শিকদার হুমায়ুন কবীর: ভালো নেই বটিয়াঘাটা উপজেলাসহ খুলনার নির্মাণ শ্রমিকরা। করোনাকালে বেকার হয়ে পড়া এই শ্রমিকরা পাচ্ছে না ত্রাণ, নেই সামাজিক সুরক্ষার আওতায়। চলছে লকডাউন, মানতে হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব। করোনা ভাইরাসের কালো ছায়ায় তিন মাস হতে চলল তারা বেকার। হাতে কাজ ও আয় না থাকায় অনেকের ঘরে খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে বিভিন্ন নির্মাণ শ্রমিকের কাছে গিয়ে তাদের বর্তমান সময়ের জীবনজীবিকা আর বেচে থাকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা প্রতিদিনের কাজের মজুরি দিয়ে সংসার চালাই। অথচ করোনা ভাইরাসের কারণে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এ অবস্থায় আমরা এক প্রকার খেয়ে না খেয়ে আছি। এভাবে আর কিছুদিন চললে পথে বসতে হবে।
ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের বটিয়াঘাটার সভাপতি নূর আলী জানান, আমাদের এই সদরে তালিকাভূক্ত শ্রমিকই আছে প্রায় সাতশো। যার মধ্যে নারী শ্রমিকই একশোর বেশি। কাজ বন্ধ থাকায় সবাই অনাহারে অর্ধাহারে কোন মতে দিনাতিপাত করছি। শুনেছি সরকার ঘরে ঘরে চাল-ডাল পৌঁছে দিচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা কেউই কোনো সাহায্য পাইনি। কেউ আমাদের খবরও নেয়নি। কারও কাছে হাত পেতে চাইতেও লজ্জা লাগে। বাধ্য হয়ে চড়া সুদে থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় পক্ষপাতহীনভাবে সঠিক সংখ্যা নির্ণয়ের মাধ্যমে আমাদের দ্রুত রেশনিংয়ের আওতায় আনলে হয়তো আমরা বেঁচে যেতে পারি। না হলে করোনায় না মরলেও না খেয়ে মরতে হবে।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জামাল চৌধুরী বলেন, আমাদের কোনো বীমা নেই। কাজের ঠিক ঠিকানা নেই। আমাদের রয়েছে নারী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ। গার্মেন্টস শ্রমিকরা আলোচনায় এলেও ইমারত নির্মাণ খাতের শ্রমিকরা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ কিছু মানুষের সাহায্য-সহযোগিতাই এখন আমাদের একমাত্র অবলম্বন। চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।
নির্মাণ শ্রমিক শামীম (২৫) জানায়, কাজের সুযোগ না থাকায় বর্তমানে বৌ-বাচ্চা নিয়ে ভীষন বিপাকে পড়েছি। আমাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরছে অনেকেই আবার অনিশ্চিত পথে গ্রাম থেকে শহরে যাচ্ছে। লকডাউনের কারণে চাইলেও ভ্যান রিক্সা চালাতেও পারছিনা। কেউ ভিক্ষাও দিতে চায় না। ফলে বর্তমানে আমরা সম্পূর্ণ বেকার।
নারী শ্রমিক মর্জিনা বেগম বলেন, আমরা দিন আনি দিন খাই বলে আমাদের কোনো সঞ্চয় নেই। কেউ আমাদের দায়িত্বও নিচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনা দেওয়ার কথা শুনলেও কোনো জনপ্রতিনিধি এখনও আমাদের খোঁজ নিতে আসেননি।
এই শ্রমিকরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের হওয়ায় তারা কোথাও যেতে পারছেন না তাদের দাবি নিয়ে। ত্রাণ দেয়ার যে তালিকা সরকার করেছে সেখানেও নির্মাণ শ্রমিকদের কোন উল্লেখ নেই বলে অভিযোগ তাদের।
নির্মাণ খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিলেও নির্মাণ খাতের শ্রমিকদের জন্য কিছুই দেওয়া হয়নি। এখনই তাদের বিকল্প কাজ অথবা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী তাদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া না গেলে করোনার মৃত্যুর চেয়ে অনাহারে মৃত্যু বেশি হবে।
দেশের উন্নয়নে নির্মাণ খাতে দৈনিক মজুুরী বা আয়ভিত্তিক শ্রমিকদের অংশই বড়। তারা আবাসন, রড সিমেন্ট কংক্রিট মিক্সিং ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, রং মিস্ত্রি, ইটভাটা, ইজিবাইক, রিক্সা চালক হিসেবে দিনমজুরীর কাজ করে।
নির্মাণ শ্রমিক রাকিব বলেন, বর্তমানে বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো একেবারেই বন্ধ। দু একটি ছোট ছোট ব্যক্তিগত ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। যেখানে দুই থেকে চারজন শ্রমিক কাজ করতে পারছেন। বাকি সবাই বেকার হয়ে ঘরে বসে রয়েছেন। এসব নির্মাণ শ্রমিকদের নামে কোনো বরাদ্দ এখনো আসেনি। তবে আমরা অতি দরিদ্র কিছু শ্রমিকের তালিকা করেছি। জেলা প্রশাসনের কাছে ওই তালিকা দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে প্রান্তিক জনপ্রতিনিধি স্থানীয় ইউপি সদস্য আলম ভুইয়া বলেন, আমরা এ পর্যন্ত দিনমজুর, ভবঘুরে কৃষি শ্রমিক পরিবহন চালক রিক্সাচালক ফেরীওয়ারা রেষ্টুরেন্ট শ্রমিকসহ প্রায় দশ ক্যাটাগরীর প্রায় ছত্রিশশো অসহায় মানুষের মাঝে আমরা ত্রাণ দিয়েছি। আবার অনেক শ্রমিক আছে যারা এখানে বাস করেও এখানকার বাসিন্দা নন। ফলে এখানকার ভোটার না হওয়ায় তাদের প্রণোদনা দেওয়া যায়নি। নেই কোন সামাজিক নিরাপত্তার আওতায়।
সরকারি তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ত্রাণের কোনো সংকট নেই। নির্মাণ শ্রমিক, বাস শ্রমিক, ভাসমান চা-স্টলসহ করোনায় বেকার হয়ে পড়া পরিবারগুলোর তালিকা করতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেই তালিকা মোতাবেক চাল ও টাকা বিতরণ করা হচ্ছে। তবে এর মধ্যে কোনো হতদরিদ্র শ্রমিক বাদ পড়লে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ত্রাণ সহায়তা পেতে পারে।