নেপালের কাঠমান্ডুতে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর সাবেক সিনিয়র পাইলট ক্যাপ্টেন সৈয়দ মোজাম্মিল হক বলেছেন, পাইলটের সঙ্গে কন্ট্রোল রুমের নির্দেশনা আরও স্পষ্ট হওয়া দরকার ছিল।
ইউটিউবে পাইলট ও বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের মধ্যকার কথোপকথনের অডিও ক্লিপ শুনে এ কথা বলেন তিনি। মোজাম্মিল বলেন, অডিও টেপটি পুরোটা তিনি বহুবার শুনেছেন। কথোপকথনটিতে দু’পক্ষের যোগাযোগের মাঝে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এই সাবেক পাইলট বলেন, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর বিশ্বের প্রথম দশটি ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দরের একটি হিসেবে বিবেচিত। এই বিমানবন্দরগুলোতে উড়োজাহাজ পরিচালনার জন্য পাইলটদের বিশেষ প্রশিক্ষণ নেয়ার প্রয়োজন হয়, বিশেষ করে যারা স্থানীয় বা নেপালি পাইলট নন তাদেরকে। এই বিশেষ প্রশিক্ষণের কাজটি সব এয়ারলাইনই করে থাকে। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি সেটা মনিটর করে।
‘নিশ্চয়ই যারা এই উড়োজাহাজটি ফ্লাই করেছেন বা দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা সবাই এই প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে গেছেন,’ বলেন তিনি।
তদন্ত শেষ হওয়ার আগে সরাসরি এ ব্যাপারে মন্তব্য না করলেও মোজাম্মিল হক বলেন, ‘যে কোনো দুর্ঘটনার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে যেগুলোকে আমরা ‘চেইন অব এরর’ বলে থাকি। এই ছোট ছোট ভুলগুলো শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনায় উপনীত হয়।’
‘অডিওতে শেষ পর্যন্ত পাইলটকে রানওয়ে টু জিরোতে অবতরণের অনুমতি দেয়া হয়েছিল এবং তিনি সেটা মেনেও নিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, অল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে এসে ল্যান্ড করার প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েকটি কাজ করার প্রয়োজন। কাজগুলো করার পর যদি মনে হয় উড়োজাহাজটি ঠিক অবস্থানে নেই এবং গতি বা আমরা যাকে বলি অবতরণের জন্য ‘রেট অব ডিসেন্ট’ ঠিক নেই, তাহলে মোটামুটিভাবে সব দিক দেখে ল্যান্ড করতে হয়। একে আমরা বলি ‘ভিজ্যুয়াল অ্যাপ্রোচ’।’
সাবেক এই বৈমানিক জানান, ভিজ্যুয়াল অ্যাপ্রোচ অনুযায়ী, অবতরণের সময় ৫শ’ ফুটের মধ্যে যদি পাইলট কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হন তাহলে কিন্তু তিনি অবতরণ না করে উড়ে গিয়ে আবার অবতরণ করার অনুমতি চাইতে পারেন।
রানওয়েতে অবতরণের ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার ব্যাপারে বিতর্কের ঘটনায় তিনি বলেন, হয়তো ভিজ্যুয়াল অ্যাপ্রোচের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে পাইলট বিভ্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন। একে বলা হয় ‘লস অব সিচুয়েশনাল অ্যাওয়ারনেস’। উড়োজাহাজ দুর্ঘটনাটির পেছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে বলে মনে করেন মোজাম্মিল হক।
এ ধরনের ক্ষেত্রে সহকারি ও সহযোগীদের কাছ থেকে সহায়তা পাইলটের খুব দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, চেইন অব এররের মধ্যে আগে উল্লিখিত বিষয়গুলো একটার পর একটা আসে। সবশেষে সিচুয়েশনাল অ্যাওয়ারনেস যখন কেউ হারিয়ে ফেলে তখনই ছোট ভুলগুলো মিলে বড় ভুলে পরিণত হয়। এক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটে থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তবে নিশ্চিত কারণগুলো তদন্তে বেরিয়ে আসবে।
এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা পিছিয়ে বলে মন্তব্য করেন ক্যাপ্টেন মোজাম্মিল। তার মতে, জরুরি প্রতিক্রিয়া বিষয়ক কন্ট্রোল সেন্টারটি সিভিল এভিয়েশন বা বিমানবন্দরের কোথাও হওয়া উচিত ছিল, যেখানে সিভিল এভিয়েশন এবং ইউএস বাংলার কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। সাংবাদিকদের ব্রিফিং আলাদা এবং আগত স্বজনদের আলাদা জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। একই সঙ্গে তাদের কাউন্সেলিং করা এবং মানসিকভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানোও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অংশ।
দুর্ঘটনাটি এড়ানো সম্ভব ছিল কিনা এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা কীভাবে ঠেকানো যায় সেটাও এখন জানার বিষয় বলে মন্তব্য করেন বিমানের এই সাবেক পাইলট।
সোমবার ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের বোমবার্ডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ৪০০ উড়োজাহাজটি ঢাকা থেকে ছেড়ে গিয়ে দুপুর ২টা ২০ মিনিটে নেপালে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণ করার সময়েই দুর্ঘটনার শিকার হয়।
উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৫০। চিকিৎসাধীন যাত্রীদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। উড়োজাহাজটিতে থাকা ৬৭ যাত্রীর মধ্যে ৩২ জন বাংলাদেশি, ৩৩ জন নেপালি, একজন মালদ্বীপের এবং একজন চীনের নাগরিক। উড়োজাহাজটিতে ৬৭ যাত্রীর পাশাপাশি ৪ জন ক্রু ছিলেন বলে ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
দুর্ঘটনায় প্রথমেই মৃত্যু হয় ওই ফ্লাইটের সহকারি পাইলট এবং ইউএস বাংলার প্রথম নারী পাইলট প্রিথুলা রশিদের। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদকে। মঙ্গলবার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ক্যাপ্টেন আবিদও মারা যান।