যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে
মুুক্ত করো হে বন্ধ,
সঞ্চার করো সকল কর্মে
শান্ত তোমার ছন্দ।

চরণপদ্মে মম চিত নিঃস্পন্দিত করো হে,
নন্দিত করো, নন্দিত করো,
নন্দিত করো হে।
অন্তর মম বিকশিত করো
অন্তরতর হে।
এই কবিতাংশ বাংলা ভাষায় প্রথম নোবেলজয়ী কাব্য ‘গীতাঞ্জলির’। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বতর্মানে তাকে আমরা নানাভাবে সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসা জানাই। বাংলার ঘরে ঘরে তিনি পূজনীয়। তার শব্দ, বাক্য, কবিতা ছাড়া আমরা আমাদের যাপিত জীবনের আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দু:খ কিছুই প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাইনা। যিনি তার লেখনি ও কর্মের মাধ্যমে সবাইকে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন। পারেননি। তাকেও পদে পদে লাঞ্চিত, বঞ্চিত, অপমানিত হতে হয়েছে। ঔপনিবেশিকদের তোষামোদি করে নোবেল পেয়েছেন প্রমাণসমেত সেই সংবাদ ছাপা হয়েছে। সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় তার চন্ডিপাঠ করেছে অনেকে। শান্তি নিকেতনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে নোবেল পদক নিলামে তুলতে চেয়েছিলেন। তারপরও তিনি সকল কর্মে শান্ত ছন্দের কথা বলেন। প্রেমে ও প্রানে সবাইকে যুক্ত করার প্রয়াশ ছিলো তার।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বিশ শতকের গোড়ায় বাংলার ভগিনীদের শিক্ষিত করবেন, স্বনির্ভর করবেন, পুরুষের বালিশের কাভার না বানিয়ে চন্দ্র-সূর্যের দৈর্ঘ্য মাপার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করবেন। বিনিময়ে কোলকাতার তারিনীভবনে তার আশ্রমে ঢিল পড়েছিলো। সমাজে তাকে নিয়ে হেন নেতিবাচক আক্রমণ নেই হয়নি। তবু তিনি হাল ছাড়েননি। বেদনাহত হয়েছেন মূর্খতায়, অজ্ঞানতায় হৃদয়ে রক্তক্ষরন হয়েছে। তবু ঘৃণা করেননি কাউকে। হাল ছেড়ে দেননি। নারী আন্দোলনের অগ্রপথিক তাই আজ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মুহাম্মদ (সাঃ)। এক বুড়ি প্রতিদিন তার পথে কাঁটা বিছিয়ে দিতো। তিনি কাঁটা সরিয়ে পথ চলতেন। বুড়ি আনন্দ পেতো। একদিন পথে কাঁটা নেই। মুহাম্মদ খোঁজ নিলেন। বুড়ি অসুস্থ। তার বাড়িতে গিয়ে সেবা করলেন। ভালোবাসার শক্তিতে কাঁটা দেয়া বুড়ির হৃদয় জয় করলেন।
কবি ইকবাল। আল্লাহকে প্রশ্ন করে ‘শিকওয়া’ লিখলেন। মোল্লারা তাকে কাফের ঘোষণা করলো। কদিন পর লিখলেন ‘জওয়াবে শিকওয়া’। একই মোল্লারা তাকে আল্লামা উপাধি দিলো।
নজরুল রীতিমতো বিদ্রোহ করেছিলেন। একদিকে শ্যামাসঙ্গিত রচনা করলেন। হিন্দু নারী বিবাহ করলেন। আবার হামদ নাত লিখলেন। তার গান ছাড়া বাঙ্গালি মুসলমানের রোজার ঈদের আনন্দই শুরু হয় না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক বুক ভালোবাসায় সবাইকে নিয়ে সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। তীব্র ঘৃণায় তাকে পরিবারসমেত হত্যা করা হয়।
করোনাকালের মৃত্যু: শবমিছিলে ঘৃণার চাষ
দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর আরো অনেকের মতো তিনজন বহুল পরিচিত, সম্মানিত, প্রশংসিত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। প্রতিটি মৃত্যুই গভীর বেদনার। যারা তাদের প্রিয়জন হারায় তাদের কাছে তিনি সবচেয়ে প্রিয়,সর্বোচ্চ গুরুত্বের। আবার কিছু মানুষ তাদের সৃজনশীলতায়, কর্মে, ধ্যানে ও জ্ঞানে নিজ পরিবার ছাড়িয়ে সবার হয়ে যায়। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও আকাশসম হয়ে পড়ে। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. আনিসুজ্জামান এবং মোহাম্মদ নাসিম তেমন ব্যক্তিত্ব। ড. জামিলুর রেজা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মানুষ ছিলেন। বতর্মান সরকারের মেগা প্রকল্পের অন্যতম পরামর্শক। রাজনীতির সাথে তার সংশ্রব ছিলো না। মৃত্যু পরবর্তী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনতার ‘এসিআরে’ (বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য তৈরী হয়) খুব বেশি ঘৃণার স্বীকার হননি। আনিসুজ্জামান বেশ দুর্ভাগা। পুরো জীবন শান্ত নদীর মতো বাংলাভাষায় দুকূল উর্বর করে জ্ঞান ও কর্মে উদীপ্ত ছিলেন।সংবিধানের বাংলা ভাষ্য তার তৈরী। মৃত্যু পরবর্তী তার প্রতি ঘৃণার বর্ষণ হয়েছে। সমালোচনা হয়তো প্রাপ্য ছিলো। ঘৃণা নয়। তবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন মোহাম্মদ নাসিম। চার নেতার অন্যতম কাপ্টেন শহীদ এম মনসুর আলীর সন্তান। আওয়ামী রাজনীতি করতেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। সংসদীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। ৬ বারের জনপ্রতিনিধি। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে রাজপথে পুলিশি নির্যাতনের স্বীকারও হয়েছেন। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বতর্মান করুণ দশার জন্য দায় হয়তো তারও আছে। কিন্তু মৃত্যুকালে তাকে সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে একতরফা বিচারে শাস্তি দেয়া হলো এ বড় নির্মম, নৃশংস ও অমানবিক।
পিতার পৈতা ধরে মেরো না টান
আমাদের পূর্ব পুরুষ আমাদের পিতা। পিতার সাথে মতের অমিল হতে পারে, বিতর্ক হতে পারে, পথও ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। তাই বলে পিতাকে অপমান করা রীতি ও নীতি বিরুদ্ধ। প্রতিটি ধর্মই এই চর্চাকে নিরুৎসাহিত করে। একটি মানুষের পুরো জীবনের খন্ডিত অংশকে পূর্ণ রূপ ধরে নিয়ে পূর্ণ মতামত প্রকাশের চলমান অস্থিরতা চারিত্রিক তারল্যেরই বহিঃপ্রকাশ। যেকোন তরল মাত্রই নিজস্ব আকারহীন।
অস্বীকার করার উপায় নেই ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয়ভাবে দীর্ঘদিন ঘৃণার চর্চাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ‘তুমি আমার সাথে একমত হও অথবা তুমি আমার শত্রুর’ মতো বুশীয় নীতিতে ভিন্ন মতের টুটি চেপে ধরা চেষ্টা আছে। স্বাভাবিক বিচারের পথ রুদ্ধ হওয়ায় মানুষের ক্ষোভ প্রশমনের স্থান সংকুচিত। কোন একক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি এমন হয়নি। সম্মিলিতভাবে একটি ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে টেনে নেয়ায় ক্ষমতাবানদের দায় বেশি। অন্যদেরও কম নয়। যেহেতু বৃহত্তর জনগণ পুরো ব্যবস্থাকে তাদের কল্যানে পাচ্ছে না। আবার নির্মম এই কাঠামোর বলি হচ্ছে প্রতিদিন। তখন তার মধ্যে ব্যক্তি জিঘাংসা চরম রূপ নিয়েছে। মৃত্যুতে উল্লাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে রূপের এমন আনুষ্ঠানিক প্রকাশ কষ্টের, বেদনার এবং ইঙ্গিতবাহি।
তারুণ্যের শক্তি: অস্থির মতামতে শক্তির অপচয়
তরুণরা তাদের স্বাভাবিক ধর্মে কিছুটা বিপ্লবী। আগ-পিছ না ভেবে কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তিকে কাজে লাগায় রাষ্ট্র। আমাদের তারুণ্য তার অস্থিরতাকে প্রশমন করছে সকাল-বিকাল সামাজিক মাধ্যমে অবিমৃষ্য মতামত প্রকাশে। যে কোন বিষয়ে মতামত জানাতে দীর্ঘ পর্যবেক্ষন লাগে। পুরো চিত্রকে বাজপাখির দৃষ্টিতে দেখতে হয়। অনেক ফেইসবুক সেলিব্রেটিকে দেখা যায় যারা তাদের সকালবেলার মতামত বিকেলে ক্ষমা চেয়ে মুছে ফেলেন। কেউ তাকে চাপ দেয় তা নয়। নিজেই বুঝতে পারেন। গুজবে চোখ দিয়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে সংক্ষিপ্ত বাক্যে উত্তেজক মতামত প্রকাশের অস্থিরতার ইঁদুর দৌঁড়ে তিনি মারাত্মক ভুল করেছেন। লিখার পূর্বে যদি একটু ধৈর্য্য, নিরব সহ্য, খানিক বিশ্লেষণ ও গভীর চিন্তা করতেন তবে এমন হতো না সেটি তিনি দেরিতে বুঝতে পারেন।
মনে রাখতে হবে, যিনি ঘৃণা ছড়ান তারও ঘৃণার চর্চা করতে হয়। একই বিষে নিজেকেও নীল হতে হয়। যিনি ভালোবাসার চর্চা করেন, নিজের মাঝেও কোমল প্রেমের ফল্গুধারা তিনি বাড়িয়ে নেন।
ঘৃণার পরিবর্তে ক্রিটিকের চর্চা
ইংরেজী ‘ক্রিটিক’ এর আক্ষরিক অর্থ সমালোচনা। সাধারণত সাহিত্যিক সমালোচনাকে ‘ক্রিটিক’ বলা হয়। ক্রিটিক মানে শুধু নেতিবাচক বাক্য নয়। যেকোন রচনার শিল্পগুণ বিচার করে সবলতা ও দূর্বলতা তুলে ধরা। মানুষ ফেরশতা নয়। সেটি কাম্যও নয়। ক্রিটিকের চর্চা করলে পুরো চিত্র জানতে হয়, সমালোচনা হয় ভারসাম্যপূর্ণ। কোন ভগ্নাংশ নয়, পুরো জীবনের সবলতা ও দূর্বলতা দিয়ে যে কারো প্রশংসা করি, মতকে খন্ডন করি, সমালোচনায় মুখর হই। তবু ঘৃণায় নয়, ভালোবাসায় বাঁচি ।
গৌতম বুদ্ধকে প্রতিদিন একটি লোক মন্দ কথা বলতো। বুদ্ধ মুচকি হেসে চলে যেতেন। টানা সাতদিন গালিগালাজের পরও কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে লোকটি তার পথরোধ করে। ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করে, আপনি কি বলেন তো। আপনাকে এত কটু কথা বললাম আপনি একটুও ক্ষুব্ধ হলেন না কেনো!
গৌতম বুদ্ধ হেসে বললেন, মনে করো তুমি কারো বাসায় বেড়াতে গেলে। সেখানে আপ্যায়নের জন্য তোমাকে কিছু আহার দেয়া হলো। তুমি যদি সেটি গ্রহণ না করো তবে সেগুলোর কি হবে?
লোকটি বললো, ঐ বাড়িতেই রয়ে যাবে।
গত সাতদিন ধরে তুমি আমায় বিচিত্রভাবে আপ্যায়ন করানোর চেষ্টা করেছো। আমি গ্রহণ করিনি। তোমার আপ্যায়ন তোমার কাছে রইলো। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
নন্দিত মানুষ মাত্রই সমকালে কিছুটা নিন্দিত হয়। নিন্দার চর্চায় নন্দিত হওয়ার চেষ্টা বৃথা। কবি নজরুলের মতো সাম্য, মৈত্রী ভালোবাসার জয়গান হোক জীবনের স্লোগান।
‘উহারা চাহুক সকীর্ণতা,ডোবার ক্লেদ,
আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক প্রেম অভেদ।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
