করোনায় অনুদান আসছে। সে অনুদানে কেউ কেউ লুণ্ঠনও করছে। করোনা সুরক্ষার পিপিই ও মাস্ক নিয়েও বাণিজ্য করতে তৎপর হয়েছে এক অসাধু চক্র। সাংবাদিকদের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসকদের বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট বাজীও চলছে। এই অভিযোগে জড়িত চিকিৎসকের গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটছে। কিছুদিন পর পর দেয়া হচ্ছে শিথিল লকডাউন, কঠোর লকডাউন। কঠোর লকডাউন আবার খুলে দেয়া হলো ১৫ জুলাই হতে ২২ জুলাই পর্যন্ত। চালু হলো বাস, ট্রেন, সিএনজি অটোরিকশা। চালু হলো গরুর হাট। বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে গরুর হাট চলবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্থল যান, জল যান, আকাশ যান সবই চলবে।স্বাস্থ্যবিধি মেনে বইমেলাও চলেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়,পরিবহন মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বিমান মন্ত্রণালয় সকলেই সময় ভেদে করোনাকালে কিছু না কিছু ছাড় দিচ্ছে। কেবল নূন্যতম ছাড় দিচ্ছেনা শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বছরের পর বছর ধরে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ছাত্র ছাত্রীরা তাদের ছাত্রত্বই ভুলতে বসেছে। এখন বলা হচ্ছে করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আগামী নভেম্বরে এসএসসি ও ডিসেম্বরে এইএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। করোনা পরিস্থিতির অনুকূলতা ও প্রতিকূলতার মূল্যায়ন কি শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয়েই, অন্যত্র নয়?
লকডাউন চালু হওয়ায় পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল হলো। করোনা ছড়িয়ে পড়লো প্রত্যন্ত গাঁয়ে। বাড়লো আক্রান্তের হার। বাড়লো মৃত্যুর হার। তবু লকডাউন খুলে দেয়া হলো। মানুষ ছুটতে লাগল শহর হতে গাঁয়ে। বাসে ট্রেনে, ফেরী ঘাটে হাটে বাজারে কোথাও স্বাস্থ্যবিধির কোন বালাই নেই। ঈদের জামাতেও হবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। এরপর ঈদের পর দিন আবার তারা ছুটবে শহরে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ছাত্র ছাত্রীদের ক্লাস করানোর সুযোগ দিলে কি তা গরুর হাটের চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তারা ক্লাস করতে স্কুলে যাচ্ছেনা কিন্তু গরুর হাটে, শপিং মলে কি বাবার সাথে যাচ্ছে না? শিক্ষকরা কি স্কুল গেটে হ্যান্ডস্যানিটাইজারের আয়োজন করে তাদের ঢুকতে দিতে পারতোনা? ক্লাস রুমে এক সিট ফাঁকা রেখে বসলে কি তা ট্রেন, বাসে বসার চেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হতো? কেন শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমন স্থবির করে দেয়া হলো?
ক্লাস না হলে শিক্ষক কর্মচারীদের কোন অসুবিধা নেই। তাদের বেতন, ভাতা ঈদ বোনাস যথারীতি বহালই আছে। এই লকডাউন তাদেরকে আরাম করার সুযোগই করে দিলো। সেনাসদস্যরা তাদের রেশন করোনাকালীন দুঃস্থ মানুষদের দিচ্ছে। কই শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষক কর্মচারীরাতো এমন একটি ঘোষণা দিতে পারলোনা যে এবারের ঈদ বোনাস ছাত্রদের ভ্যাকসিন ফান্ডে অথবা অভূক্ত মানুষদের দিয়ে দেবে। করোনায় কারও সর্বনাশ কারো পৌষমাস। মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী সকলেরই বেতন বোনাস অব্যাহত আছে। লকডাউনে অফিস বন্ধ থাকলে তাদের সুবিধাই বটে। তবে চরম অসুবিধা হচ্ছে কেবল ছাত্রদের ও শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষদের। বছরের পর বছর লকডাউন থাকলেও চাকরিজীবীদের কোন সমস্যা নেই। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন দীর্ঘমেয়াদী লকডাউনের রহস্য কি? শিক্ষকরাই যদি নিজ নিজ বিদ্যালয়ে নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী পরিচালিত করতে অসমর্থ হয় তো গরুর হাটে তা কী করে সম্ভব?
ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষাবিহীন অটো পাশ দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা কি একটি প্রজন্মকে পিছিয়ে দেয়ার অন্যতম একটি কারণ নয়? দেশেতো কোভিড ১৯ এর ভ্যাকসিনও আসছে।শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি পারতোনা দেশের সকল ছাত্র শিক্ষকদের জন্য ভ্যাকসিন উপহার হিসাবে অথবা কিনে আনতে? এখন তারা বলছে করোনা পরিস্থিতি অনুকূলে এলে নভেম্বর ডিসেম্বরে পরীক্ষা হবে। না এলে এই অবস্থাই চলমান থাকবে। করোনা যেভাবে বাড়ছে মনে হয়না এই সময় সীমায় নিয়ন্ত্রণে আসবে? তার মানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের লকডাউন চলতেই থাকবে। আর এতে সৃষ্টি হবে এক অজ্ঞ শিক্ষিত প্রজন্ম। এর দায় কার? শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড অথচ এই মেরুদণ্ডটাকে খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই দুর্বল করে দিচ্ছে। সকল মন্ত্রণালয়ই লকডাউনকে কম বেশী ছাড় দিচ্ছে কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় লাগাতার লকডাউন চালিয়েই যাচ্ছে। এর পেছনে মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা কী।

করোনা শুধু এদেশের সমস্যা নয়। এটা সারা পৃথিবীর সমস্যা। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোন কোন দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন রয়েছে।আর এই লকডাউন কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেন? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি অথবা ভ্যাকসিন সুবিধা নিশ্চিতের দায়িত্ব নিতে পারলোনা? শিক্ষার চেয়ে কি কেবল একটি ধর্মের ওয়াজিব রীতিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ? সৌদি আরবের মক্কায় বাইরের কেউ হজ্জ্ব করতে যেতে পারছেনা। অথচ কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত এই ৫ টি ইসলামের মূল স্তম্ভ। কোরবানী কোন স্তম্ভও নয়, ফরযও নয় এটি সামর্থবানদের জন্য ওয়াজিব মাত্র। অথচ মূল স্তম্ভকেই নিয়ন্ত্রিত করা হলো মুসলমানদের তীর্থভূমি মক্কায়।আর এদেশে ওয়াজিবের জন্য লকডাউন শিথিল করে মানুষকে ফেলে দেয়া হলো মৃত্যু ঝুঁকিতে। গরুর হাটে, বাসে, ট্রেনে যতোটা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে তার সিকি ভাগ ঝুঁকিও কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থাকতোনা। এখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস পরিচালনা মোটেই অসম্ভব ছিলোনা। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন এই সম্ভবটিকে বাস্তবায়িত করলো না?
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই দীর্ঘমেয়াদী লাগাতার লকডাউনে ছাত্র ছাত্রীরা ভুলেই গেছে যে তারা ছাত্র। তাদের পড়াশোনা আছে। পরীক্ষা আছে। ছাত্রবেলায় একটা কথা প্রচলিত ছিল যে, ছাত্রজীবন সুখের হতো যদি পরীক্ষা না থাকত। সেই কথিত সুখটাকেই বুঝি আজ করোনাকাল উপহার দিয়ে দিলো। কিন্তু এই সুখ সুখের নয় অসুখেরই কারণ। সেটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য সুখের হতে পারে ছাত্র ছাত্রীদের জন্য সুখের নয়। এটা ভবিষ্যতের দুঃখকেই টেনে আনবে। শিক্ষার যথার্থ অগ্রগতি ছাড়া কোন দেশ ও জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেনা। অথচ বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই শিক্ষাকেই লাগাতার লকডাউন দিয়ে দিলো। আর সে লকডাউনে লক হয়ে গেলো গোটা শিক্ষাব্যবস্থা। করোনা যদি আরও বছরও দুয়েক থাকে তবে কি এই লকটাও সে পর্যন্তই থাকবে? আর থাকলে কী হবে এই লকের পরিণতির? স্বাস্থ্যমন্ত্রী এখন বলছে, ছাত্র ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ করতে টিকার বয়স ১৮ করবে। এই কথাটা অনেক দেরিতে কেন? যাক দেরিতে হলেও বললেনতো। শিক্ষামন্ত্রীতো কিছুই বললেন না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)