ক্রিকেট বিসর্জনের শঙ্কায় বিয়ে ভাবনা থেকে দূরে তারা
ক্রিকেটারদের বিয়ে-বাস্তবতা নিয়ে সালমা-জাহানারা-রুমানা
ক্রিকেটের পাশাপাশি প্রেম বা বিবাহিত জীবন খুব সহজেই সমন্বিত করে নিচ্ছেন ছেলেরা। বিয়ের পর খেলোয়াড়ি জীবন হয়ে ওঠে আরও গোছানো। মাশরাফী-সাকিব-তামিমরা উদাহরণ হয়েই সামনে। ক্রিকেটের জন্য তাদের বিসর্জন দিতে হয়নি সংসার গড়ার স্বপ্ন। সেখানে দেশের নারী ক্রিকেটারদের বেলায় বাস্তবতা উল্টো। ‘বিয়ে’ নামক স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করাই যেন কঠিন সালমা-জাহানারা-রুমানাদের জন্য।
বিয়ের পিঁড়িতে বসলে ক্রিকেট জীবন বিসর্জন দিতে হতে পারে -এমন শঙ্কা কাজ করে দেশের নারী ক্রিকেটারদের মাঝে। সামাজিক প্রেক্ষাপট আর কঠিন বাস্তবতা বিবেচনা করেই বিয়ের চিন্তা থেকে আপাতত দূরে আছেন জাতীয় দলের দুই তারকা ক্রিকেটার জাহানারা আলম ও রুমানা আহমেদ।
দেখতে সুদর্শনা, দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রেম-বিয়ের অসংখ্য প্রস্তাব পেসার জাহানারার জন্য অহরহই! এই গ্ল্যামারগার্ল অবশ্য দু’বার না ভেবেই ফিরিয়ে দিয়েছেন সব প্রস্তাব। সেটি ক্রিকেটের সঙ্গে থাকা ও দেশকে আরও লম্বা সময় প্রতিনিধিত্ব করার মনোবাসনা থেকেই।
‘বিয়ের প্রস্তাব তো আসে। কিছু পাগলামি(প্রেমের নিবেদন) দেখলে আসলে খুব বেশি অবাক লাগে। আমি এই জায়গায় না থাকলে হয়তো পাগলামি একটু কম থাকত। এক অর্থে ভালোও লাগে। আবার খারাপও লাগে। মাঝে মাঝে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়। শুধু দেশে না, দেশের বাইরেও। আমি খুব শক্তভাবে এসব হ্যান্ডেল করি। কারণ এখনই বিয়ে নিয়ে চিন্তা করছি না।’
‘বিয়ে আসলে আল্লাহর হাতে। যখনই তার হুকুম হবে, তখনই হয়ে যাবে। কিন্তু আদর্শ একজন জীবনসঙ্গী মিলে যাওয়া, আর যদি না মিলে, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে কনফিউশন থাকে। আমাকে যে বিয়ে করবে সে এবং তার পরিবার ক্রিকেটটা কীভাবে নেবে এসব আমাকে চিন্তা করতে হয়। ক্রিকেট নিয়ে বাইরের ছোট্ট কোনো বাধাও আমি মেনে নিতে পারব না। ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনা বা আপোষে আমি যেতে পারব না।’ বাস্তবতাটা এভাবেই সামনে আনেন ২৫ বছর বয়সী জাহানারা।
খেলোয়াড়ি জীবনে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখা থেকে জাহানারার দূরে থাকার কারণ যে অনিশ্চয়তা, সেটি গোপন কিছুও নয়। বিয়ের পর ক্রিকেট খেলতে দেবে তো পরিবার? এমন সংশয় ঘিরে থাকে বলেই আপাতত স্বপ্নকে বিসর্জন টাইগ্রেস তারকার।
‘আমাদের দলে দুজন বিবাহিত মেয়ে আছে। শুকতারা(আয়শা রহমান) ও পিংকি(ফারজানা হক)। তারা ভালো স্বামী পেয়েছে, ভালো শ্বশুর-শাশুড়ি পেয়েছে। আমার ভাগ্যে কী হবে এখনও জানি না। বিয়ে নিয়ে চিন্তা করার আগে যা আমার হাতে আছে, তা আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। পরেরটা কিন্তু আমার হাতে নেই।’
‘২-৩ বছর আগে ভেবেছি ৭-৮ বছর খেলবো, এখনও মনে হয় আরও ৭-৮ বছর খেলবো। ক্রিকেট ক্যারিয়ার আরেকটু লম্বা করতে চাই। দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে চাই। দিনে দিনে পারফরম্যান্স ভালো হচ্ছে। যদি তা ধরে রাখতে পারি ইচ্ছা আছে যতদিন ফিটনেস আছে, দেশকে ভালোকিছু উপহার দিতে পারব, খেলে যাবো।’ -স্বপ্নের পরিধী বিস্তার করেন জাহানারা।
ক্রিকেট ও সংসার একসঙ্গে চালানো খুব কঠিন, টিম টাইগ্রেসের ওয়ানডে অধিনায়ক রুমানা মনে করেন এমনটাই। তাইতো আরও কয়েকবছর খেলে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চান দেশসেরা এ অলরাউন্ডার। কিন্তু ২৭ বছর বয়সী রুমানার মা চান যতদ্রুত সম্ভব খেলা ছেড়ে সংসারী হোক মেয়ে।
‘আসলে ক্রিকেট ব্যক্তিগত জীবনকে যে ডিস্টার্ব করে না তা নয়। ক্রিকেট সবাই ভালোবাসে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো শ্বশুর-শাশুড়ি বা হাজবেন্ড চায় না তার স্ত্রী বা ছেলের বউ খেলাধুলার সাথে জড়িত থাকুক। একটা ডিস্টার্ব আসবে অবশ্যই। এখনও যখন প্রস্তাব আসে, যখন খেলাধুলার কথা জানতে পারে, তখন একটু হলেও পিছপা হচ্ছে। এটা কষ্টদায়ক। ক্রিকেটটা আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। এটার সঙ্গে কোনকিছু মেলালে হবে না। এক্ষেত্রে হাজবেন্ড যদি বাধা দেয়, আমি মানতে পারব না। জানি না তখন কেমন পরিস্থিতি হবে। আমি পরিবারকে বলি আরেকটু সময় দেয়া হোক। নিজের মন থেকেই যেন ক্রিকেট ছেড়ে দিতে পারি।’
‘যখন দেখা যায় নিজের পরিবার থেকে চাপ আসে। মা চান ক্রিকেট ছেড়ে পড়াশুনা শেষ করে যেন দ্রুত সংসার জীবনে প্রবেশ করি। পরিবার থেকে চাপ সবচেয়ে বড় চাপ। যারা নতুন এবং যাদের পরিবার এখন সাপোর্ট দিচ্ছে, তাদের অসুবিধা নেই। কিন্তু বিয়ের বয়স হয়ে গেলে চাপ চলে আসে।’
ক্রিকেট মাঠে একযুগ কাটিয়ে ফেলেছেন। অর্জনের পাল্লাটা বেশ ভারীই। বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে সিনিয়র ক্রিকেটার ও টি-টুয়েন্টি অধিনায়ক সালমা খাতুনের সব স্বপ্ন তবুও ক্রিকেট ঘিরেই। ২৮ বছর বয়সী এই টাইগ্রেস তারকার মনেও উঁকি দেয় সংসারের স্বপ্ন। তবে সেটি ক্রিকেটকে সঙ্গে রেখেই।
‘যদি আল্লাহ ভাগ্যে লিখে রাখেন, আর কেউ যদি আমাকে বিয়ে করতে চায়, হয়তো সংসার করবো। কিন্তু যা-ই করি, মাঠ ছাড়তে পারবো না। কারণ আমার কাছে মনে হয় ক্রিকেট এখন আমার জন্য খেলা নয়, দায়িত্ব। যদি দুই, তিনজন মেয়ে ক্রিকেটারও তৈরি করে দিতে পারি দেশের জন্য, মনে করবো কিছুটা হলেও আমার দায়িত্ব পালন করেছি। দেশ আমাকে যা দিয়েছে সেই ঋণ তো শোধ করতে পারবো না।’
সালমা-রুমানা-জাহানারাদের মতো বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের উজ্জ্বল পদচারণা দিনকে দিন বাড়ছে। তারা সাফল্য বয়ে আনছেন। লাল-সবুজের বয়সভিত্তিক ফুটবলে তো মেয়েদের দলের বিজয়গাঁথা একের পর এক মহাকাব্য লিখে চলেছে। আত্মবিশ্বাসী ও অকুতোভয় এই নারীরা দেশের জন্য লড়েন ক্রিকেট-ফুটবল মাঠে, অ্যাথলেটিক ট্র্যাকে সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে উঁচিয়ে ধরেন লাল-সবুজের পতাকা। তাদের সাফল্যে গর্বিত হয় পুরো জাতি। অথচ পেছনে তাদের কত ত্যাগ, কত সংগ্রাম, ক’জনইবা খোঁজ রাখেন সেসবের!