বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে তামাকের ব্যবহার কমানোর মতো করারোপ করা হয়নি। তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে যে সব উন্নয়ন ও সামাজিক সংগঠন কাজ করছে তারাও এমনটি বলছেন। বলা হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যম স্তরের সিগারেট, বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন (জর্দ্দা, গুল) তামাক পণ্যের দাম একদমই বাড়ানো হয়নি। সম্পুরুক শুল্ক হারও আগের মতোই আছে। কিন্তু তামাকের ব্যবহার এবং এ সংক্রান্ত অর্থের অপচয় কমিয়ে আনতে প্রয়োজন ছিল আরও করারোপ।
যেটা করলে সব ধরনের তামাক পণ্যের দাম বাড়তো। এতে সরকার যেমন বেশি রাজস্ব পেত তেমনি ধূমপায়ী এবং তামাক ব্যবহারকারীদের সংখ্যা আরও কমে আসতো। আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তো জনস্বাস্থ্যের উপর। বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কথা বলছেন। নিজেদের বক্তব্য হাজির করছেন।
তামাকের উপর অধিক করারোপ, তামাক ব্যবহারে কীভাবে জনস্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আগামীতে তামাকের কারণে আমাদের আরও কী কী ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে- এই আলোচনাগুলো এবার অনেক সংসদ সদস্যই সর্বশেষ বাজেট অধিবেশনে আলোচনায় এনেছেন, মাননীয় স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিষয়টি ভালো লেগেছে যে, আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে ভাবছেন। বিষয়টি জনগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নিয়ে আলোচনাতে নিয়ে এসেছেন।
তামাক একটি ধারাবাহিক ক্ষতিকর উপাদান- এ নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক অনাবশ্যক। তামাক চাষ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিপণন- সবখানেই ক্ষতির তথ্য মেলে। এই একটি পণ্য যা থেকে মানবদেহের কোনো লাভ হয় না, ক্ষতি ছাড়া। সেই ক্ষতিটা এখন আবার বহুভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে তামাক যে বা যারা সরাসরি গ্রহণ করছেন শুধু তারাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তা নয়, পরোক্ষভাবে অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন তামাকের পরোক্ষ ক্ষতিও কম নয়। যেখানে সেখানে তামাকের ধোঁয়ার কারণে অধূমপায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অসতর্কতার কারণে শিশুরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবার তামাক ব্যবহারের ফলে মানবদেহে যে সব রোগ হচ্ছে তার দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসায় প্রতিটি পরিবারকেই অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর অন্যতম কারণ তামাক। তামাক নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে সব গবেষণা হচ্ছে সেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি তামাকের কারণে মৃতু্যূঝুঁকি কতোটা সক্রিয়। তামাক শ্বাসজনিত বিভিন্ন রোগ এবং ক্যান্সারকে এখন সবেচেয়ে বিস্তৃত করছে। এসব রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিও মারাত্বক। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, তামাক চাষের কারণে অনেক ফসলি জমিতে ধান, পাট, ভুট্টা চাষ হচ্ছে না। বিশেষ করে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এটি দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন চরাঞ্চলে তামাক চাষের পরিধি বাড়ছে। এ সব জায়গাতে বিভিন্ন তামাক কোম্পানী বা সিগারেট কোম্পানীর প্রণোদনা নিয়ে চাষীরা প্রচলিত ফসলের বদলে তামাক উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
আমরা একটা বিষয় লক্ষ্য করছি এখানে কোনো ধরনের নজরদারি বা মনিটিরিং নেই। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচিত এখানে নজরদারিটা বাড়ানো। প্রতি বছর কী পরিমাণ নতুন জমি তামাক চাষের আওতায় চলে যাচ্ছে তার সঠিক তথ্যটা থাকতে হবে। উপজেলা, জেলা ওয়ারি তথ্য থাকা প্রয়োজন। নইলে আমাদের অনেক আলোচনা জলে পর্যবসিত হয়। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে প্রস্তাব করবো একটি নীতিমালা করে দ্রুত দেশের সমস্ত তামাক চাষীদের নিবন্ধনের আওতায় আনা হোক। তামাক চাষীদের নিবন্ধন করা হলে বছর অন্তে বোঝা সম্ভব কে তামাক চাষী আর কী পরিমাণ তামাক চাষ করে থাকেন। নিবন্ধনের পরপরই এই শর্ত দিতে হবে যে কোনোভাবেই নতুন কাউকে আর নিবন্ধন করা হবে না।
এরপর আস্তে আস্তে মোটিভেশন দিয়ে তামাক চাষ থেকে চাষীদের ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা যদি এরকম একটি নিয়ম নীতির মধ্যে না যাই তাহলে আমাদের কাছে অনেক তথ্যই অজানা থাকবে। তামাক চাষ কমিয়ে আনতে গেলে এ রকম একটি আইনি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা আবশ্যক। আমি তাই মনে অধিক করারোপের পাশাপাশি এই বিষয়গুলোও কার্যকর করতে হবে। একই সাথে বিড়ি-সিগারেট উৎপাদন, বিপণনে যারা জড়িত তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে।
আমাদের দেশে সব স্তরের মানুষের মধ্যেই কমবেশি তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের অভ্যাস রয়েছে। এই অভ্যাসের সামাজিক ইতিহাসও ভিন্ন। কম দামে পেলে আমরা অনেক কিছু খেতেই অভ্যস্ত। এক সময় বিড়ি এত সস্তা করা হয়েছিল যে শ্রমজীবী মানুষেরা মারাত্বরকম এই নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই নেশা থেকে এখনও শ্রমজীবী মানুষের বের করে আনা যায়। এ কারণে বিড়ি সিগারেটের দাম বৃদ্ধি করাটা সময়েরই দাবি। কিন্তু যারা সিগারেট-বিড়ির ব্যবসা করেন তারাও তাদের বিপণন কৌশল পরিবর্তন করেছেন। তামাক চাষীদের নগদ টাকা প্রণোদনা দেওয়া সেই কৌশলের অংশ। গ্রামের অনেক তামাক চাষীর ভাগ্য বদলে গেছে কর্পোরেট সিগারেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে। কিন্তু সামাজিক বা পারিবারিক ক্ষতিটা হয়েছে বেশি।
আমরা তামাক বাণিজ্য ও তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনতে আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি-২০১৬ আমাদের অনেক ধরনের নির্দেশনা ও উপলব্ধি নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে সর্বত্র তামাকের বিজ্ঞাপন, স্পনসরশীপ বন্ধ করা হয়েছে। টেলিভিশন, রেডিওসহ গণমাধ্যমে তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন নেই। রাস্তায় বিলবোর্ড নেই। নাটক, সিনেমায় সিগারেট-বিড়ির ব্যবহার নিষিদ্ধ। আবার থাকলেও সেখানে সরকারের সতর্কবাণী জুড়ে দিতে হবে। আর মানুষ এখন জানে পাবলিক প্লেসে ধূমপান করা যাবে না। সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া এইসব কর্মকৌশলের কারণেই তামাক ব্যবহারের কুফল অনেক বেশি এখন জনমনে দৃশ্যায়িত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য এগুলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
বাংলাদেশকে অবশ্যই তামাকমুক্ত করতে হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা করেছেন। আমাদের সামনে এটি একটি বড় মাইলস্টোন। এই লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে ধাপে ধাপে আমাদের অনেকগুলো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কোনো কিছুই রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। অনেক বাস্তবতাকে বিবেচনাতে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আমরা একটা বিষয় খেয়াল করছি প্রতিবছর কী পরিমাণ কৃষি জমিতে তামাক চাষ হয় তার কোনো সঠিক তথ্য কোথাও নেই। অনেকেরই অভিযোগ বেশি লাভের আশায় চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ রাজবাড়ী, পাবনাসহ আরও কিছু জেলাতে এক শ্রেণীর কৃষক প্রচলিত ফসল বাদ দিয়ে তামাক চাষে বেশি ঝুঁকছে। আমি মনে করি দ্রত তামাক চাষীদের নিবন্ধনের আওতায় আনা উচিত। এটি করা হলে প্রতিবছর তামাক চাষের জমি বেশি না কম ব্যবহ্নত হচ্ছে তা সহজেই বোঝা যাবে এবং তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে এই তথ্য উপাত্ত কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)