
করোনাকালের বহুল চর্চিত বাক্য কিংবা প্রশ্ন- ‘জীবন, না জীবিকা’? জীবন ও জীবিকার এই প্রশ্নে প্রথমেই আমরা জীবনকে অগ্রাধিকার দিতে চেয়েছি। যথার্থই এ নির্বাচন। কারণ জীবন না থাকলে যেখানে জীবিকার প্রয়োজনই পড়ে না সেখানে জীবন রক্ষাই অগ্রাধিকার। আর জীবন থাকলে জীবিকার প্রশ্ন আসবেই, কারণ জীবিকাবিহীন জীবন আপনা থেকেই দাঁড়িয়ে যায় মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তবু করোনাকালে জীবন ও জীবিকার এ দুইয়ের মধ্যে প্রথমে জীবন রক্ষার তাগিদ অনুভব করেছি, এরপর জীবন বাঁচিয়ে জীবিকার সন্ধানে যাওয়ার পথ খুঁজেছি।
করোনাকাল শেষ হয়ে যায়নি। বরং আগের চেয়ে আরও বেশি ভয়ঙ্কর রূপে হাজিরা দিচ্ছে নিয়ত। প্রতিদিনই বাড়ছে রোগী, বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। এই রোগী বাড়ার সংখ্যার পুরোটা আমরা হিসেবের মধ্যে নিয়ে আসতে পারিনি; বলা যায় নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না; বাস্তবতা বলছে- হবেও না। তাই আমরা শনাক্তের সংখ্যাটাই নিরূপণ করছি। অর্থাৎ স্বপ্রণোদিত হয়ে যারা নমুনা পরীক্ষায় আসছেন তাদের মধ্য থেকে আক্রান্তদের শনাক্ত করতে পারছি। আক্রান্ত ও শনাক্তের এই যে সূক্ষ্ম পার্থক্য এটা কেবলই আমাদের দেশে নয়, বলা যায় পৃথিবীর সবখানে। একইভাবে আসে মৃত্যুর সংখ্যাও। এটা আদতে শনাক্তদের মৃত্যুর সংখ্যা নিরূপণ। এর বাইরে করোনার উপসর্গ নিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তারাও স্বাভাবিকভাবে আসছেন না হিসাবে। এটা সরকারি তথ্য। সরকারি তথ্যে যা আসে সেটা আক্রান্তের নয়, শনাক্তের। একইভাবে মৃতদের সংখ্যাও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর নয়, শনাক্তদের মৃত্যু।
২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে গত রোববার (৮ আগস্ট ২০২১) পর্যন্ত দেশে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯৫ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৯ সালের জুন মাসের আদমশুমারির মধ্যবর্তী প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। এই তথ্যের বাইরে এই দুই বছরে জনসংখ্যা আরও বেড়েছে নিশ্চিতভাবে। সে হিসেবে দেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৭ কোটির মত। দেশের জনসংখ্যাকে ১৭ কোটি হিসেবে ধরে নিয়ে যদি আমরা করোনাকালের ৫১৮ দিনের হিসাবকে সামনে আনি তাহলে দেখব এই দীর্ঘ সময়ে আমরা এক কোটির মত লোককেও করোনার নমুনা পরীক্ষার মধ্যে আনতে পারিনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৮ আগস্টের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৮১ লাখ ১৭ হাজার ৪১০টি নমুনা পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। এত বিশাল জনসংখ্যার একটা দেশের দৈনিক নমুনা পরীক্ষা গড় মাত্র সাড়ে ১৫ হাজার।

সরকারি হিসাবে রোববার পর্যন্ত দেশে ২২ হাজার ৬৫২ জন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিনই মৃতের সংখ্যা দুইশ-আড়াইশ ছাড়াচ্ছে। সংখ্যাটা মূলত শনাক্ত রোগীদের মধ্যকার মৃত্যুর। এরবাইরে শুরু থেকেই প্রতিদিন যারা করোনার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে কিংবা বাড়িতে মৃত্যুবরণ করছেন সে হিসাব এখানে স্বাভাবিকভাবেই আসছে না। বলা যায়, শনাক্তের সংখ্যা যেমন দেশের করোনার সামগ্রিক চিত্র নয়, মৃত্যুর তথ্যও একই রকমের। এখানে অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দোষ নেই, কারণ সীমিত হলেও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ করোনার নমুনা পরীক্ষায় এখনও আগ্রহী নয়।
বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রে জানা যাচ্ছে, করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে গত কয়েক মাস ধরে করোনার এই ঊর্ধ্বগতি। আমরা যদি জুন-জুলাই মাসের করোনার গতিপ্রকৃতি ও মৃত্যুর হার বিশ্লেষণ করি তাহলে নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগ বাড়বে। জুন মাসে দেশে ৬ লাখ ৬১ হাজার ৪১৪টি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন, মৃত্যু ছিল ১ হাজার ৮৮৪ জনের; জুলাই মাসে ১১ লাখ ৩১ হাজার ৯৬৭ জনের নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩ লাখ ৩৬ হাজার ২২৬ জন এবং ৬ হাজার ১৮২ জন; আগস্ট মাসের প্রথম আটদিনে ৩৭ লাখ ৬৫ হাজার ৫১৬টি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন ১ লাখ ৪ হাজার ২১১ জন আর মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৯৬৭ জনের। মাসওয়ারী হিসাবে নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার জুন ও জুলাইয়ে যথাক্রমে ১৭ দশমিক ০৪ শতাংশ ও ২৯ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং আগস্ট মাসের এই কদিনে শনাক্তের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। করোনার এই চিত্র বলছে দেশে করোনা নিয়ত বাড়ছে এবং এই ঊর্ধ্বগতি বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
করোনার সংক্রমণ রোধে এক মাসের বেশি সময় আগে থেকে এই পর্বের লকডাউনের নামে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ দিলেও ১১ আগস্ট থেকে সরকার ধাপে ধাপে এই লকডাউন কিংবা ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জীবন বাঁচাতে যে লকডাউনের সিদ্ধান্ত গত ১ জুলাই থেকে দেওয়া হয়েছিল মাঝখানে এর বিরতি ছিল ঈদ উদযাপনের জন্যে। এদিকে, রোববার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নতুন যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার তাতে ১১ আগস্ট থেকে সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি অফিস, যানবাহন, বিপণি বিতান ও দোকানপাট ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ খুলে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যদিও এ মাসের শুরু থেকেই শিল্প কারখানা খোলা রয়েছে। সরকার সবকিছু খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিলেও এই পর্বে এখনই পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার বা বিনোদনকেন্দ্র খোলার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। হোটেল-রেস্তোরাঁও খুলে দেওয়া হয়েছে, তবে সেখানে অর্ধেক আসন ফাঁকা রাখতে হবে। গণপরিবহনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক এলাকার প্রতিদিন মোট যানবাহনের অর্ধেক গাড়ি রাস্তায় নামানোর শর্ত রয়েছে। গণপরিবহন নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তবে বরাবরের মত এবারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিষয়ে ইতিবাচক কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। প্রায় দুই বছরের কাছাকাছি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। মাঝখানে মাদ্রাসা খুলে দেওয়া হলেও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়নি।
করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিনেসন কার্যক্রম চলছে দেশজুড়ে। ইতোমধ্যে ইউনিয়ন পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। পূর্ব-সিদ্ধান্ত ঠিক থাকলে ১৪ তারিখ থেকে ইউনিয়ন পর্যায়েও গণটিকা কার্যক্রম শুরু হবে। ইউনিয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ের ভ্যাকসিন প্রদানে সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না বলে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব, মানুষের অসচেতনতা এবং দায়িত্বশীলদের খামখেয়ালি যাই হোক না কেন স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করার এই প্রবণতা ও অনুশীলনের ফল যে সুখের হবে না তা বলাই বাহুল্য। করোনা সুরক্ষার ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে এসে মানুষের এই গাদাগাদি সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বৈকি। এনিয়ে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার।
করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করার প্রবণতাও বাড়ছে। ঝুঁকিপূর্ণ এই পরিস্থিতিতে আবার সবকিছু খুলে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। লকডাউন কিংবা কঠোর বিধিনিষেধের সময়েও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেনি, মেনে চলতে বাধ্য করার পরিস্থিতিও তৈরি করা যায়নি। এমন অবস্থায় সবকিছু খুলে দেওয়ার পর দেশের অবস্থায় কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাই দেখার!
‘জীবন, না জীবিকা’- পরিবর্তিত পরিস্থিতির এই সময়ে সরকার এখন জীবনের সঙ্গে কিছুটা আপস করে জীবিকাকেই প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জীবন-জীবিকার এই পরিবর্তিত প্রশ্ন কিংবা দ্বন্দ্বের সঙ্গে তবু শিক্ষা কেন যুক্ত হয় না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)