ক্ষোভ থেকেই টেলিভিশন অনুষ্ঠান শুরু করেছিলাম: মুস্তাফা মনোয়ার
মুস্তাফা মনোয়ারের ৮৩তম জন্মদিনে চ্যানেল আইয়ের লাল গালিচা সংবর্ধনা ও তাকে নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান
বিজ্ঞাপন
‘আমাদের কালচারকে পাকিস্তানিরা এক সময় বলতে শুরু করলো এটা নাকি মুসলিম কালচার নয়। ধর্মীয় রীতি নীতি সিদ্ধ নয় আমাদের কালচার। এরকম আরো বহু কথা বলতে শুরু করলো। দেখলাম, আমাদের এখানকার লোকজনও পাকিস্তানিদের সেইসব কথা বিশ্বাস করতে শুরু করলো। এরফলে আমাদের এখানে গান বাজনা কমতে শুরু করলো। আর্ট কালচার কমতে শুরু করলো। একদম অকারণে। তখনই আমি ক্ষোভ থেকে ইচ্ছে করে টেলিভিশনে গেলাম। ভাবলাম, বাচ্চাদের জন্য কিছু একটা করতে হবে। পরে ‘নতুন কুড়ি’ নামের একটি অনুষ্ঠানও শুরু করলাম।’
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগদান করার কারণ জানিয়ে কথাগুলো বলছিলেন দেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা মনোয়ার। ১৯৩৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম নেয়া শিল্পকলার গুণী এই মানুষটির ৮৩তম জন্মদিন শনিবার। এই বিশেষ দিনে তাকে আমন্ত্রণ জানায় চ্যানেল আই পরিবার। চ্যানেল আইয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে শনিবার দুপুর সোয়া বারোটার দিকে চ্যানেল আই ভবনে আসেন তিনি। লাল গালিচা পেতে অভ্যর্থনা জানানো হয় তাকে। ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন পাপেট শোর অন্যতম এই কারিগর। এরপর অংশ নেন চ্যানেল আইয়ের নিয়মিত আয়োজন ‘তারকা কথন’ অনুষ্ঠানে। অনন্যা রুমার প্রযোজনায় অনুষ্ঠানটিতে প্রায় ১ ঘন্টার মতো জীবনের নানা সময়ের স্মৃতি উচ্চারণ করেন মুস্তাফা মনোয়ার।
শুধু তাই নয়। অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে এক ফাঁকে রঙ তুলিতে ছবিও আঁকেন দেশের গুণী এই চিত্রশিল্পী। এমনকি এক ফাঁকে তার গানের গলাও শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেন দর্শকরা। ‘তারকা কথন’ অনুষ্ঠানে এসময় উপস্থিত ছিলেন মানব জমিনের সম্পাদক ও প্রকাশ মাহবুবা চৌধুরী। ১ সেপ্টেম্বর তারও জন্মদিন। অনুষ্ঠানের শেষে কেক কেটে তাদের জন্মদিন উদযাপন করা হয়।
তার আগে অনেক স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন মুস্তাফা মনোয়ার ও মাহবুবা চৌধুরী। কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে দেশে আসার পর শিল্পাচার্য জয়নুলের পরামর্শে আর্ট কলেজে পড়ানোর দায়িত্ব নিলেও শেষ পর্যন্ত সেটা ছেড়ে তিনি যোগ দেন বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশনে। তার পেছনের কারণ জানিয়ে মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, পাকিস্তানিদের প্রতি কিছুটা ক্ষোভ থেকেই ইচ্ছে করে টেলিভিশনে যোগ দিয়েছিলাম।
বাচ্চাদের মনে যেন পাকিস্তানিদের নিষেধ বারণ বা কুপ্রভাব না পড়ে সেজন্য ছোটদেরকেই টার্গেট করেন মুস্তাফা মনোয়ার। তারা যেন পাকিস্তানিদের অমূলক কথা বিশ্বাস না করে সত্য ও সুন্দরের প্রতি সজাগ থাকতে পারে সেজন্য ‘নতুন কুড়ি’ কিংবা ‘পাপেট শো’-এর মতো অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেন মুস্তাফা মনোয়ার। সেটাই যেন পরিস্কার তার বক্তব্যে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, শিল্পকলায় বাঙালির যে অবদান সেটাতো অসাধারণ। এটাকে অস্বীকার করবো কি করে। লালন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আরো কতো কতো বাউল কবি, তাদেরকে বাদ দিয়ে, নিজস্ব কালচার বাদ দিয়ে আমি পাকিস্তানি ভাবাপন্ন হবো কেন? সেজন্য আমি পাপেটটাও তৈরি করলাম। উদ্দেশ্যই ছিলো, বাচ্চারা যেন বুঝে। অনেক বড় কথা হয়তো মানুষ বললে তারা বুঝবে না, কিন্তু পাপেটের মধ্য দিয়ে বললে তারা ঠিকই বুঝে। ওদের সাথে পাপেটের একটা সম্পর্ক আছে।
চিত্রশিল্পে স্বতঃস্ফুর্ত পদচারণা, বাংলাদেশে নতুন শিল্প আঙ্গিক পাপেটের বিকাশ, টেলিভিশন নাটকে অতুলনীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন, শিল্পকলার উদার ও মহত্ শিক্ষক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছেন মুস্তাফা মনোয়ার। ব্যক্তি জীবনে প্রাপ্তিও কম নয়। একুশে পদকসহ দেশ বিদেশের নানান সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই কিংবদন্তী শিল্পী।
ছবি: ওবায়দুল হক তুহিন
বিজ্ঞাপন