
গত পাঁচ দিন ধরে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু কাশ্মীরের সঙ্গে দেশটির অন্যান্য অঞ্চলসহ বহির্বিশ্বের যোগাযোগ প্রায় বন্ধ। কাশ্মীরিদের অভিযোগ, খোলা আকাশের নিচে থেকেও যেন এক কারাগারে বসবাস করছেন তারা।
সেখানে ইন্টারনেটসহ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে থাকা কাশ্মীরিরা কাশ্মীরে অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না। ফিরে আসতে চাইলেও তাদের অনেককেই কাশ্মীরে ঢুকতে বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ।
শুধু আন্তর্জাতিক কিছু গণমাধ্যম কাশ্মীরে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। এদের প্রকাশিত খবর ও ছবিতেই ফুটে উঠছে কাশ্মীরের অধিবাসীদের ভেতর তৈরি হওয়া ক্ষোভ আর ‘প্রতারিত হওয়া’র অনুভূতি।
সোমবার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রহিতের ঘোষণার মধ্য দিয়ে কাশ্মীরের প্রায় ৭০ বছর ধরে পেয়ে আসা স্বায়ত্তশাসনসহ বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা তুলে নেওয়া হয়। পাশাপাশি রাজ্যটিকে ভেঙে লাদাখ ও জম্মু-কাশ্মীর নামে দুটি আলাদা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকেই ফুঁসে উঠেছে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনগণ।

এই ঘোষণায় প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এরই মধ্যে পাকিস্তান ভারতের সাথে কূটনীতিক যোগাযোগ ছিন্ন করেছে। স্থগিত করেছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, রেল ও বিমান যোগাযোগ। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা কাশ্মীরের জনগণের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবো।’
বলতে গেলে সোমবারের আগে থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং কাশ্মীরিদের সে অঞ্চলে ঢোকা-বের হওয়া বন্ধের পাশাপাশি সব ধরনের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। রাস্তায় নামানো হয় সেনাবাহিনী ও প্যারামিলিটারি। তবে শুক্রবার তা কিছুটা শিথিল করা হয়। লেহ ও জম্মু থেকে তুলে নেওয়া হয় ১৪৪ ধারা। খুলে দেওয়া হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি দপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
এ পর্যন্ত কাশ্মীরের ৩ শতাধিক রাজনৈতিক নেতাকে নির্বিচারে আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে কাশ্মীরের দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আছেন। আরেকজন সাবেক মুখ্যমন্ত্রী, যিনি বর্তমানে কাশ্মীরের একজন সংসদ সদস্য, গৃহবন্দী অবস্থায় রয়েছেন।
যদিও ৩৭০ ধারা বাতিলের পর জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছেন, ‘আজীবন জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত রাজ্য থাকবে না। এবার জম্মু ও কাশ্মীরে উন্নয়ন হবে।’
‘সরকার আমাদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেছে’
বিবিসি’র প্রতিনিধিদল কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরের খান্নারে সংবাদ সংগ্রহে গেলে কয়েকজন বিক্ষুব্ধ কাশ্মীরি তাদের কাছে অভিযোগ জানাতে আসেন।
বিবিসি সংবাদদাতা গীতা পান্ডে বলেন, ‘অন্তত আধ ডজন রোডব্লক পেরিয়ে আরও একটি ব্যারিকেডের কাছে পৌঁছানোর পর আমি গাড়ি থেকে বের হই কয়েকটা ছবি তোলার জন্য। ওই সময় পাশের একটি গলি থেকে কয়েকজন লোক বের হয়ে কথা বলতে আসেন। এক ধরনের অবরোধে আটকা পড়ে আছেন বলে অভিযোগ করেন তারা।’

‘দলটির বয়স্ক একজন বললেন, ‘সরকার আমাদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করেছে’। ওই সময় প্যারামিলিটারি পুলিশ আমাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ওই ক্ষুব্ধ বৃদ্ধ আঙ্গুল উঁচিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন: ‘তোমরা আমাদেরকে দিনে বন্দী করে রাখো, রাতে বন্দী করে রাখো’।’
ওই সময় একজন পুলিশ সদস্য এলাকায় কারফিউ চলছে জানিয়ে তাদেরকে তক্ষুণি ভেতরে চলে যেতে নির্দেশ দেন। কিন্তু ক্ষিপ্ত ওই বৃদ্ধ সেখানেই দাঁড়িয়ে ঝগড়া করতে থাকেন।
গীতা জানান, পুলিশ সাংবাদিকদের সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলে সরে যেতে বাধ্য হন তারা। কিন্তু ততক্ষণে কোলে ছোট একটি ছেলেকে নিয়ে একজন যুবক এগিয়ে আসেন তার দিকে। জানান, ভারত সরকারের বিরুদ্ধে এখন অস্ত্র হাতে নিতেও প্রস্তুত তিনি।
‘এটা আমার একমাত্র ছেলে। ও এখনো খুব ছোট। কিন্তু আমি ওকে এমনভাবে তৈরি করব যেন ও-ও হাতে অস্ত্র তুলে নিতে পারে।’ গীতা জানান, ওই ব্যক্তি সরকারের সিদ্ধান্তে ক্ষোভে এতটাই ফুঁসছিলেন যে হাতের কাছে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও এত বড় কথা বলতে বিন্দুমাত্র ভয় পেলেন না তিনি।
কাশ্মীরের আরেক অধিবাসী বলেন, তিনি আর নিরাপত্তা বাহিনীর ভয় নিয়ে বেঁচে থাকতে চান না।
‘স্বৈরাচারি নির্দেশ’ মানতে পারছেন না কাশ্মীরিরা
গত প্রায় তিন দশক ধরে অস্থিরতা চলছে মুসলিম প্রধান কাশ্মীর অঞ্চলে। শুক্রবার জুমআর নামাজের জন্য কারফিউ সামান্য শিথিল করা হলেও কড়া নিরাপত্তার মাঝে জামাতে নামাজ আদায় করতে গিয়ে অনেকেই এ নিয়ে অসন্তুষ্টি ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অনেকে বলেছেন, সুদূরে অবস্থিত দিল্লি সরকার একটি ‘স্বৈরাচারি নির্দেশ’ চাপিয়ে দিয়েছে কাশ্মীরবাসীর ওপর। এর ফলে কাশ্মীরের যারা কখনো আলাদা হতে চাননি তারাও কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।
সিএনএন জানায়, কাজের খাতিরে দিল্লিতে থাকা রিজওয়ান মালিক বাবা-মায়ের সঙ্গে শেষ কথা বলেছিলেন রোববার রাতে। তার পরদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বিলুপ্তির বিষয়টি সংসদে তোলেন।
সোমবার থেকে দু’দিন ধরে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে অবশেষে দিল্লি থেকে শ্রীনগরে ছুটে যেতে বাধ্য হন রিজওয়ান। ‘কাশ্মীরকে এখন খোলা আকাশের কয়েদখানা মনে হচ্ছে,’ বলেন তিনি।
লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে নয়াদিল্লিতে অবস্থানরত ১৯ বছর বয়সী সাকিব ইয়েতু সিএনএন’কে জানান, জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা হঠাৎ করে কেড়ে নেয়ার এ সিদ্ধান্ত তাদেরকে হতবাক করে দিয়েছে।
‘আমি ইতিহাসের ক্লাস করছিলাম… হঠাৎ করে এ খবরটা শুনে সাথে সাথে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি। তখনি আমি ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসি। দেখতে পাই অন্য সব কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরাও কাঁদছে। কয়েকজন জ্ঞানও হারিয়ে ফেলে,’ বলেন তিনি।
এরপর টানা কয়েকদিন সাকিব কাশ্মীরে বসবাসকারী তার বাবামায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে ব্যর্থ হয়েছেন।
ক্ষুব্ধ সাকিব বলেন, ‘ওখানে লোকজন সামরিক ব্ল্যাকআউটের মধ্যে আছে। কাশ্মীরকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সেখানকার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবন এখন কণ্ঠরুদ্ধ।’
আরও পড়ুন: ‘ঈদ করতে বাড়ি এসো না: সন্তানদের প্রতি কাশ্মীরি মায়েদের আকুতি’
নরেন্দ্র মোদির যুক্তি, ৩৭০ অনুচ্ছেদ কাশ্মীরের সঙ্গে বাকি ভারতের দূরত্ব তৈরি করে রেখেছিল।
কিন্তু ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের এ সিদ্ধান্ত কাশ্মীর ও ভারত, উভয় পক্ষের জন্যই জটিল পরিণতি বয়ে আনতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় লোকজন। এর ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে সৃষ্ট ক্ষোভ অস্থিরতা ও সহিংসতা কমানোর বদলে আরও বাড়িয়ে দেবে বলে ধারণা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদেরও।