‘ঋ-কে ছাড়া মানেই কলকাতা ছাড়া, কলকাতা ছাড়া মানে বাংলা সিনেমা ছাড়া’
চার পর্বের দীর্ঘ আলাপের তৃতীয় পর্ব
১০ নভেম্বর। বিকেল। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে সারা বাংলাদেশের মতো ঢাকার আবহাওয়াও কিছুটা গোমট। মেঘলা। কখনোবা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি! এসব তোয়াক্কা না করে বনানীর যাত্রা বিরতিতে হাজির আমরা কয়েকজন। কারণ বিকাল ৫টায় মুখোমুখি হওয়ার কথা এমন এক মানুষের সাথে, যাকে ভারতবর্ষ ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক’ পরিচালক হিসেবে জানে! যিনি এই সময়কে চিহ্নিত করছেন ‘আবর্জনার যুগ’ হিসেবে। পৃথিবীতে ঘটে চলা সমস্ত কিছুর জন্য প্রকাশ্যে মানুষকে কাঠগড়ায় তুলে দেন তিনি। নির্দয়ভাবে যিনি বলে দিতে পারেন, ‘পৃথিবীতে আর একটি শিশুর জন্ম হোক আমি তা চাই না’।
‘লাভ ইন ইন্ডিয়া’ থেকে শুরু। এরপর গান্ডু, তাসের দেশ এবং সর্বশেষ যার হাতে জন্ম ‘গার্বেজ’-এর। কলকাতার মানুষ তার ছবি দেখতে বা দেখাতে ভয় পেলেও গেল বছর তার নির্মিত গার্বেজ-এর প্রিমিয়ার হয়েছে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে! এরপর আরো আরো উৎসবে। হ্যাঁ, সেই বিপজ্জনক মানুষটির কথাই বলছি। যে কৌশিক মুখার্জীকে হত্যা করে ‘কিউ’ নামটি ধারণ করে আছেন।
তার সৃষ্টি, সিনেমা নিয়ে ভাবনা, একার পথ চলা, ব্যক্তিগত প্রেম-এসমস্ত কিছু নিয়েই আড্ডা দিয়েছেন জুয়েইরিযাহ মউ ও মিতুল আহমেদ-এর সাথে। চ্যানেল আই অনলাইন-এর পাঠকদের জন্য চার পর্বের দীর্ঘ আলাপের তৃতীয় পর্ব থাকলো:
প্রেমকে কীভাবে দেখে কিউ?
‘লাভ ইন ইন্ডিয়া’, এই যে এতো বড় একটা ছবি করে ফেললাম না! পুরো জিনিসটাই ওটা নিয়ে, তারপরে তো আমার কিছু বলার নেই।
শরীরের বাইরে প্রেম কিছু নয় এরকম একটা স্টেটমেন্ট খুব স্পষ্ট ফিল্মটায়।
- হ্যাঁ আমি বুঝতে পারিনি, এবং আমার ধারণা কেউ বুঝতে পারেনি আজ পর্যন্ত। কেউ বুঝতে পারেনি, সবাই ভাওতাবাজ। এই হচ্ছে ঘটনা, রাধা বলে গেছে। রাধা না হলে বোঝা যাবে না, এরকম!

একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে চাই, ঋ সেন-কে নিয়ে। ‘নবারুণ’ ডকুফিল্মটা সম্ভবত শ্যুট আগে করা, তো ‘নবারুণ’ পর্যন্ত আপনার ফিল্মে আমরা ঋ-কে পেয়েছি। তো লাস্ট একটা সাক্ষাৎকার পড়লাম ঋ তাতে বলেছেন যে চলতি সিনেমাগুলোতে এখন উনি ফিরতে চাইছেন এবং উনার ধারণা যে উনি মিস ইউজড হয়েছেন। এমনটা শুনে মনে হচ্ছিলো যে মিস-ইউজড বলতে কি আপনার সময়টিকেই ইন্ডিকেট করেছেন কী না! এ ব্যাপারে কি কিছু বলবেন?
- হতেই পারে সে সময়ের কথাই বলা হচ্ছে। সেটা অনেকেরই মনে হতে পারে। একটা পলিটিক্যাল এনভায়রনমেন্টে থাকলে সেটার পরে তার ফল ব্যাকটা অনেকটাই…! এই জিনিসটা সবারই মনে হয়েছে। আমার দিক থেকে যেটা আমার মনে হয় যে, আমার কলকাতা থেকে চলে যাওয়াটা এবং ঋ – কে ছাড়া… ঋ-কে ছাড়া মানেই কলকাতা ছাড়া, কলকাতা ছাড়া মানে বাংলা সিনেমা ছাড়া… মানে পুরো জিনিসটাকে ছেড়ে ফেলা। কারণ এই জিনিসটা একটা… আমার কাছে এই জিনিসটা কমপ্লিটলি পয়েন্টলেস এক্সারসাইজ হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। কারণ তারা নেক্সট লেভেলটাতে যেতে পারছে না কিছুতেই। তারা ভাবতে পারছে না যে ঐ জায়গাটাতে কী করে পৌঁছোবো। খুব কম মানুষই সার্বিকভাবে এটাকে আত্মস্থ করতে পারছে। প্রোব্লেমটা এটা যে এটা যেহেতু পলিটিক্যাল একটা বিষয় এবং মোটেই সহজ নয় সেজন্য এটা অনেকটা বিশ্বাসের মতো। বিশ্বাস এবং প্রেম – একটা সময় থাকে যখন একটা সম্পর্ক থাকে এবং প্রেম থাকে, এটা আমাদের সবার মধ্যে ছিল। পুরো জিনিসটাই নাহলে হতো না। তারপর একটা সময় সেটা দেখা যায় যে আস্তে আস্তে করে সেটা শেষ হচ্ছে। এই সম্পর্ক, এই সময়টা শেষ হচ্ছে। তা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, অন্যরাও দেখতে পাচ্ছে। সবাই নিজস্ব ভঙ্গিতে দেখছে। এবং সবারই মনে হচ্ছে আমি কি সময়টা নষ্ট করলাম? অপচয় হল? কিন্তু…! অপচয়! আমাদের সবার আইডেন্টিটিই তো ঐটা। নইলে ঋ-কে… কী আর ঋ হতো? ওকে সবাই চেনে কারণ ঋ হচ্ছে ‘ঋ’ এবং ও এতোই পাওয়ারফুল অভিনেতা এবং এতোই দক্ষ যে এই জিনিসগুলো করতে পেরেছে যেগুলো আর কোন বাঙালি মেয়ে পারতো না। আমার ধারণা ওদের নিজেদেরকে দেখার প্রিজমটা অত্যন্ত কম্প্রোমাইজড। বিকজ অব দ্য কন্ডিশনিং অব বেঙ্গলি মাইন্ড। কিছুতেই সে তার ইমিডিয়েট সামাজিক প্রেক্ষাপটের বাইরে সে দেখতে পারছে না জিনিসটাকে। আর আমার পুরো চেষ্টাটাই ছিল আমার সামাজিক প্রেক্ষাপটকে আমি কোনদিন মানবো না, এটা আমি বাঙালির চোখ দিয়ে দেখতে রাজি নই। কারণ সে মধ্যবিত্ত এবং মধ্য ভাবনার মধ্যে আটকে গেছে। সে খুব কম জিনিস জানে বাইরের, ফলত তার কাছ থেকে নেওয়ার কিছু নেই। এটা একটা সমস্যা। ইভেন অনুব্রতও (গান্ডু-চলচ্চিত্রের ‘গান্ডু’ চরিত্রের অভিনেতা) তো তারপরে সবকিছু ছেড়ে দিলো এবং তিন-চার বছর বাড়ি থেকেও বের হতো না। কারণ এক্টর হলে তার অনেক স্টিগমাও থাকে। তার নিজস্ব যুক্তিবাদ এবং পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি থাকতে হবে যেটা দিয়ে সে কাউন্টার করবে। যেটা সবার থাকে না। তাদেরও ছিলো না।

অনুব্রত’র কী ‘গান্ডু’ রিলিজের পরে এরকমটা হয়েছিল?
- হ্যাঁ তারপরে সে ‘তাসের দেশ’ও করেছে অবশ্য। তারপরে ‘ছত্রাক’ বলে একটা ছবি করে সে, তার একটা এমএমএস লিক হয়। এরপর সবাই বলতে শুরু করে সে পর্নো এক্টর। পর্নো এক্টর বললে বলবি যে তুই শালা হয়ে দেখা না– এই যে ফেস করার ব্যাপারটা। আবার নিরন্তর হতে থাকলে একটা চাপও সৃষ্টি হয়। তার থেকেও বড় কথা হচ্ছে সে (এক্টররা) কাজ পায় না। এইটা একটা মস্ত সমস্যা, রাইট? কিন্তু আমাদের যে স্কিমটা ছিল যে আমরা জানতাম যে আমাদের অন্য কেউ কাজ দিবে না। আমি জানি, তার জন্য আমি প্রিপেয়ারড। হলো তো? এবার কী হচ্ছে – আমি যদি বলি আমি ডিরেক্টর তাহলে হবে না, আমি ক্যামেরা করবো, আমি জল আনবো শ্যুটিং এর সময়, সবই করবো তাহলে কিন্তু ইকোনমিক্যালি ব্যাপারটা ঘটতে পারে। যেটা সমস্ত ডেভেলপড দেশেই ঘটে। কিন্তু আমাদের তো একটা কমিউন ছিল, এই কমিউন বেশিদিন থাকে না। সবাই জানি, এর মেয়াদ হচ্ছে ৭-১০ বছর। আমরা দশ বছরই চালিয়েছি, খারাপ না রেকর্ড হিসেবে (হাসি) ! তারপর ভেঙে ফেঙে গিয়ে সবাই সবাইকে খিস্তি ফিস্তি করে এটাও হয়, এটাই হচ্ছে।
এটা আমার মনে হয়েছে যে ঐ লোকগুলো কোথায় এখন? যেমন সুরজিৎ (সুরজিৎ সেন)ও তো প্রথম থেকেই ছিলেন?
- হ্যাঁ যেমন সুরজিৎদার কোন অশান্তি নেই সে পলিটিক্যাল মানুষ, জয়রাজেরও কোন অশান্তি নেই। আমার … আমরা পনের থেকে কুড়িজন এক্টর প্লাস টেকনেসিয়ান কিন্তু প্রোডিউস করেছি। যারা আমাদের সাথে কাজ করার আগে কোনোদিনও কাজ করেই নি। একটা র্যাম্প এমেচার ডিজাইনার সে ‘তাসের দেশ’ এর প্রোডাকশন ডিজাইনার হয়ে গেল। জাস্ট ফেইথ বেজড। শুধু বিশ্বাস যে বাইশ বছরের একটা মেয়ে করে ফেলবে। এবং করে তো ফেললোও। ওরা দু’জন দু’জন মিলে করেছিল, ওরা এখন চমৎকার আর্ট ডিরেক্টর বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে বেড়াচ্ছে। যারা করতে পারছে তারা ঐ ধরণের কাজই করছে, কিন্তু তারা ঐ জায়গাটাকে ধরতে পারছে না। ধরাটা একটা স্কিল। তার জন্য হয়তো অনেককিছু লাগে যেগুলো সবার মাঝে থাকে না। সেটা খুবই স্যাড কিন্তু সেটাকে এক্সকিউজ হিসেবে আমি মেনে নিতে রাজি নই।
জেনে বুঝে আসাটাও ফেক্ট হয়তো…
- জেনে বুঝে কেউ আসে না বস। ফুসলিয়ে আনতে হয় (হাসি)! প্রথমদিকে ভক্ত কিন্তু ধরতে হয়। প্রথমেই ভক্ত হয় না, এটা সাধু বাবা লজিক (হাসি…)।
কিন্তু এই যে কাজ করার পর আপনার এক্টর-এক্ট্রেসদের মনে হচ্ছে ভুল করে ফেললাম…
- কিন্তু ততক্ষণে একটা বেঞ্চ মার্ক দাঁড়িয়ে যায়, তাই আবার নতুন এক্টর এক্ট্রেসরাও করতে আগ্রহী হয়। তারা জানে যে বেঞ্চ মার্কটা কী। কোথায় এটা যাচ্ছে। এখন আমার কাছে যেরকম কোন নতুন এক্টর আসলে সে প্রচণ্ড অবাক হয়ে যায় ন্যাংটো না হতে বললে। গার্বেজ-এ তো একজন বলেই ফেললো যে, আমরা কি সত্যি সত্যি কাজটা করছিতো?
‘নবারুণ’ নিয়ে সিনেমা বানাবেন সেটা কিউ কখন ভাবলেন? আপনি না কি শ্যুটিং এর সময় বেশিরভাগ ইচ্ছে করেই নবারুণের সামনে থাকতেন না, কেন?
- গল্পটা হচ্ছে আমরা বসে আছি একদিন আমাদের অফিসে, সুরজিত সেন আর আমি, কিছু কথা হচ্ছে। হঠাৎ মনে হল আচ্ছা নরারুণদাকে নিয়ে তো কিছু হয়নি এখনো। কেউ কি কিছু করেছে? কিছু ফোন টোন করা হল, কেউ কিছু করছে কিনা! কেউ কিচ্ছু করছে না, আর আমাদের আধা কিলোমিটার দূরে থাকেন। চললাম আমরা নবারুণদার বাড়ি, বাড়ি গিয়ে হঠাৎ আমার মনে হল সুরজিৎদা তুমিই যাও। আমার হেভি ভয় লাগছে, কী বলবো, কী হবে, যদি পছন্দ না করেন উনি। আমাকে পছন্দ না করারই কথা নবারুণদার। তো আমি বাইরে, সুরজিৎ গিয়ে বললেন, একটা সময় বের হল আমি বাইরে দাঁড়ানো, তখন আবার ডেকে পাঠালেন। নবারুণদা বললেন, তোদের তো কাজ দেখিনি আমি। আমরা তখন আবার বাসায় গেলাম, গিয়ে ‘গান্ডু’ নিয়ে এলাম। নিয়ে এসে প্রনীতিদি আর নবারুণদা আবার নিয়ে বসলেন, আবার আমি বাইরে। আমি ভাবছিলাম উনি যদি খিস্তি করে, করবেই, আমি ধরেই নিয়েছিলাম উনি বলবেন – না, এটা হল না। আমি লাল ফাল কাউকে বলবো, সেভ কাউকে।
কিন্তু তারপরে দেখা গেল ‘গান্ডু’ দেখে উনি ফুললি অন। দেড় বছর ধরে উনি বার বার একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতেন – তোদের চলে কি করে? কারণ উনি বিশ্বাস করতে চাইতেন না যে আমরা আর কিছু করি না।

বাহ্! দারুণতো…
এবার ডকুটা করতে করতে যখন আমাদের হৃদ্যতা বাড়ছিল, যারা দেখেছেন খেয়াল করলে দেখবেন প্রথম সিনটাতে আমি নবারুণদাকে আপনি বলছি উনি আমাকে তুমি বলছেন। লাস্ট সিনে আমি যখন কথা বলতে শুরু করছি উনি আমাকে তুই বলছে আমি উনাকে তুমি বলছি।
পুরো সময়টায় একটা আনকমফোরটেবল জার্নিকে কমফোর্ট করে এনেছি, এখন আমি যদি সামনে বসে – আচ্ছা আপনার কী মনে হয়… এরকম বলতে শুরু করি তাহলে কিসের ফিল্ম করবো! আমি একটা চোর চোর ভাব, আমি একটা গান্ডু, সাইড থেকে তাঁকে দেখছি। সুরজিৎদাকে ইউজ করলাম এজ মাই ক্যারেক্টার। আমি ওকে ব্রিফ করছি ও নবারুণ-এর সাথে কথা বলছে। এরকম নয় যে আমি ছিলাম না শ্যুটে, আমি কি করতাম উনার রিয়াল লাইফ শ্যুটে যখন উনি রান্নাঘরে কথা বলছেন, সাইকেল চালাচ্ছে, আমি থাকলে তখন উনি জানেন যে আমি আছি এবং আমার চোখটা আছে। তখন তো লোকে কনশিয়াস হয়ে যায়। আর অন্য দিকে আমার ফ্রেন্স প্রোডিউসার ভীষণ সফট একটা ছেলে, বাংলা বলে, আরেকদিকে একটা বাচ্চা ছেলে সাউন্ড করছে এবং বলাই ছিল আমার, খেয়াল করলে দেখবে যে এসমস্তকিছু দূর থেকে নেওয়া। আর আমি যখন কথা বলছি তখনই শুধু ক্যামেরা নিয়ে কাছে গিয়েছি।