চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Nagod

এক মুচির কথায় যেভাবে আজকের কৈলাস সত্যার্থী

KSRM

চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাতকারে কৈলাস সত্যার্থী বলেছেন, মানুষের ধারণা হাড়ভাঙা কাজ করার জন্যই গরিবের ঘরে শিশুদের জন্ম হয়। সেটা তিনি মানতে পারেন নি বলেই বাচপান (শৈশব) বাঁচাও আন্দোলন গড়ে তোলেন।

ওই আন্দোলনের সাফল্য গতবছর তাকে শুধু শিশু শিক্ষা অধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাই’র সঙ্গে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারই এনে দেয়নি, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন কৈলাস সত্যার্থী।

Bkash July

খাদ্য নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিতে গত সপ্তাহে তিনি ঢাকা সফর করেন। সেসময় চ্যানেল আই ভবনে ঘণ্টাদুয়েক ছিলেন তিনি। চ্যানেল আই কর্মীদের সঙ্গে নানা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার পাশাপাশি বিশেষ একটি সাক্ষাতকারও দেন। চ্যানেল আইয়ের পক্ষে তাঁর সেই সাক্ষাতকার নিয়েছেন ইংরেজি দৈনিক দ্যা ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনাম।

সাক্ষাতকারের পুরো বিবরণ:

Reneta June

মাহফুজ আনাম: কৈলাস সত্যার্থী। আপনাকে চ্যানেল আইয়ে স্বাগত জানাতে পেরে আমরা ভীষণ গর্বিত। বিশ্বজুড়ে নোবেলজয়ীরা আছেন আমরা সবাই জানি। কিন্তু আপনি শিশু অধিকার ইস্যুতে যে কাজ করেছেন তা এক অনন্য মাত্রায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের সকল শিশুর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আবারও আপনাকে চ্যানেল আই স্টুডিও-তে স্বাগত জানাই। আপনার জানা-অজানা গল্পগুলো আমাদের দর্শকরা জানতে পারবে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, সে আশা করছি।

প্রথমেই জানতে চাইবো, শিশু শ্রম নির্মূল করতে এবং শিশু অধিকার নিশ্চিত করতে এই মুহূর্তে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

কৈলাস সত্যার্থী: রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব প্রধানতম সমস্যা। রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের তালিকায় শিশুরা নেই বললেই চলে- এটি পুরো বিশ্বের চিত্র এবং জাতীয় পর্যায়েও এর ব্যতিক্রম নেই। অন্যান্য ইস্যুগুলোতে মনোযোগ দেয়া হয় বেশি। আর এটি ঘটছে বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীতে প্রায় ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিশু কোনো না কোনোভাবে শিশু শ্রমের শিকার। এর ভেতর ৮ কোটি ৫০ লাখ শিশু পতিতাবৃত্তির মত দাসত্বের শেকলে বন্দী।

মা. আ. ৮ কোটি ৫০ লাখ শিশু?

কৈ.স. জ্বি, সংখ্যাটি সেরকমই। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছে এসব শিশু। এবং এই শিশু শ্রমের ধরণগুলো ভয়ংকর এবং অমানবিক। বলতে পারেন শিশু শ্রমের বেআইনি এবং সর্বনিকৃষ্ট ধরণগুলোর সাথে এই সংখ্যক শিশু জড়িত। এটি অবশ্যই একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। আর একটি চ্যালেঞ্জ হলো সমাজের মানসিকতা। আমরা ধরেই নিই আমাদের সন্তানরা বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। আর যখনই আমরা প্রান্তিক শিশুদের কথা ভাবি, তখন আমরা বলি, ওরা তো দরিদ্র। ওদের তো কাজ করার জন্যই জন্ম হয়েছে। ঠিক আছে, আমরা তাদের সাহায্য করব। শিশু সম্পর্কে এরকম দ্বিমুখী মানসিকতাও কিন্তু একটি বড় ইস্যু। পৃথিবীর সব শিশুকেই আমাদের নিজেদের সন্তান ভাবতে হবে।

মা.আ. আপনি যা বললেন, তা কি আদৌ সম্ভব?

কৈ. স. কেন নয়? আমি যখন শিশু দাসত্ব এবং শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম শুরু করি ভারতে, এবং তারপর যখন এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এবং তারপর পুরো বিশ্বে, তখন এই ইস্যুটিকে কেউ কোন ইস্যুই মনে করতো না। মানুষের ধারণা ছিলো গরীবের ছেলে-মেয়ে তো কাজ করবেই। এর মধ্যে খারাপের কী আছে? এটিই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমি আমার মনকে সান্তনা দিতে পারছিলাম না। আমি কখনোই একমত হতে পারছিলাম না এই মানসিকতার সাথে। আমি চেষ্টা করছিলাম কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।

আমি আমার আশেপাশের পরিচিতদের মাঝেও এই ইস্যুগুলো শেয়ার করছিলাম। খুব সহজ ছিলো না এই বিষয়গুলো আলোচনা করা। যখন এটি কোন ইস্যুই ছিলো না সমাজে, তখন এরকম অমানবিক ইস্যুটি সবার নজরে নিয়ে আসাটা ছিলো খুব কঠিন। পুরো মানবতা যেখানে ছিলো বিপর্যয়ে। এটি ছিলো ‘শৈশব হত্যা’র শামিল যা কখনোই মেনে নেয়ার মতো নয়। এ বিষয়টি সবাইকে অবগত করা ছিলো খুব কঠিন। ধীরে ধীরে গণমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা, জনগণ, সরকারের নজরে আসলো এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি। শুধু ভারতেই নয়, পুরো বিশ্বে সবাই গুরুত্ব দেয়া শুরু করলো শিশু অধিকারের বিষয়টিকে। আমাদের দাবি ছিলো সবার জানা উচিত কতো সংখ্যক শিশু শ্রমিক কিংবা দাস হিসেবে কাজে নিয়োজিত আছে। কোনো তথ্য-উপাত্ত ছিলো না সে সময়। গেলো বিশ বছর ধরে এই চিত্রের পরিবর্তন হয়েছে। যখন প্রথম ষোল থেকে সতেরো বছর আগে আমরা জানতে পারি সারা বিশ্বে ২৬ কোটি শিশু শ্রমিক আছে, সে তথ্যটি ছিলো ভয়ংকর। এখন এই সংখ্যা নেমে এসেছে ১৬ কোটি ৮০ লাখ-এ।

মা.আ. প্রায় দশ কোটি কমেছে…

কৈ. স. জ্বি। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক অর্জন নিঃসন্দেহে। যে সংখ্যাটি ক্রমেই বেড়ে চলেছিলো, সেটি খুবই দ্রুততার সাথে নীচে নেমে এসেছে। একইসাথে স্কুলের বাইরে থাকা শিশুর সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৩ কোটি-তে। এখন এর সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে।

মা.আ. পরিবর্তন এসেছে…

কৈ. স. অবশ্যই। আমি পুরো আস্থাশীল আরও পরিবর্তন আসবে অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে আরও দ্রুততার সঙ্গে।

মা.আ. একজন ইঞ্জিনিয়ার থেকে কীভাবে আপনি একজন শিশু অধিকার কর্মী হয়ে উঠলেন? এ প্রসঙ্গে আপনার কোনো বিশেষ স্মৃতি, কোনো ঘটনার কথা কী মনে পড়ে?

কৈ. স. হুট করেই তো কিছু হয় নি। ধীরে ধীরে আমার ভেতর পরিবর্তন এসেছে।

মা.আ. যখন আপনি চাকরি ছাড়লেন তখন তো আপনি ২৬ বছরের এক টগবগে যুবক, তাই না?

কৈ. স. ঠিকই বলেছেন। কিন্তু শিশুদের জন্য কিছু করার মানসিকতা তৈরি হয় আমার স্কুলের প্রথম দিন থেকেই। সেই ইচ্ছার বীজ রোপিত হয় সেদিনেই। আমার বয়সের একটি ছেলেকে আমি স্কুলের বাইরে বসে থাকতে দেখি। ওই ছোট ছেলেটি ছিল একজন মুচি। ওর বাবা’ও ছিলো সাথে। দুজনেই কাজ করছিলো। আমি সরাসরি ছেলেটির বাবার কাছে যাই। জিজ্ঞেস করি, বাবু জি আপনি আপনার ছেলেকে স্কুলে পড়াচ্ছেন না কেন? এতে সে বিব্রত হয়ে উল্টো আমাকেই বলে, না না…আমাকে বাবু জি বলে ডাকবেন না। আপনিই তো বাবু জি।

তখন আমি বুঝতে পারি তিনি এমন ব্যবহার করছেন কারণ তিনি তথাকথিত নীচু জাতের। তিনি আরও বলেন, বাবু জি আপনি জানেন না, আমাদের জন্মই হয়েছে কাজ করবার জন্য। এ কথা কেনো তিনি আমাকে বলেছেন? কারণ তার জন্ম একটি নীচু জাতের ঘরে। এই কথাটি একদমই মেনে নেয়ার মতো ছিলো না। এখনও আমি তা মেনে নিতে পারি না। মাত্র পাঁচ বছর বয়সের সেই ঘটনাটি আমাকে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ করে। এখনও সেই ক্ষুব্ধতা মন থেকে মুছে যায় নি। আমার মনে হয়েছে, কেনো পৃথিবীতে কিছু মানুষের শৈশব, স্বাধীনতা, স্বপ্ন, বিসর্জন দিয়ে আমাদের মতো মানুষদের জন্য কাজ করে যেতে হবে? কেনো? এটি আমি কখনোই মেনে নিতে পারিনি।

মা.আ. সেই পাঁচ বছর বয়সেই আপনি একেবারেই ভিন্ন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

কৈ. স. আমি ধন্যবাদ জানাই সেই ছোট ছেলেটিকে। আপনি আমাকে কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশের শিশুদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। আমিও বাংলাদেশী শিশুদের প্রতি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশি শিশুদের সাথে আমি গ্লোবাল মার্চে বের হয়েছিলাম এবং ঘুরেছিলাম বিশ্বের ৪০টি দেশ বাংলাদেশী শিশুদের সঙ্গে। তারা এখন নিজেরাই বাবা-মা হয়েছে। আমার সাথে তাদের কিছুক্ষণ আগে দেখাও হয়েছে।

মা.আ. গ্লোবাল মার্চ সম্বন্ধে জানতে চাই আপনার কাছে।

কৈ. স. প্রথম এই মার্চ (পদযাত্রা) শুরু করি ভারতে, এরপর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। ১৯৮৯ সালে শিশু দাসত্বের বিরুদ্ধে গঠন করি সাউথ এশিয়ান কোয়ালিশন অন চাইল্ড সার্ভিটিউড। তখন আমি অনুধাবন করি, এই সমস্যাটি শুধুমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার নয়। এই সমস্যাটি পুরো বিশ্বের- আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের। এই অঞ্চলে ভূ-রাজনীতি এবং ভূ-অর্থনীতি শিশুদের ভাগ্যে বিরাট প্রভাব রাখে- নেতিবাচক এবং ইতিবাচক, দু’ভাবেই। সে প্রেক্ষাপটে আমি চিন্তা করি বিশ্বব্যাপী সচেতনতা গড়ে তোলার। মহাত্মা গান্ধী- কে আমি অনুসরণ করেছি। একইসাথে পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বৈপ্লবিক সামাজিক আন্দোলনগুলোও আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছে। তখন আমি লং মার্চের পরিকল্পনা করি।

একইসাথে তিনটি লং মার্চ শুরু হয়- একটি ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে, দ্বিতীয়টি সাউথ আফ্রিকা কেপ টাউন থেকে, আর অন্যটি ফিলিপিনস্-এর ম্যানিলা থেকে। এসব মার্চে উপস্থিত ছিলো বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের শিশুরা। একই সময় আমরা এই মার্চ শুরু করি। ছয় মাসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আমরা হেঁটেছি ৮০,০০০ কিলোমিটার। মাত্র একটি প্লেন-যাত্রা ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপে। বাকি সব গন্তব্যে আমরা হেঁটে গিয়েছি। ছয় মাস সময়ে আমরা ১০৩ টি দেশে লং মার্চ করতে পেরেছি। এটি শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে রূপ নেয়। ছয়জন বাংলাদেশী শিশু ছিলো আমার সাথে।

মা.আ. শিশুশ্রম যে ধীরে ধীরে কমে আসছে সে বিষয়ে আপনি আমাদের ইতিবাচক তথ্য দিলেন। একইসাথে যেসব শিশু দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ, তাদের সংখ্যাও কমছে। স্কুলে আরও বেশি শিশু যাচ্ছে। এসবই ইতিবাচক। বিশ্বব্যাপী মার্চ ছাড়া এই পরিবর্তনের পেছনে আর কী কারণ থাকতে পারে? সরকারের সদিচ্ছা’ও কি একটি কারণ এই ইতিবাচক পরিবর্তনের পেছনে?

কৈ. স. রাজনীতিবিদরা বুঝতে পেরেছেন যে জনগণের দাবি শিশু শ্রম নির্মূল করা। সেখান থেকেই রাজনৈতিক সদিচ্ছার আগমন, বলতে পারেন। এটি যেমন শিক্ষা খাতে হয়েছে তেমনি অন্যান্য খাতেও হয়েছে। যেমনটি হয়েছে শিশু অধিকার এবং শ্রমের ক্ষেত্রে। শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ দেশে এখন আইন হয়েছে। বিভিন্ন দেশে এই আইনের প্রয়োগ দেখা যায়। অতীতের চাইতে বর্তমানে সুশীল সমাজও বেশ শক্তিশালী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। তারাও এখন এই ইস্যুতে জনগণ এবং নীতি-নির্ধারকদের সচেতন করছে। যেহেতু এটি জনগণের দাবি, তাই সরকারকে এর সুষ্ঠু সমাধান করতেই হবে। সমাজের মানসিকতা পাল্টে দিয়েছে শিশু অধিকার আন্দোলনের ইস্যুটি।

মা.আ. আপনি বলতে চাইছেন মানুষের এ বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পাল্টাচ্ছে।

কৈ.স. একদম ঠিক। কর্পোরেট দুনিয়া এই ইস্যুটিকে বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে।

মা.আ. আপনি সবসময় বলে আসছেন শিশু-বান্ধব নীতির কথা। কীরকম হতে পারে শিশু-বান্ধব নীতিমালা?

কৈ.স. যখন নীতি-নির্ধারকেরা নীতিমালা প্রণয়ন করে, এমন কি বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রেও, তখন শুধুই ভোটারদের কথা ভাবা হয়। শুধু ভাবা হয় সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণীর কথা। তখন পরিকল্পনাগুলো বা নীতিগুলোর প্রভাব হয় স্বল্পমেয়াদী। যখন আমরা শিশুদের বিষয়টি আলোচনার টেবিলে আনি, তখন স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনার কোনো সুযোগ থাকে না। এটি অবশ্যই হয়ে যায় দীর্ঘমেয়াদী। শিশু অধিকার এমন কোন বিষয় নয় যা শুধু কাগজে-কলমে লেখা থাকবে বা শুধুমাত্র একটি গোলটেবিলে আলোচিত হবে। এটি একটি জীবনব্যবস্থা। দেখতে হবে আমরা আমাদের নিজেদের শিশুদের কীভাবে দেখছি। শিশু মানে এমন কিছু নয় যে তাকে আপনি চকোলেট, পিজ্জা বা বার্গার খাওয়াবেন। বা নিয়ে যাবেন কোন পিকনিকে।

সত্যিই কি আমরা আমাদের শিশুদের বন্ধু হতে শিখেছি? বন্ধুত্ব মানে হলো দুজনেই দুজনকে শ্রদ্ধা করতে হবে। শিশুদের শ্রদ্ধা করতে হবে আমাদের। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। যদি তারা সত্যিই সুন্দর বা নতুন কোনো ধারণা নিয়ে আসে আমাদের কাছে, সেটি অনুসরণ করা আমাদের আবশ্যক। তাই সম্পর্কগুলো দ্বিমুখী হতে হবে। শ্রদ্ধা, মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনা, তাদের পরিপূর্ণ যত্ন নেয়া- এসব কিছুই হতে হবে একইসাথে।

মা.আ. দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়ে যদি বলি- এ অঞ্চলে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই বিপুল সংখ্যক শিশুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়াটা কি কিছুটা কঠিন নয়? তেমন একট সুযোগ-সুবিধা নেই।

কৈ.স. আপনি যা বললেন তার সাথে আমি একমত। ভারতের জনসংখ্যার বিষয়টি নিয়ে আমি ভেবেছি। আমি শিশুশ্রম এলাকাগুলোর ওপর গবেষণা করেছি। এগুলো বেশিরভাগই শিল্প এলাকা যেখানে কার্পেট তৈরি হচ্ছে এবং গার্মেন্টস রয়েছে, কাঁচের চুড়ি বানানো চলছে হরদম। আমি দেখেছি যেখানেই শিশু শ্রম অনিয়ন্ত্রিত, যেখানে মেয়ে শিশুদের পড়ালেখা করার সুযোগ নেই, সেখানে জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। দরিদ্র এবং অশিক্ষিত বাবা-মা মনে করে যতো বেশি সন্তান উৎপাদন করা যায়, ততো বেশি আয়ের পথ খুলবে। এই সন্তানদের কখনোই তারা বোঝা মনে করে না। তারা এই সন্তানদের সম্পদ মনে করে। তাই তারা আরও বেশি সন্তান চায়। অধিক সন্তান উৎপাদনের সাথে সমাজের কিছু প্রাচীণ কুসংস্কারের’ও সম্পর্ক রয়েছে।

যেখানে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং যেসব অঞ্চলে বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারছে, সেখানে বাবা-মা সন্তানদের সম্পদ না মনে করে বোঝাই ভাবে। সেখানে যতো বেশি শিশু, ততো বেশি বোঝা- এমনই একটা ধারণা চালু রয়েছে। তাই তারা কম সন্তান নেন। শিশুশ্রম এলাকা এবং যেখানে শিশু শ্রম নেই; এ দুটো এলাকার ভেতর পার্থক্যটি বেশ প্রকট। যে এলাকাটি শিশুশ্রম এলাকা সেই এলাকায় আধিপত্য করে নিরক্ষরতা। শিশু শ্রম এবং নিরক্ষরতা- এই দুই যেখানে আছে সেখানেই আছে অধিক জনসংখ্যা। এটি একটি অমোঘ চক্র।

মা.আ. আপনি কীভাবে দরিদ্র বাবা-মাদের বোঝান যেনো তারা তাদের সন্তানদের শ্রমিক হিসেবে বাড়তি আয়ের জন্য ব্যবহার না করে স্কুলে পাঠান?

কৈ.স. এটি খুব কঠিন একটি কাজ। একদমই সহজ নয় বিষয়টি। যখন তারা তাদের সন্তানদের ভাল কোনো ভবিষ্যতের রাস্তার খোঁজ পায়, তারা কিন্তু সেই পথেই হাঁটে। যদি তিনি জানতে পারেন তাদের সন্তান বিনা খরচে পড়তে পারবে, কিছুটা অর্থনৈতিক প্রণোদনা পাবে তাদের সন্তান, যখন তারা দেখবেন সন্তানের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, তখন তারা অবশ্যই এটি গ্রহণ করবেন এবং ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠাবেন।

মা.আ. কৈলাস সত্যার্থী চ্যানেল আই স্টুডিও-তে আসার জন্য আপনাকে আবারও অনেক ধন্যবাদ। আপনি বাংলাদেশের বন্ধু। দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশে আপনি আসছেন। আমাদের অনেক শিশু অধিকার কর্মী, এনজিও কর্মীকে আপনি চেনেন। আমরা চাইবো আপনি চিরজীবন বাংলাদেশের বন্ধু হয়ে থাকুন। এবং আমরা আপনাকে সম্মানের শিখরে রেখেছি এবং রাখবো চিরকাল…।

কৈ.স.  দুঃখিত আপনাকে একটু থামাতে হচ্ছে কথার মাঝে। একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে আমি বলছিলাম বাংলাদেশে শান্তিতে একজন নোবেলজয়ী আছে যিনি হলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এখন আপনারা আমাকেও আপনাদের দেশেরই নোবেলজয়ী মনে করুন, কারণ বাংলাদেশ-কে আমি প্রতিবেশী দেশ মনে করি না, এই দেশটিকে আমার নিজ দেশ বলেই আমি মনে করি।

মা.আ.  সত্যিই অসাধারণ আপনার চিন্তা। আমরা তাহলে বলতেই পারি আমাদের দু’জন নোবেল জয়ী আছেন।

কৈ.স. অবশ্যই। আমি মন থেকেই বলছি এই কথাটা।

মা.আ. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এভাবেই আপনি আসলে বাংলাদেশকে ভালবাসেন। আমরাও আপনার ভালোবাসা সাদরে গ্রহণ করছি। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আবারো ধন্যবাদ।

কৈ.স. চ্যানেল আইয়ে আসতে পেরে আমিও সম্মানিত।

বিজ্ঞাপন