সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে মানুষের ঈদের আনন্দে। আগের দিনে ঈদ মানে পুরাতন জামাকপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে নতুনের স্বাদ নেয়া। কেউ কেউ পরিবারের অনেক কষ্টে কেনা জামাকাপড় পেতো, তার আনন্দও ছিল বলার মতো।

আজকালতো মধ্যবিত্তেরও ঈদের চেহারা, নিয়ম সব পাল্টে গেছে। এখন তো অনেকেই ঈদে বেড়াতে চলে যায়, বাচ্চারা দু’ঈদেই কাপড়-চোপড় পায়, একাধিক ভাগা কোরবানি দিতে পারে, ফ্রিজ- এমনকী ডিপ ফ্রিজও আছে সবার ঘরে, সেখানে জমিয়ে রাখার মত মাংশও থেকে যায়।
কিন্তু হারিয়ে গেছে পারিবারিক বা পাড়াতো সম্মিলন, বন্ধন, একটি কমদামি বা পুরনো কাপড় পাওয়ার আনন্দ। ঈদ আয়োজনের এমন পরিবর্তন নিয়ে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’এর সমন্বয়ক শাহানা হুদা এভাবেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন: ‘আমাদের সময় মানে আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন কোরবানির ঈদকে আমরা বলতাম ‘বড় ঈদ বা বোকরি ঈদ’। কেন এমনটা নামকরণ হয়েছিল জানিনা। এই, বড় ঈদে আমাদের কোন নতুন কাপড় কিনে দেয়া হতোনা। ছোট ঈদ বা রোজার ঈদে যা পেতাম, তার থেকেই একটা রেখে দিতাম। অথবা আম্মা তাঁর সংসার খরচ বাঁচিয়ে কোন সস্তা কাপড় কিনে বাসায় জামা বানিয়ে দিতো। তাতেই আমরা বেজায় খুশি থাকতাম। কারণ এই ঈদগুলো ছাড়া নতুন কিছু আমরা পেতাম না বললেই চলে ।
আমাদের কাছে বেশ বড় হওয়া অব্দি কোরবানি ঈদের মূল আনন্দতো কাপড় কেনা বা ৫/১০ টাকা সালামি পাওয়া ছিলনা, ছিল মনমত মাংশ ও পোলাও খাওয়ার আনন্দ। কারণ সেসময়ের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে এত খাওয়া-দাওয়ার প্রচলন বা সামর্থ্য কোনটাই ছিলনা। তাই কোরবানি ঈদ এলে আমরা মনের আনন্দে কোন হিসাব ছাড়াই মাংশ খেতে পারতাম।
আব্বাকে দেখেছি মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে আমার ফুপুর বাসায় একটা ভাগ দিতো। সেই বাসাতেই আমাদের খাটুরিয়া পরিবারের অনেকেই এসে জড় হতো। আব্বার ভাই, ভাতিজা, ভাগ্নেরা যেতো, যারা ঈদে ঢাকায় থাকতো। সবাই একটি করে ভাগ দিতো বলে ৭ জনতো সমবেত হতোই। সকালে যে যার বাসায় নামাজ পড়ে, ফুফুর বাসায় চলে যেতো। সঙ্গে আমরাও যেতাম। বেশ একটা পারিবারিক গেটটুগেদার হতো। লিলি ফুপু এটা সেটা রান্না করে রাখতেন সবার জন্য। সেসময় মোটামুটি সবাই একভাগ, দুভাগ বা একটি ছাগল কোরবানি দিতো। কারণ সবারই আয় ছিল লিমিটেড। অফুরান টাকার মালিক, এমন মানুষ ছিল হাতেগোণা কয়েকজন।
দুপুর নাগাদ মাংশ বাসায় আনার পর আম্মা পাল্লা-পাথর নিয়ে বসে যেতো তিন ভাগ করার জন্য। তারপর শুরু হতো বিতরণের কাজ। একভাগ চলে যেতো পাড়া-প্রতিবেশির ও আত্মীয়দের বাসায়, একভাগ দরজা থেকে দিয়ে দিতাম দরিদ্র মানুষদের। আর একভাগ উঠে যেতো সোজা চুলায়।
তখনতো আমাদের অধিকাংশ বাড়িতে ফ্রিজ ছিলনা, আর ডিপ ফ্রিজ নামক বস্তুটিরতো নামই শুনিনি। আম্মা তাও দু’একটা ছোট পোটলা কারো বাসার ফ্রিজে রাখার চেষ্টা করতো। তিনভাগ করার পর, যেটুকু মাংশ থাকতো, তা খুবই সামান্য ছিল। মোটামুটি প্রাণ ভরে খেলে ৭ দিনেই খতম করা যেতো। সেসময়তো সবই হালকা-পাতলা দেশী গরু ছিল। এখনকার মত বড় বড় পরদেশী গরু বা খামারের মোটাতাজা করা গরু দামি গরু ছিলই না।
যাহোক, আজকালতো মধ্যবিত্তেরও ঈদের চেহারা, নিয়ম সব পাল্টে গেছে। এখন আমরা অনেকেই ঈদে বেড়াতে চলে যাই, বাচ্চারা দু’ঈদেই কাপড়-চোপড় পায়, একাধিক ভাগা কোরবানি দিতে পারি, ফ্রিজ- এমনকী ডিপ ফ্রিজও আছে আমাদের সবার ঘরে, সেখানে জমিয়ে রাখার মত মাংশও থেকে যায় আমাদের।
শুধু হারিয়ে গেছে সেই পারিবারিক বা পাড়াতো সম্মিলন, সেই বন্ধন, একটি কমদামি বা পুরনো কাপড় পাওয়ার সেই আনন্দ, আর ‘বড় ঈদ’ এ হঠাৎ করে মনমত মাংশ খাওয়ার আনন্দ। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের বাচ্চারা আজকাল জানেই না “পাওয়ার আনন্দ” বলে যে একটা অতি মূল্যবান অনুভূতি আছে, পুরনো সবকিছুর সাথে সেটাও হারিয়ে গেছে।
এটাই বোধকরি সংসারের, সমাজের সতত পরিবর্তনশীল চেহারা।’