুলোতে বসেছিলাম। কিন্তু, আমাদের কারো মধ্যে নিত্যদিনের কোন দুষ্টুমি ছিল না। আমাদের সামনে আমাদের শিক্ষকরা ছিলেন। শিক্ষকদের কারো চোখে এতোটুকু বকুনির আভাষ ছিল না, বিরক্তির কোন ছোঁয়াও ছিল না কারো চোখে মুখে। অথচ, এমনকি আমরা মাথা সোজা করেই বসতে পারছিলাম না। আমাদের ঘাড়গুলো গুঁজে আসছিল। আমাদের চোখে ছিল জল, আমরা সেটা আড়াল করতে চেয়েও পারিনি, বারবার আস্তিনে চোখ মুছছিলাম। সেটা ছিল স্কুলে আমাদের শেষদিন। এসএসসি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে যাকে বলা হয় বিদায় সংবর্ধনা।
আমরা দশ বছর ধরে লেখাপড়া করছিলাম ওই এসএসসি পরীক্ষার জন্য। কিন্তু, পরীক্ষার আগে বিদায় নিতে এসে আমরা বুঝতে পারলাম, এদিনটা আমরা কেউই চাইনি। আমরা ওই স্কুলেই থেকে যেতে চাইছিলাম। যে প্রধান শিক্ষক খন্দকার মোহাম্মদ আলী কিংবা সহকারি প্রধান শিক্ষক জ্যেতিষ চক্রবর্তীকে দেখলে ভয়ে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যেতো, বিদায়ের দিন এসে বুঝলাম, আমরা বাকি জীবন তাদেরই ছাত্র থেকে যেতে চাই। আমাদের মনে হচ্ছিল ইংরেজি শেখানোর জন্য আমাদের নাভিশ্বাস তোলা অপরেশ স্যার, কানমলা দিয়ে জীবন কঠিন করে তোলা রথীবাবু স্যার, শুধু চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়েই বুকে ধড়াস ধড়াস ভয় ঢোকানো শহীদুল্লাহ বা হোসেন আলী স্যার কিংবা সবসময় বেত নিয়ে ক্লাসে আসা নুরুল্লাহ হুজুরদের ছাত্র হয়েই থাকতে চাই সারাজীবন।
সেদিনও শিক্ষকরা অনেক কথা বলেছিলেন। তবে, সেখানে লেখাপড়া কিংবা পরীক্ষার কোন বিষয় ছিল না। সেখানে ছিল আমাদের পরের জীবনকে গড়ে তোলার কথা। শিক্ষকরা জানতেন তারা বীজ বপন করে দিয়েছেন, এখন জীবন গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের। ৩১ বছর আগে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া ওই আমরা আজ যখন মাঝবয়েসী তখন বুঝতে পারি আমাদের প্রিয় স্কুল শিক্ষকরা তিল তিল করে আমাদেরকে জীবনের শুরুতে গড়ে তুলেছিলেন বলেই আমাদের পরের পথে হাঁটা সহজ হয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশে-বিদেশে এরপরের শিক্ষকদের কাছে জ্ঞান পেয়েছি, কেউ কেউ জীবনের জ্ঞানও দিয়েছেন, কিন্তু স্কুলের ওই শিক্ষকরা যেভাবে জীবনকে গড়ে তোলার জ্ঞান দিয়েছেন সেটাই পাথেয় হয়েছে সারাজীবন।
সেই জীবনের পথে আমাদেরও কেউ কেউ শিক্ষক হয়েছে, কেউ ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কৃষিবিদ, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ আমার মতো সাংবাদিক, কেউ এমনকি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা যাকে পিওন বলি সেটাও হয়েছে। অনেকেই আমরা পরে ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়েছি। সেখান থেকে দুয়েকজন রাজনীতিকও হয়েছে। আবার ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে জীবন থেকেও হারিয়ে গেছে একজন। এটা হচ্ছে রাজনীতির দুষ্টক্ষত। তোমরা যখন কলেজে পড়তে যাবে, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠনগুলো তোমাদেরকে দু হাত ভরে স্বাগত জানাবে। তবে, এতো কম বয়সেই রাজনীতিতে জড়ানো ঠিক হবে না।
তাই বলে তোমাদেরকে রাজনীতি বিবর্জিত হতেও বলছি না। তোমাদের কেউ যদি মনে করো মানুষের জন্য কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে রাজনীতিটাই মুখ্য তাহলে সে সুযোগও তোমাদের সামনে থাকছে। তোমরা যখন কলেজ পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যাবে সেটাই হবে তোমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময়। এর আগে যদি রাজনীতিতে জড়াও তাহলে নিজেকে গড়ার সময় পাবে না। এইচএসসিটা খুব অল্প সময়ের। পরবর্তী উচ্চ শিক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই দশ বছর তোমরা এক ধরনের খেলা খেলা করে লেখাপড়া করেছো। এইচএসসিতে দেখবে খুব অল্প সময়ে একগাদা পড়া। খেলাটা তখনো অব্যাহত রাখো, কিন্তু উচ্চ শিক্ষার জন্য তোমাদেরকে তখন নিজেকে গড়ে তোলারও বড় সময়।
আর যে রাজনীতির কথা আগে বলেছি, সেটাও তোমরা খেয়াল রাখো। নিশ্চয়ই তোমরা বুঝতে পারো, এমনকি আমরা যদি রাজনীতি নিরাসক্তও হই তারপরও সবকিছু রাজনীতি দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়। একটা ছোট উদাহরণ দেই। নিশ্চয়ই তোমরা বুঝতে পারো যে তোমরা পাঠ্যসূচিতে কী পড়ছো সেটা সরকার ঠিক করে দেয়। এখন এই সরকারের চরিত্রের উপর নির্ভর করবে পাঠ্যসূচি। সেটা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে একরকম, বিএনপি থাকলে একরকম, আর যদি কোন ধর্মভিত্তিক দল ক্ষমতায় চলে আসে তাহলে তা একেবারেই অন্যরকম হয়ে যাবে।
এখনই না, কিন্তু আরেকটু বড় হলে এজন্যও তোমাদেরকে রাজনীতি সচেতন হতে বলবো: আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি, এ কারণে আমাদের জন্য লেখাপড়া করাটা সহজ হয়ে গেছে। যে স্বাধীন রাষ্ট্র আমাদের অনেক সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে, সেই স্বাধীনতাটা এসেছে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ফল হিসেবে। ছাত্রদেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল তখন। তবে, তখনকার সময় আর এখনকার সময়ে অনেক পার্থক্য। তখন দেশ স্বাধীন করাটাই ছিল মুখ্য, এখন দেশ গড়া।
দেশ গড়ার কথা বললে আমাদের কল্পনায় নিশ্চয়ই আমাদের এখনকার সুন্দর দেশের চেয়ে আরো সুন্দর কোন দেশের চিত্রকল্প ভেসে উঠে। হতে পারে সেটা সুইজারল্যান্ডের মতো, কিংবা জাপান বা জার্মানির মতো। ওই দেশগুলো একদিনে গড়ে উঠেনি। আমার তোমার মতো মানুষরাই দেশগুলো গড়ে তুলেছে। সেটা সম্ভব হয়েছে তাদের জ্ঞানের সাধনায়। তাই আমাদের দেশটি গড়ে তুলতে চাইলে আমাদের সেরকম জ্ঞানের চর্চা করতে হবে। বলছি না যে তোমাদেরকে আইনস্টাইন বা স্টিফেন হকিংস বা নিদেনপক্ষে স্টিভ জবস হয়ে যেতে হবে। সেটা কেউ হলেতো অসাধারণ বিষয়। কিন্তু, ওই দেশগুলোরও ৯৯ শতাংশ মানুষ আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। তারা যেটা করেছে সেটা হলো একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নিশ্চিত করেছে। আমাদেরও সেটা করতে হবে।
এজন্য আমাদের সকলকে ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে। সেটা হচ্ছে আমাদের সবাইকে শিক্ষিত হতে হবে। শিক্ষিত হওয়া মানে শুধু ডিগ্রি নেওয়া নয়। শিক্ষিত মানে অন্যের প্রতি সহনশীল হয়ে নিজেকে স্বার্থপরতা থেকে বের করে আনা, আমার যেমন ভালভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে তেমনি অন্যেরও ভালভাবে বেঁচে থাকার অধিকারটাকে গুরুত্ব দেওয়া। খুব সহজ করে বললে আরেকটু বেশি মানবিক হওয়া, মানবিক থাকা। এই যে মানবিকতা– এটা মানুষের সহজাত, আবার স্বার্থপর হওয়াটাও তাই। কিন্তু, স্বার্থপর হয়ে শুধু নিজের কথা না ভেবে মানবিক হওয়ার শিক্ষাটা দেয় জ্ঞান। সেই জ্ঞান আমরা কোথা থেকে পাই?
এই জ্ঞান আমরা পাই বই থেকে। ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত আমরা হয়তো প্রায় ১০০ পাঠ্যবই পড়েছি। ছোটবেলার পাঠ্যবইগুলো জ্ঞানের ভাণ্ডার। কিন্তু, শুধু পাঠ্যবই-ই আমাদেরকে সব জ্ঞান দেয় না। আরো বেশি আলোকিত হওয়ার জন্য আমাদের আরো বই পড়তে হবে, অনেক-অনেক বই পড়তে হবে।
এই বই পড়ার অভ্যাস কি আমাদের একটু কমে যাচ্ছে? হয়তো তাই। বিশেষ করে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের যুগে একটু কমেতো যাচ্ছেই। আমি তোমাদেরকে প্রযুক্তিবিমুখ হতে বলব না। কিন্তু, মোবাইল ফোনটাই সবকিছু নয়। মোবাইলে ইন্টারনেট থাকলে আমরা হয়তো বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি, কিন্তু প্রস্তুত হওয়ার আগেই সেখানে যুক্ত হলে পিছলে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। তাই আগে নিজেকে তৈরি করতে হবে। সেই তৈরি করার একমাত্র উপায় হচ্ছে আরো বেশি বই, আরো বেশি বই পড়া।
এখন পরীক্ষার জন্য আমরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়তে পারব না। সেটা উচিতও হবে না। কিন্তু, পরীক্ষাটা শেষ করে আমরা সেটা শুরু করতে পারি। প্রচলিত অর্থে শিক্ষিত হওয়ার জন্য পরেও আমাদেরকে পাঠ্যবইতো পড়তে হবেই, কিন্তু আরো বেশি শিক্ষিত হয়ে প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য আমাদেরকে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক বেশি বই পড়তে হবে।
পাঠ্যবই পড়ানোর পাশাপাশি সেই মানুষ হওয়ার জন্য আমাদের মা-বাবাদের পাশাপাশি তোমাদের শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে গেছেন। আজ যখন তোমরা আরো বড় জায়গায় যাওয়ার জন্য এ স্কুল ছেড়ে যাচ্ছো, আমি নিশ্চিত– কষ্ট হলেও এ শিক্ষকদের চেয়ে সুখি আর কেউ নেই। তাই তোমরা আজ যখন এ স্কুল ছেড়ে যাচ্ছো তখন শুধু একটি ভবন, একটি খেলার মাঠ, কিছু ক্লাসরুম, কিছু কর্মকাণ্ড, কিছু বই, আর কিছু অভিজ্ঞতাই ফেলে যাচ্ছো না– এ মানুষগুলোকেও ছেড়ে যাচ্ছো যাদের শুভাশীষ হবে তোমাদের সারাজীবনের পাথেয়। আর যা কিছু ফেলে যাচ্ছো তারও কিছু আসলে ফেলে যাচ্ছো না– দশটি বছরকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছো তোমরা। এই দশ বছর হবে তোমাদের সারাজীবনের ভিত্তি এবং সঙ্গী। সেই জীবন তোমাদেরকে আহ্বান করছে। তাই আজ এ বিদায়ের সময় তোমাদের শিক্ষকদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, শুধু এসএসসি পরীক্ষা না, সারাজীবনের জন্য শুভ কামনা জানাই যাতে তোমরা অনেক বড় হও, আর মানুষ বলে– এ ছেলেটি বা এ মেয়েটি যে স্কুলে পড়তো তার নাম সাখুয়া আদর্শ বিদ্যানিকেতন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)