সিডনিতে সারা বছর জুড়েই কোন না কোন অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। আর তার সাথেই তাল মিলিয়ে চলে আলোর খেলা। সেটা সিডনির বর্ষবরণের চোখ ধাঁধানো আতশবাজি থেকে শুরু করে নিজের বাড়িঘর সাজানো যেকোন কিছুই হতে পারে। তবে আজ আমরা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে আলোর খেলাগুলোর দিকে আলোকপাত করবো। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সারা বছরের সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান হিসেবে ঘটা করে পালন করা হয় ক্রিসমাস। ক্রিসমাসের অনেক আগে থেকেই সব জায়গাতেই সাজসাজ রব শুরু হয়ে যায়। সারা বিশ্বময় ক্রিসমাস পালন করা হয় ২৫ ডিসেম্বর কিন্তু নভেম্বরের শুরু থেকেই আপনি বুঝতে পারবেন যে ক্রিসমাস আসছে। রাস্তার দুধারে ক্রিসমাসের ফেস্টুন শোভা পেতে থাকে। পার্কগুলোতে বর্ণিল ক্রিসমাস ট্রি তৈরি করা হয়। মার্কেটগুলোকেও বর্ণিল সাজে সাজানো হয়। শপিংমলগুলোর প্রত্যেকটা দোকানও আবার আলাদাভাবে নিজেরা সাজে। সেই সাজের মধ্যে আলোকসজ্জা অন্যতম।
প্রত্যকটা শপিংমলেই একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে সেখানে সান্তাক্লজের জন্য চেয়ার পেতে রাখা হয়। তার পাশেই থাকে সুসজ্জিত ক্রিসমাস ট্রি এবং সান্তাক্লজের বিশাল ঝুড়ি। ক্রিসমাসের আগে পর্যন্ত সান্তাক্লজের পাশে বসে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলা যায়। তবে ছবি তোলার খরচটা আমার কাছে একটু বেশিই মনে হয়েছে। এছাড়াও শপিংমলগুলোতে চলে বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়াও একটা নির্দিষ্ট দিনে সান্তাক্লজ তার দলবল নিয়ে হাজির হয়। একটা বিশাল মিছিলের মত করে একেএকে সান্তাক্লজের দলবল আসে আর সবার শেষে সান্তাক্লজ সত্যিকারের রেইনডিয়ারে টানা স্লেজ গাড়িতে চড়ে শপিং মলে হাজির হন। শপিংমলে ঢোকার মুখে আবার তাঁকে স্বাগতম জানানোর জন্য আগে থেকেই একদল বাদক বিভিন্ন রকমের বাদ্য বাজনা বাজিয়ে চলে।
এসব আয়োজনের একটাই উদ্দেশ্য থাকে সেটা হচ্ছে সবাইকে আনন্দিত করা। বিশেষ করে বাচ্চাদের এই সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। ছোট বাচ্চারা এগুলো দেখে যারপরনাই আনন্দিত হয়। আমার মেয়ে তাহিয়া সিডনিতে আসার শুরুতেই জিজ্ঞেস করতো আসলেই সান্তাক্লজ আছে কিনা? আমি বলেছিলাম সান্তা সত্যিই আছে। সে উত্তর মেরুতে বাস করে এবং ক্রিসমাসের সময় সে তার স্লেজ গাড়িতে চড়ে ছোট বাচ্চাদের জন্য উপহার নিয়ে আসে। সেটা সে দ্বিধা নিয়ে বিশ্বাস করেছিল। এরপর যখন সে মিন্টো শপিংমলে সত্যিকারের সান্তাকে দেখলো তখন সে সত্যিই বিশ্বাস করেছিল। আসলে ছোট বাচ্চাদের কল্পনার রাজ্যে ছোটবেলা থেকেই আমরা যদি এমন অনেক আনন্দের উপকরণ ঢুকিয়ে দিতে পারি তাহলে বড় হয়ে আর তারা বিষণ্ণতায় ভুগবে না। কারণ, যান্ত্রিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট উন্নত দেশগুলোর মানুষেরা দ্রুতই বিষণ্ণ হয়ে যায়।
ক্রিসমাসের সবচেয়ে বড় বিস্ময় আসলে বাচ্চাদের জন্য উপহার। আমাদের বাসায় জায়গা কম তাই আমরা শপিংমল থেকে একেবারে ছোট আকারের ক্রিসমাস ট্রি কিনে নিয়ে এসে বাসার এক কোণায় সেটাকে বসিয়ে দিই। তারপর আমরা বাপ্-বেটি মিলে সেটাকে সাজাতে লেগে যাই। এভাবে সাজানোর পর ক্রিসমাসের আগের রাত্রে সামান্য কিছু উপহার আমরা সেখানে রেখে দিই যাতেকরে সকালবেলায় উঠে ওরা সেই উপহার দেখে খুশি হয়ে যায়। এছাড়া প্রতিবেশীরাও অন্য প্রতিবেশীর বাচ্চাদের জন্য উপহার কিনে এবং এই উপহার দেয়ার একটা রীতি আছে সেটা হলো উপহারটা না বলে দেয়া হয়। প্রতিবেশীর দরজায় উপহার রেখে হয়তোবা দরজায় টোকা দিয়ে চলে যাবে। পরে দরজা খুলে দেখা যাবে উপহার আছে কিন্তু সেখানে কোন মানুষ নেই।
আমাদের ফিলিপিনো প্রতিবেশী আমাদের বাসার দরজায় উপহার রাখার সময় আমি টের পেয়ে গেলে তার কি আফসোস যে কেন আমি টের পেয়ে গেলাম। এরপর আমরাও একদিন নিঃশব্দে ওদের বাসার দরজায় উপহার রেখে এসেছিলাম। আমাদের পর্তুগীজ বাড়িওয়ালি যথারীতি প্রতিবছর নিয়ম করে আমাদের ছেলেমেয়ের জন্য উপহার কেনে। আমরাও আমাদের সাধ্যের মধ্যে উনাদের বাচ্চাদের জন্য উপহার কিনে উনাদের দরজায় রেখে আসি। আমরা যদিও এখন আর উনাদের বাসাতে থাকি না কিন্তু এই চলটা আমরা ধরে রেখেছি। আসলে একবার কারো সাথে নিঃস্বার্থ আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হলে সেখান থেকে আর সরে আসা যায় না।
এছাড়াও সবাই যাতে সমান আনন্দ নিয়ে ক্রিসমাস পালন করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। দোকানগুলোতে একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে রাখা হয় যেখানে সবাই তাদের সাধ্যমত উপহার কিনে সেটাকে রঙিন কাগজে মুড়িয়ে রেখে আসে। এভাবে অনেক উপহার জমা হয়ে যায় সেখানে। তারপর সেই উপহারগুলো গরীব মানুষদের মধ্যে বিলি করা হয়। তাছাড়াও বাজারের প্রায় সব পণ্যে ছাড় দেয়া হয় বিশেষ করে ক্রিসমাসের ঠিক পরের দিনটাকে বলা হয় বক্সিং ডে। ঐদিন আপনি যেকোন দোকান থেকে স্বল্পমূল্যে অনেক দামি এবং দরকারি পণ্য কিনতে পারবেন। তাই আগের রাত থেকেই অনেকে তাদের পছন্দের দোকানের সামনে লাইন দিতে শুরু করে। অনেকে আবার আগে থেকেই নিজের পছন্দের পণ্যটা দেখে আসে যাতে বক্সিং ডেতে যেয়ে তাকে বেশি খুঁজতে না হয়।
এইবার আসি সাজসজ্জার বিষয়ে। প্রায় প্রত্যেকটা বাড়িই ক্রিসমাসের অনেক আগে থেকেই বাহারি রঙের আলোকসজ্জায় সেজে উঠে। অফিস শেষ করে ফিরতে ফিরতে আমাদের প্রায়ই সন্ধ্যা হয়ে যায়। তারপর আমরা দলবেঁধে বেড়িয়ে পরি আমাদের আশেপাশের কোন বাড়িতে আলোকসজ্জা হয়েছে কিনা সেটা দেখতে। এভাবে সন্ধ্যার পর থেকে আমরা প্রায় প্রত্যেকটা পাড়ায় চষে ফেলি। আমাদের সাথে অবধারিতভাবেই সংগী হয় আমার মেয়ের বান্ধবী জেইনা এবং তার পরিবারের সবাই। এরপর আমাদের মধ্যে চলে আলোচনা কোন বাড়িটার আলোকসজ্জা বেশি সুন্দর। আগের বছর কোন বাড়িটাতে সজ্জা হয়েছিলো কিন্তু এবছর হয়নি। আলোসজ্জা গুলো দেখে বাচ্চারা অনেক খুশি হয়। পাশাপাশি চলে ফটোসেশন। যে বাড়িটা সাজানো হয়েছে সেই বাড়ির মালিকের সাথে আমরা প্রায়ই আলোচনা জুড়ে দিই। তখন সে আমাদের জানায় তোমরা অমুক দিন আসো সেদিন আরো কিছু জিনিস আমরা যোগ করবো। এছাড়াও বিভিন্ন বাড়িতে আলোকসজ্জার পাশাপাশি চলে বিভিন্ন রকমের ফান্ড রেইজিং ইভেন্ট। সেখানে একইসাথে আলোকসজ্জা দেখার পাশাপাশি আপনি বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন রকমের খেলনা এবং খাবার কিনতে পারেন। আমাদের পাশের ক্যামডেন সিটি কাউন্সিলের উদ্যোগে সজ্জার ক্যাটেগরিভিত্তিক পুরস্কারও দেয়া হয় আলোকসজ্জাকে উৎসাহিত করার জন্য।
করোনার কারণে এবার আলোকসজ্জা একটু ফিকে হয়ে গেলেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। গত কয়েক বছর ধরে আমরা এবং আমাদের প্রতিবেশী জেইনা, জাহিয়া এবং বাবা সজিব এবং মা ফাহিমাসহ সবাই একেবারে উৎসব করে আলোকসজ্জা দেখতে যাই। এইবার যেয়ে দেখলাম বেশ কিছু বাসাতে আলোকসজ্জা করা হয়নি। অবশ্য পাশাপাশি বেশ কয়েকটা নতুন বাসাতে দুর্দান্ত আলোকসজ্জারও দেখা পাওয়া গেলো। একটা বাসাতে এইবারের আলোকসজ্জার থিমও ছিলো স্টার ওয়ার্সের ভিলেন ডার্থ ভেদার। স্টার ওয়ার্সের যোদ্ধারা যেমন সবচেয়ে জাঁদরেল ভিলেন ডার্থ ভেদারকে পরাজিত করেছিলো ঠিক তেমনি মানবসমাজ বর্তমানকালের সবচেয়ে বড় ভিলেন করোনা ভাইরাসকে একদিন পরাজিত করবে এই বিশ্বাস থেকেই আলোকসজ্জাতে এই থিম আনা হয়েছে বলে বাড়িওয়ালা জানিয়েছিলেন।
যেকোন উৎসব তখনই পূর্ণতা পায় যখন শ্রেণী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল বয়সের মানুষ সেটাতে অংশগ্রহণ করে। সেই অর্থে অস্ট্রেলিয়াতে ক্রিসমাস একটি সর্বজনীন উৎসব। অস্ট্রেলিয়াতে আসার পরপরই আমরা বাংলাদেশের সকল উৎসব পালনের পাশাপাশি এখানকার প্রায় সকল উৎসবেই সাধ্যমত অংশগ্রহণ করে থাকি। এতে করে বাচ্চাদের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়াতে বসবাসরত অন্য ধর্মের এবং বর্ণের মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। যার ফলে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটা উন্নত সমাজ ব্যবস্থা তৈরি হয়। সাথেসাথেই অন্য ধর্ম ও আচারের প্রতি আমাদের পরবর্তি প্রজন্মের মনে তৈরি হয় শ্রদ্ধাবোধ। ক্রিসমাসের সময় মানুষে মানুষের এই ভ্রাতৃত্ববন্ধন অটুট থাকুক অন্য সকল ধর্মের উৎসবের সময়েও এটাই আমাদের চাওয়া। তাই ক্রিসমাসের সময় বাড়িগুলোতে আলোকসজ্জা দেখতে দেখতে মনের কোণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কিছু কথায় বেজে চলে অনবরত
“আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও।
আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও॥”