ঈদের জন্য দশটি নাটক নির্মাণ করেছেন সময়ের আলোচিত নাট্য নির্মাতা মাবরুর রশিদ বান্নাহ। তিনি জানালেন, কাজগুলো নিয়ে তার প্রত্যাশার জায়গা অন্যান্যবারের চেয়ে এবার অনেক বেশি। দর্শক যেন তার নির্মিত প্রতিটি কনটেন্ট উপভোগ করতে পারেন সেই চেষ্টার কমতি রাখেননি বান্নাহ। ঈদে বানানো দশটি নাটক ও ওটিটি, ইউটিউব ও টিভি মিডিয়ায় নানান বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেন চ্যানেল আই অনলাইনের সাথে…
এবার ঈদের জন্য কয়টি নাটক বানালেন?
দশটি। মায়ের ডাক, নিকষিত, কালাই, সুইপার ম্যান, দ্য হাইজ্যাকার, দ্য টিচার, ম্যাডম্যান, ফাতরা, আমাদের বিয়ে, হোম পলিটিক্স।
দর্শক ভিন্ন ভিন্ন কাজ দেখতে চায়। আপনার এই কাজগুলোতে ভিন্নতা থাকছে কতোখানি?
প্রত্যেকটি কাজ একটু বেশি ভালো করার চেষ্টা করেছি। কাজে ভিন্নতা থাকলে দর্শক উপভোগ করবেই। তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়েছি কাজগুলোতে। এখন অপেক্ষায় আছি ফিডব্যাকের। যেহেতু কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছি এবং বেশি পরিশ্রম দিয়ে করেছি, বিশ্বাস করি কাজগুলোর সাড়া খুব ভালো আসবে। দেখার আগে দর্শকদের একরকম ধারণা হবে কিন্তু নাটক দেখার পর অন্যরকম ধারণা জন্মাবে।
ঈদে আলোচিত কাজগুলোর মধ্যে প্রায় প্রতিবারই আপনার কাজও থাকে। ভিউ পরিসংখ্যানেও এগিয়ে থাকে। এবারও তেমনটা আশা করেন?
প্রতিবার বিভিন্ন জনরার কাজ থাকে। এবারও ভিন্ন জনরার কাজ করেছি কিন্তু ব্যতিক্রম হচ্ছে এইবার নিরীক্ষাধর্মী কাজ বেশি করেছি। অন্যবার ভিউ বেশি হবে এমন কেন্দ্রিক কাজ বেশি থাকে। এবার ভিউ টার্গেট করে একেবারেই কাজ করিনি। অন্তত একটি কাজে বেশি ভিউ হবে এই চিন্তা মাথায় ছিল না। মোটকথা গল্প প্রাধান্য দিয়েছি, ভিউ চিন্তা করে নাটক নির্মাণ করিনি এবার। ‘মায়ের ডাক’ নাটকে ছয়জন জনপ্রিয় শিল্পী আছেন। অনেকেই হয়তো ভাববেন যেহেতু ছয়জন জনপ্রিয় তারকা আছে অনেক বেশি ভিউ হবে! রোমান্টিক কমেডি বানালে হয়তো অনেক বেশি ভালো হতো। কিন্তু তাদের নিয়ে আমি ফ্যামিলি ড্রামা বানিয়েছি।

সবাই ভিউয়ের দৌড়ে এগিয়ে থাকতে চান। এবার কী হলো, যে কারণে আপনি ভিউয়ের চিন্তা থেকে সরে এলেন?
করোনার কারণে গত তিন ঈদ অনেকটা দম বন্ধ অবস্থায় ছিলাম। এখনও আছি। পরিস্থিতির কারণে কোনভাবেই গল্প ঠিকভাবে বলতে পারছিলাম না। বেশিরভাগ গল্পই ইনডোর বেইজ করতে হচ্ছিল। কিন্তু এবার করোনার মধ্যে আউটডোর শুটিং করতে গিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। গল্প বলতে না পারার কষ্ট এবার সেরে ফেলতে চেয়েছি। মনে হচ্ছিল, গত তিনটায় যেহেতু পারিনি এবার যেকোন ভাবেই ভালো গল্প বলতে হবে। সেই চিন্তা থেকে ভিউ মাথায় না এনে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করেছি।
ভিউ বেশি হতে হবে প্রযোজকদের থেকে এমন শর্ত বা চাপ থাকে?
মাঝেমধ্যে আকার ইংগিতে বুঝিয়ে দেয়া হয় কিন্তু সরাসরি কখনো ফেইস করিনি। তবে শুনেছি যারা নতুন নির্মাতা ইন্ডাস্ট্রিতে অবস্থান তৈরি করতে পারেনি তাদেরকে শুরুতেই চাপ দেয়া হয়, এত পরিমাণ ভিউ না হলে পরবর্তীতে আর কাজ পাবে না। সেক্ষেত্রে ওই নতুন নির্মাতাকে ভিউ আনার জন্য অনেক ধরনের উপাদান যোগ করতে হয়। এ কারণে গল্পের জায়গাটা অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়।
বছর তিনেক আগেও আপনার নাটক নিয়ে যেমন মাতামাতি হতো, এখন তুলনামূলক কম হয় বলে অনুভব করেন?
আমি অনুভব করি আমার নাটকের দর্শক দিন দিন বাড়ছে। সমালোচকদের কথা যদি ধরি তাদের একেক জনের দৃষ্টিকোণ একেক রকম। আবারো বলছি, গত তিনটা ঈদ মন খুলে গল্প বলতে পারিনি। গত দেড় বছরে করোনাকে হ্যান্ডেল করে কাজ করেছি। তবে এবার আমি আত্মবিশ্বাসী যদি কোন গ্যাপ থাকে সেটা পূরণ হবে।
ওটিটির জন্য আলাদা করে কনটেন্ট তৈরি হচ্ছে। নাটকের জন্য ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক দিক?
আমাদের দুর্ভাগ্য যে ৪০ মিনিটের কনটেন্ট বানাতে হয়। চ্যানেল কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত ওটিটি কতটা এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এটা সত্য আমাদের দেশের যেকোনো নতুন কিছু এলে শুরুতে আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ি। ওটিটিতে যেভাবে কাজ হচ্ছে আগামী দুই বছর পরেও যদি একইভাবে কাজ হয় সেটা হবে খুবই ইতিবাচক। ইন্ডিয়ান ওটিটিগুলো আমাদের দেশে বেশ ভাল অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু পুরোপুরি আমাদের দেশীয় ওটিটি কিন্তু এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের দেশের ওটিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়া খুব জরুরি। ওটিটির দেখাদেখি প্রতিটি চ্যানেলগুলোর কাজ নিয়ে আরো বেশি সিরিয়াস হওয়া উচিত।
বহুমুখি প্রতিযোগিতার এই সময়ে বাংলাদেশের টিভি নাটকে গুণগত কী পরিবর্তন হলে আবার দাপুটে অবস্থায় ফিরতে পারবে বলে আপনি মনে করেন?
প্রথম দরকার প্রতিটি চ্যানেলকে পে চ্যানেল হওয়া উচিত। কারণ, চ্যানেল বাঁচলে ভাল কনটেন্ট তৈরি হবে। পৃথিবীর যেসব টিভি ইন্ডাস্ট্রি সার্ভাইব করে ভালো চলছে সবগুলোর পাওয়ার দর্শকদের হাতে। বিজ্ঞাপন নির্ভরশীলতা আমাদের কনটেন্টগুলো গিলে খাচ্ছে। দর্শক বিনোদন মূলক কাজ দেখুক টাকা দিয়ে। যখন দর্শক টাকা দিয়ে দেখবে তখন সে ভালো কাজগুলো খুঁজে খুঁজে দেখবে।
দ্বিতীয়ত, চ্যানেলের নীতিনির্ধারণে সঠিক মানুষ থাকার পাশাপাশি শক্তিশালী কনটেন্ট ক্রিয়েট টিম থাকা আবশ্যক। প্রি-প্রোডাকশন থেকে প্রচারের পর পর্যন্ত তারাই কন্টেন্টের সাথে লেগে থাকবে। তৃতীয়ত, বাজেট। ভালো কনটেন্ট তৈরি করার জন্য বাজেট দরকার। বাজেট বেশি হলে কনটেন্ট ভালোর সিকিউরিটি দেয়। ওটিটিতে ভালো ও আশাবাদী কনটেন্ট দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো আমাদের তৈরি নাটকের বাজেটের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। চতুর্থত, মার্কেটিং এবং প্রমোশন টিম দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে পরিচালকরাই এটি করে থাকেন। পোস্টার, ট্রেলার, নাটক প্রচার, ইউটিউবে আপলোড হলো কিনা সবকিছুই পরিচালকদের কেন দেখতে হবে? এগুলো দেখভাল করতে প্রমোশন টিম থাকা উচিত।
শেষ যে পরিবর্তনের কথাটি বলতে চাই, বা এটি প্রথমও বলা যায়- আমাদের পরিচালক হওয়ার জন্য সঠিক স্কুলিং বা ইনস্টিটিউশনের অভাব আছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ল’এয়ার থেকে সব পেশায় ইনস্টিটিউশনে পড়তে হয়। কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের পড়ালেখার জন্য ইন্সটিটিউশন ও কঠিন পরীক্ষা দেয়ার জায়গা কোথায়? হুট করে এসেই পরিচালক, প্রযোজক, ডিওপি হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করছি। ইনস্টিটিউশন নেই বলেই স্বাধীনতার পর ৫০ বছর লেগেছে আমাদের একটি সিনেমা কানস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে যেতে। তাহলে বোঝা উচিত আমরা কতটা পিছিয়ে আছি। আমাদের নির্মাণ সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারা স্বশিক্ষিত। তাই আমাদের শিক্ষাগত ব্যাকরাউন্ড জরুরি। এজন্য দরকার ইন্সটিটিউশন।
এখনতো বেশিরভাগ কাজ ইউটিউব নির্ভর। ইউটিউব নিয়ে কিছু বললেন না?
ইউটিউব কোন সমাধান হতে পারে না। যে রেভিনিউ সিস্টেম সেটিও টিভি মিডিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ। ইউটিউব যে কেউ চালাতে পারে, টিভি যে কেউ পারে না। সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন মনে করি, ওটিটির মত টেলিভিশনকে বড় ক্যানভাসে কাজ করা। ওটিটি যে টিভিকে ধাক্কা দিচ্ছে একটা সময় এটা কাজে দেবে। ফিল্মিং বা গল্প বলার কোনো সময় বেঁধে দেয়া যাবে না। দেশে বেশি বেশি টিভি নির্ভর সিনেমা তৈরি হওয়া জরুরি।