জহির রায়হান ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা এবং আরও অনেক কিছু। তবে তার চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব পরিচয়টি সবচেয়ে বড়। আর এই পরিচয়ে তিনি ছিলেন পূর্ণাঙ্গ। একজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের যা যা করার কথা তার সবই তিনি করেছেন। ১১ টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, প্রযোজনা করেছেনও ১১টি চলচ্চিত্রের। তিনি গান লিখেছেন, অন্য পরিচালকের জন্য চিত্রনাট্যও লিখেছেন।
কিন্তু তিনি এমন আরেকটি কাজ করেছেন যা সচরাচর দেখা যায় না- তিনি গঠন করেছিলেন ‘সিনে ওয়ার্কশপ’ এবং সেই ওয়ার্কশপ থেকে তার তত্ত্বাবধানে তরুণ নির্মাতারা যৌথভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন। পাকিস্তানের প্রথম রঙ্গীন চলচ্চিত্র ‘সঙ্গম’ ও প্রথম সিনেমাস্কোপ চলচ্চিত্র ‘বাহানা’ও তিনি নির্মাণ করেছিলেন।
প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ তার অনবদ্য এক সৃষ্টি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তিনি করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের রূপরেখা কেমন হবে, তার পূর্ণাঙ্গ ধারণাপত্র তিনি তৈরি করেছিলেন এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে তিনি তা জমাও দিয়েছিলেন।
কিন্তু ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি নিখোঁজ হবার পর আমলাতন্ত্রের ফাইলের স্তূপে তা হারিয়ে যায়। আলমগীর কবির তার ‘ফিল্ম ইন বাংলাদেশ’ (১৯৭৯) বইতে জানাচ্ছেন, সেই রূপরেখায় চলচ্চিত্র কারখানার জাতীয়করণের কথা ছিল। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা কিউবার চলচ্চিত্রে সরকারি পৃষ্ঠাপোষকতার ফলে যে উন্নয়ন ঘটেছিল, সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী জহির রায়হান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকেও সেভাবেই দেখতে চেয়েছিলেন।
সারাজীবন কাহিনীচিত্র নির্মাণ করে গেলেও, যখন জাতির প্রয়োজন পড়েছে, তিনি নেমে পড়েছেন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দেশি-বিদেশি নির্মাতারা বেশ কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। তবে দেশি নির্মাতাদের উল্লেখযোগ্য চারটি চলচ্চিত্রেই তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি নিজে নির্মাণ করেছেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ এবং ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’। আর প্রযোজনা করেছেন আলমগীর কবিরের ‘লিবারেশন ফাইটার্স’ এবং বাবুল চৌধুরীর ‘ইনোসেন্ট মিলিয়নস’। এসব থেকেই প্রমাণ হয়, তাকে একজন ‘পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব’ কেন বলছি। চলচ্চিত্রকার হিসেবে তার প্রস্তুতিপর্বটিও লক্ষ করার মতো। তিনি চিত্রগ্রাহক হতে চেয়েছিলেন প্রথমতঃ।
তাই কলকাতার প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউট অফ ফটোগ্রাফিতে সিনেমাটোগ্রাফির ওপরে পড়তে গিয়েছিলেন। তা শেষ করতে পারেননি। তবে হাতেকলমে চলচ্চিত্র শেখার সুযোগ পেলেন এ জে কারদারের মতো পরিচালকের কাছে। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ (১৯৫৯) চলচ্চিত্রে সহকারি পরিচালক ছিলেন তিনি। এই চলচ্চিত্রটি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া এফডিসির প্রথম বছরগুলোয় এহতেশাম ও সালাউদ্দিনের মতো পরিচালকের সহকারি ছিলেন তিনি। আর বিদ্যায়তনে প্রথমে অর্থনীতিতে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত তিনি পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। গল্প-উপন্যাস লেখার পাশাপাশি শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম চলচ্চিত্রেই তার মেধার সর্বোচ্চ স্ফূরণ ঘটে।
জহির রায়হানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ (১৯৬১) বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসেই এক ব্যতিক্রমী সৃষ্টিকর্ম। একজন প্রায়-বেকার তরুণ পেইন্টারের ঘাড়ে দুই বোনের দায়িত্ব, অথচ আর্থিক সামর্থ্য নেই তার। অন্যদিকে প্রতিবেশী ধনাঢ্য ব্যক্তির সংগ্রহে বহু ভাস্কর্য, তার সংগ্রহের আছে রক্তমাংসের এক নারীও। অন্যান্য সংগ্রহের মতোও এই নারীর মালিক সে। সেই নারীর সঙ্গে পেইন্টার যুবকের সম্পর্ক হয়, কিন্তু সংগ্রহশালা থেকে নারীকে উদ্ধার করতে পারে না যুবক।
এদিকে দারিদ্র্য সইতে না পেরে দুই বোন আত্মহত্যা করে। পেইন্টার মৃত দুই বোনের ছবি এঁকে যুবক নিজেও আত্মহত্যা করে। ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায় আরেক পরিবার আসছে বাড়িটিতে। সেখানেও এক যুবক, তার দুই বোন সঙ্গে। আর সংগ্রহশালার নারীটি তখনও বন্দি, আগের মতোই। এভাবে এক রহস্য দিয়েই চলচ্চিত্রটি শুরু হয়েছিল এবং রহস্য দিয়েই চলচ্চিত্রটি শেষ হয়।
রহস্যময় এই চলচ্চিত্রের ধনাঢ্য ব্যক্তিটিও স্বৈরতান্ত্রিকতা ও পুরুষতান্ত্রিকতার এক প্রতিনিধি যেন। রহস্য ও প্রতীকের মধ্য দিয়ে জহির রায়হান যেন এক রাজনৈতিক বার্তাই দিলেন ‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রে। ‘কখনো আসেনি’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কারখানার মাপে এক অগ্রগামী সৃষ্টিকর্ম; দর্শক ও সমালোচকদের কাছে তা দুর্বোধ্যই থেকে গেছে। ফলে এধরনের চলচ্চিত্র জহির রায়হান পরে আর নির্মাণ করেননি।
‘জীবন থেকে নেয়া’ (১৯৭০) জহির রায়হানের সবচেয়ে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। পাকিস্তানি স্বৈরশাসককে বোঝাতে তিনি নির্মাণ করেন এক পরিবারের বদরাগী মা চরিত্রটি, যার রোষের শিকার পরিবারের প্রতিটি সদস্য। এই চলচ্চিত্রের অন্যতম একটি দিক হলো চলচ্চিত্রের পাত্র-পাত্রীদের একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে পাঠিয়ে সত্যিকারের প্রভাত ফেরীর চিত্র ধারণ করা হয়। আর রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির দারুণ চিত্রায়ণ করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হয়। তবে সোভিয়েত রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের পুরোধা সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’-এর শৈলী অনুসরণ করে এই চলচ্চিত্রে মন্তাজের প্রয়োগ ঘটানো হয়। ক্লোজ-আপ ও স্বল্পদৈর্ঘ্যের শট ব্যবহার করে টেনশন তৈরির মাধ্যমে দ্রুত সম্পাদনার যে রীতি বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়ান চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ কিংবা ‘দুনিয়ার সব গরিবকে আজ জাগিয়ে দাও’ গানে জহির রায়হান একইভাবে ব্যবহার করেছেন।
তবে জেন্ডারের দৃষ্টিতে চলচ্চিত্রটির সমালোচনা এরকম হতে পারে যে, স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্রে কেন মাকে বেছে নেয়া হলো, কেন বাবাকে নয়? সমাজে তো মায়েদের তুলনায় বাবারাই বেশি স্বৈরতন্ত্রের চর্চা করেন। জহির রায়হানের জন্য আরেকটি সমালোচনা হলো কেন তিনি উর্দুভাষার ছবি নির্মাণ করতে গেলেন অন্যদের মতো?
যে জহির রায়হান ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনে ১৪৪ ধারা অমান্য করে গ্রেফতারে হয়েছিলেন, তিনিই কিনা উর্দু ভাষায় ছবি নির্মাণ করে বৃহত্তর বাজার ধরার আপসে নিজের নাম লেখালেন! চলচ্চিত্র এমন এক শিল্পমাধ্যম, পুঁজির সঙ্গে নানান আপসে নাম লেখাতে হয় সকলকেই। তাতে আদর্শও মাঝে মাঝে পদদলিত হয়। জহির রায়হান নিজেকে যুক্ত করেছেন সুমিতা দেবী ও খান আতাউর রহমানের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠিত নায়িকা সুমিতা দেবী জহির রায়হানের প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ এবং দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘কাঁচের দেয়াল’-এ প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেন।
‘জাগো হুয়া সাভেরা’ থেকেই খান আতাউর রহমানের সঙ্গে জহির রায়হানের বন্ধুত্বের ও কাজের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অভিনয় ও গানের মধ্য দিয়ে খান আতা জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে অবদান রেখে গেছেন। ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়েই নায়ক হিসেবে রাজ্জাক ও নায়িকা হিসেবে সুচন্দা প্রতিষ্ঠিত হন। সুচন্দার বোন ববিতা ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে নির্বাচিত হন, যদিও চলচ্চিত্রটি শেষ হয়নি।
আমরা জানি জহির রায়হান প্রথমে সুমিতা ও পরে সুচন্দাকে বিয়ে করেন। আর জহির রায়হানের কাছে কাজ শিখে পরে চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন আলমগীর কবির ও আমজাদ হোসেন।
আলমগীর কবিরের মতে, চলচ্চিত্রের নন্দনতাত্ত্বিক বিবেচনায় জহির রায়হানের শ্রেষ্ঠ কাজ ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩)। চলচ্চিত্রটি দর্শকপ্রিয় হয়নি, কিন্তু পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার, নিগার পুরস্কার এবং ফ্রাংকফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে সার্টিফিকেট অব মেরিট পুরস্কার পায়। ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) ও ‘আনোয়ারা’ (১৯৬৭) নিশ্চয়ই তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র।
জহির রায়হান বেঁচে থাকলে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আজ অন্য এক উচ্চতায় থাকতো। আল-বদর বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। অথচ জহির রায়হান হারিয়ে গেলেন স্বাধীন বাংলাদেশে।
সহায়ক গ্রন্থ:
অনুপম হায়াৎ (২০০৭)। জহির রায়হানের চলচ্চিত্র: পটভূমি বিষয় বৈচিত্র্য। ঢাকা: দিব্যপ্রকাশ।
আলমগীর কবির (১৯৭৯)। ফিল্ম ইন বাংলাদেশ। ঢাকা: বাংলা একাডেমী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)