Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

এবারের বাজেটে চরের মানুষের উন্নয়নে বরাদ্দ নেই

১ জুন বুধবার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হয়েছে। এদিন জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেন বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। ২০১৭-১৮ অর্থ বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ এক বাজেট। বাজেট নিয়ে চারদিকে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বাজেটের কিছু কিছু বিষয় নিয়ে জনমানসে এক ধরনের আতঙ্কও তৈরি হয়েছে। সরকারি দলীয় এমপিরাও সে সব বিষয় নিয়ে মহান সংসদে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের খাতভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ সব পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে মানব সম্পদ উন্নয়ন, ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন, যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন, জনকল্যাণ, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও বাণিজ্য, আঞ্চলিক সহযোগিতা, পরিকল্পিত নগরায়ন ও আবাসন, তথ্য-সংস্কৃতি, ধর্ম, যুবক্রীড়া, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন খাত। এসব খাতের মধ্যে দিয়ে বড় বড় পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।

যেখানে মূল লক্ষ্যই হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় আনা।
কিন্তু এবারের বাজেটে চরাঞ্চলের প্রায় এককোটি অসহায় মানুষের উন্নয়নে একটি টাকাও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এ ধরনের কোনো দিক নির্দেশনাও নেই। সামাজিক সুরক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন অংশের কোথাও চরাঞ্চলের মানুষের আর্থিক সামাজিক উন্নয়নে সরকারের কোনো পরিকল্পনার কথা চোখে পড়েনি। অথচ বাজেটে পিছিয়ে পড়া অনেক প্রান্তজনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্যেই সুনির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ ও পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে।

দেশের চরাঞ্চলের মানুষ অনেক আগে থেকেই ভীষণ রকম উন্নয়ন বঞ্চনার শিকার। সংবিধানে যে সব মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে চরবাসীর জীবনে তার প্রতিফলন বা বাস্তবায়ন কিছুই নেই। খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা-সবখানেই চরবাসী পিছিয়ে। এই পিছিয়ে থাকার বহুবিধ কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো-প্রতিনিয়ত নদীভাঙ্গন, বন্যা, চরম যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, সম্পদহীনতা এবং সরকারি সেবার অপ্রতুলতা। চরে বসবাসরত মানুষগুলো যেনো বরাবরই সরকারের একদম দৃষ্টির বাইরে বাইরে রয়েছে। যেনো এই মানুষগুলো সম্পর্কে ভাববার, দেখবার কোনো কিছুই করার নেই।

সরকার বলছে উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ। দ্বিমত করার উপায় নেই। কারণ বর্তমান সরকারের আমলে যতসব মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে এর আগে তা কখনই নেওয়া হয়নি। অনেক দৃশ্যমান উন্নয়নই আগে ছিল আমাদের কল্পনার বাইরে। কিন্তু এই সরকারের আমলে অনেক অসাধ্যই সাধন হয়েছে। কিন্তু উন্নয়য়ে বাংলাদেশ মহাসড়কে থাকলেও চরাঞ্চলের এক কোটি মানুষ এই সহাসড়কের যেনো কোথাও নেই।

অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতায় চরাঞ্চলের উন্নয়নে নিজের আগ্রহ ও আত্মপ্রত্যয়ের কথা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছেন। কখনও কখনও নির্দেশনাও দিয়েছে। কিন্তু তার বাস্ত প্রতিফলন লক্ষণীয় নয়। চরাঞ্চলে এখন যা কিছু হচ্ছে সেটা স্থানীয়াবেই হচ্ছে। অর্থাৎ চরের মানুষ তার লোকায়ত জ্ঞানকে পুঁজি করেই এগিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠনগুলো যতোটুকু সহযোগিতা করছে এই যা। কিন্তু সেখানে সরকারি সহায়তা-সহযোগিতা একেবারেই কম। ফলে চরের মানুষের যাপিতজীন আর জীবনমানে যে খুব বড় ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তা বলা যাবে না।

চরের মানুষ এক অর্থে প্রায় সবধরনের সেবাপ্রাপ্তি থেকেই বঞ্চিত। দুর্গম অবস্থানে বসবাস করার কারণে কেউ-ই যেনো তাদের পাশে দাঁড়াতে চায় না, তাদের খবরও রাখতে চায় না।
চরের মানুষ মূলত কৃষি এবং নদী নির্ভর। কৃষি কাজ, মাছ ধরা তাদের প্রধান পেশা। চরের মানুষ প্রায় সবধরনের সেবা থেকেই বঞ্চিত। তাদের একটা বড় অভিযোগ তারা সরকারি-বেসরকারি কোনো ঋণ সহায়তাই ভালো করে পান না। বিশেষ করে যারা দূরে দুর্গম চরে বসবাস করে থাকে তারা সরকার বা এনজিও কোনো সংস্থা থেকেই ঋণসেবা পান না।

ঋণসেবা না পাওয়ার কারণে তারা কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পুুঁজি প্রবাহ বাড়াতে পারে না। ঋণ না পাওয়ার কারণে ফসল উৎপাদনসহ বিভিন্ন উৎপাদনমূলক কাজে তারা বাধাগ্রস্থ হয়। চরাঞ্চলের মানুষেরা বহু আগে থেকেই এই সুবিধা প্রাপ্তির জন্য দাবি তুলে আসছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।

এ কথা সত্য যে, কৃষি মৌসুমে যদি চরাঞ্চলে কৃষক-কৃষানীদের জন্য সহজশর্তে ঋণ ব্যবস্থা করা যেত তাহলে নিশ্চিত চরের কৃষকেরা আরও বৈচিত্র্যময় সব ফসল উৎপাদন করতো। বলতে দ্বিধা নেই দেশের চরগুলো আমাদের কৃষির অন্যতম এক শক্তি। চর থেকে উৎপাদিত ফসল আমাদের খাদ্য চাহিদার এক বড় অংশ পূরণ করে থাকে। কেননা চরে মরিচ, পেঁয়াজ, বাদামসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি ও ফসলাদি চাষবাস করা হয়। অনেক চরে এখনও ভেষজও চাষবাস করা হচ্ছে। আবার তিস্তা বালু চরে ব্যাপকভিত্তিতে কুমড়ো, স্কোয়াশের চাষ এখন রীতিমতো বিস্ময়কর এক ঘটনা হযে দাঁড়িয়েছে।

প্রতি বছর তিস্তার চরে হাজার হাজার টন কুমড়ো উৎপাদিত হচ্ছে। আবার যমুনার চরে এখন ধনিয়া, জাউন, কালোজিরাসহ বিভিন্ন মশল্লার চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কুড়িগ্রামের চরগুলোতে একই সঙ্গে পাঁচ ধরনের ফসল চাষ নতুন উদ্দীপনা তৈরি করেছে।

আবার পদ্মা, যমুনা চর এখন মাংস ও দুধের অন্যতম উৎস। এসব কারণে কৃষি বিশেষজ্ঞগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের চরভূমিকে ‘হিডেন ডায়মন্ড’ বলেও অভিহিত করা হচ্ছে। কিন্তু চরাঞ্চলের কৃষিভূমি নিয়েও এখন পর্যন্ত খুব একটা গবেষণা হয়নি। কোন চর বা চর সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহে কোনো ধরনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়েও তোলা হয়নি।
চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা স্যানিটেশনের অবস্থাও যা-তা। স্বাস্থ্যসেবার কথা বললেই স্থানীয় নীতি-নির্ধারকরা কমিউনিটি ক্লিনিক আছে বলে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করেন।

অথচ এখনও তুলনামূলক চরাঞ্চলেই মাতৃমুত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এর অন্যতম কারণ হলো চরাঞ্চলে থেকে হাসপাতালগুলোর অবস্থা অনেক বেশি দূরে। এ ছাড়া দ্রুত হাসাপাতালে আসার জন্য কোনো ধরনের পরিবহনের ব্যবস্থা থাকে না। অনেক চরেই এখনও বিশুদ্ধ পানির সংকট লক্ষণীয়।

চরাঞ্চলের প্রাথমিক স্কুলগুলোর অবস্থা বরাবরই করুণ। দূরবর্তী অবস্থানে থাকায় সরকারি কর্মকর্তারাও সেখানে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। বেশিরভাগ স্কুলে প্রক্সি শিক্ষক বা বর্গা শিক্ষকেরা ক্লাস নেন। চরের অনেক শিশু স্কুলেও আসে না। আবার বন্যার সময় নৌকাভাড়া অতিরিক্ত হলে বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া থেকেই বিরত থাকে। চরের প্রাথমিক স্কুলগুলো বহু আগে থেকেই এভাবে চলমান রয়েছে। কিন্তু এখানে শিক্ষামান উন্নয়নের জন্যে আলাদা কোনো পরিকল্পনা নেই।

এদিকে চর যে মানব সম্পদ রয়েছে তাদের উন্নয়নে কোনো ধরনের পরিকল্পনায়ই লক্ষণীয় নয়। চরে এমনিতেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। কৃষি মৌসুমের পর বেশিরভাগ মানুষের এক ধরনের বেকার জীবনযাপনই করতে হয়। হাতে তেমন কোনো কাজ থাকে না। অনেকেউ তাই কাজের খোঁজে শহরে ছুটে আসে। কিন্তু চরের বেকার তরুণ-তরুণীদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে তারাও দক্ষ জনবল হিসেবে গড়ে উঠতে পারতো।

আসলে চরের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে, সরকারের পক্ষ থেকে বড় ধরনের উদ্যোগ ও পরিকল্পনার প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে যদিও দৃঢ়তার সাথে বলা হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনে তাদের চেয়ে ভাল পদক্ষেপ আর কেউ গ্রহণ করেনি, কিন্তু এটাও সত্য অনেকেই আবার উন্নয়ন বঞ্চনার শিকারও হয়ে আছে।

চরের মানুষকে সামাজিক, অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই তাদের দিকে একটু বেশি নজর দিতে হবে। এর আগে আমরা দেখেছি বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার পর কোনো টাকাই খরচ করা হয়নি। অর্থবছরে ২০১৪-১৫ অর্থবছর এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আবারও চরবাসীর উন্নয়নে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা বাজেট বই-এর পাতাতেই থেকে যায়, চরের মানুষের হাতে এক টাকাও পৌছায়নি।

আসলে চরের মানুষের উন্নয়নে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কথাও এখন সরকারকে ভাবতে হবে। যে কথা ৭ জুন জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেছেন জয়পুরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগ নেতা আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন। তিনি বলেছেন, উন্নয়ন বঞ্চিত চরবাসীকে এগিয়ে নিতে হলে চর উন্নয়ন বোর্ড বা চর ফাউন্ডেশনের মতো একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে। যে কাঠামোটি চরের মানুষের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করবে।

বাংলাদেশের চর আর চরের মানুষগুলোকে অবহেলার চোখে দেখার কোনো সুযোগ নেই। জাতীয় বাজেটে বরাদ্দসহ বঞ্চিত, অবহেলিত চরবাসীর জীবনমান উন্নয়নে সঠিক, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

Exit mobile version