তাৎক্ষণিকতা (immediacy) সিনেমার মিত্র, আবার শত্রুও বটে। একটি গল্প উপন্যাস বা কবিতা পড়তে হয় শব্দ ও অক্ষরে, এবং পড়তে পড়তে কল্পনায় ও বোধে আমরা একটি জগত সৃষ্টি করি। শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমেও প্রায় এরকমই, নাটকে কিছুটা ভিন্ন। তবে সিনেমায় ইমেজ ও ধ্বনিতে বাস্তব জীবন ও জগত তাৎক্ষণিক ভাবে হাজির হয়। পর্দায় যেন বাস্তবকেই দেখছি—রক্ত মাংসের মানুষ, আকাশ ও মাটি। চরিত্ররা হাঁটছে, কথা বলছে, ভালবাসছে। একারণেই সিনেমা বোধে পৌঁছুনোর আগেই শরীরে পৌঁছে যায়, আমরা উদ্দিপ্ত হই। এটাই সিনেমার শক্তি এবং এভাবেই তাৎক্ষণিকতা সিনেমার মিত্র।
শরীর ছুঁয়ে যায় বলে সিনেমায় দর্শক উসকানি চায়, চায় গ্ল্যামার, অ্যাকশন ও যৌনতা এবং অতি অবশ্যই অতিনাটকীয়তা, কেননা সিনেমায় সহজে রিপু উসকে দেয়া যায়। এসবের কমতিতে সিনেমা বাণিজ্য করতে পারে না। বাণিজ্যের লক্ষ্মী ঘরে আনতে গিয়ে অধিকাংশ সিনেমাই শিল্পচ্যুত হয়ে যায়, এভাবেই সিনেমার শক্তি তাৎক্ষণিকতা কালের প্রবাহে হয়ে গেছে সিনেমার দুর্বলতা এবং শত্রু।
তারপরেও আছে ক্ষুদ্র একটি পরিসর যেখানে চিরকালই কিছু সিনেমাকার বাণিজ্য লক্ষ্মীর ফাঁদ থেকে দূরে থেকেছেন, ইমেজ ও ধ্বনি সৃষ্টিতে তাদের একমাত্র উদ্দিষ্ট বোধে টোকা দেয়া, যে টোকায় ব্যক্তির অবচেতনের প্রবাহ পথ খুঁজে পায় অরূপের একটি গড়ন দিতে। আসলে যে গড়নের কোন রূপ নেই। ভ্যানসঁ ইওস প্রযোজিত আমীরুল আরহামের ২৮ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া আন্তেমেনা এরকমই একটি সিনেমা যা দর্শককে একটি রূপের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় যা অবলোকন করে দর্শক নিজের অন্তরমহলে এবং চৈতন্যের গহীনে একটি বোধে আক্রান্ত হয়ে রূপ তৈরি করতে করতে অরূপে মজে যায়।
যে কোন সিনেমাই তার নির্মাতার অবলোকনের প্রতিচিত্র, দর্শক হিসেবে আমরা যা অবলোকন করি নিজস্ব বোধ বুদ্ধি ও চেতনার পাটাতনে। সিনেমাকার তার অবলোকিত জগত ও অনুভূত বোধকে ইমেজ ও ধ্বনিতে গাঁথে কোন ঘরানার শৈলীতে প্রভাবিত হয়ে অথবা একান্ত নিজস্ব ঢং–এ। আমাদের অবলোকনে সিনেমাকারের অবলোকন ভিন্ন অর্থ পেতে পারে, কারণ আমাদের সবারই তো আছে চৈতন্যের নিজস্বতা। এভাবেই একটি সিনেমা অনেকগুলো সিনেমা হয়ে ওঠে যখন অনেক দর্শক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সিনেমাটি দেখে ও নিজের করে ধারণ করে।
আমি ফরাসি জানি না, যদিও আন্তেমেনা একটি আদ্যোপান্ত ফরাসি সিনেমা। কিন্তু আমীরুলের নির্মিতিতে ভাষা কখনও দেয়াল হয়ে ওঠেনি। একটি ধ্রুপদি সংগীত যেমন আত্মায় পৌঁছে দেয় সুরের মূর্ছনা, হয়ে ওঠে একটি টোকা যা আমাদের চেতনার অর্গল খুলে দেয়; তেমনি আন্তেমেনা আমাদের অন্তরমহলে একটি ক্যানভাসের জাগান দেয়, সাথে থাকে রঙ ও তুলি। আমি নিজেই সে ক্যানভাসে নিজের করে একটি অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলেছি।
আন্তেমেনা একজন ফরাসি কবি, মাঝে মধ্যে জার্মান ভাষাতেও লেখে। সিনেমা শুরু হয় একটি গ্রামে, যেখানে আন্তেমেনার প্রকৃতিঘন জীবন, কবিতা পরিবেশনার (performance) মহড়া। কবিতার শব্দের সাথে কখনও বাঁশি, কখনোবা পিয়ানো। আমীরুলের চোখ আমাদের অবলোকনে নিয়ে আসে গ্রামীণ পারিপার্শ্ব। ক্যামেরায় লং শটে একটি লোকালয়, দূরে পাহাড়। আবার কখনও ইউরোপীয় ছোট শহরের স্নিগ্ধ কোমল কোলাহল। জ্যাজ ক্যাফেতে আন্তেমেনা ও তাঁর সঙ্গীদের পরিবেশনা। কবিতায় আলাপ সাথে জ্যাজ, হঠাৎ ভারতীয় সুর—হয়তো পুরবী কিংবা অনুরূপ কোন রাগ। পরিবেশনে নাটকীয়তা। আমীরুল ইনসার্টে জুড়ে দেয় যুদ্ধের ফুটেজ, আমরা শুনতে পাই “I cannot breath”—আমাদেরই অতিসাম্প্রতিক মানবিক আর্তনাদ।
আমীরুলের চোখ কখনও কেঁপে কেঁপে ফোকাস করে ক্লোজ আপে, যেন সে খুঁজছে কবিতা ও সংগীত এবং শব্দ ও ধ্বনির ভেতরের ভেতরকে। শিল্প তো আসলে গড়নের ভেতরে, তাই গড়ন ভেঙ্গে যেতে হয় গহীনে, পৌঁছুতে হয় সেখানে যেখানে সব অর্থই অর্থহীন উপলব্ধির ব্যাপ্তীতে। একটা সময়, অর্থাৎ চেতনার গভীরে অর্থ অভিধান থেকে পরিত্যাজ্য; এবং তখন শুধুই একটা প্রবাহ—সৃষ্টির ও অমল ধবল ধেয়ে যাওয়ার।
এরকমই আন্তেমেনার শেষ পঁয়ত্রিশ মিনিট। আন্তেমেনা, সাথে তাঁর সংগীত সঙ্গীরা, গির্জায় হয়তো মহড়া করছে। কবিতা হয়ে যায় নাটক, নাটক রূপ নেয় নৃত্যে। এখানে শিল্পের নেই কোন বিভাজন। দ্রুতই কবিতার অর্থ বাহক শব্দ চলে যায় শুধুই ধ্বনির দখলে, যে ধ্বনির কোন অর্থ নেই কিন্তু মানে আছে। মুখ নিঃসৃত ধ্বনি, জুতো থেকে কাঠের ফ্লোরে ধ্বনি, স্যাক্সোফোনের পেটের ভেতর থেকে আমাদের নিঃশ্বাস ধ্বনি হয়ে বের হয়। সমস্ত দলটি স্বতঃস্ফূর্ত নড়ছে ও দুলছে, কাগজে আঁকছে যা ইচ্ছে তাই, তার ভেতর আন্তেমেনার তুলি লেখে Why? কার কাছে এ প্রশ্ন? অথবা একি কোন জিজ্ঞাসা নাকি শুধুই রেখা? রঙ, রেখা, ধনিতে অদ্ভুত এক জগত তৈরি হয়। এ যেন শিশুর খেলা, যে খেলায় আছে অবচেতনের প্রকাশ, কিন্তু কোন ক্লেশ নেই।
আমীরুল আরহাম আন্তেমেনায় নিজেকে অতিক্রম করেছেন। তাঁর আর সব সিনেমার চেয়ে শৈলী ও প্রকাশে আন্তেমেনা একেবারেই ভিন্ন। কবি তাঁর সিনেমায় আগেও এসেছে—যেমন শামসুর রাহমানকে নিয়ে সৃজিত ‘Samsur Rahman: La plume contre lefusil’ কিন্তু কবি ও কাব্যকে অতিক্রম করে আন্তেমেনা শিল্পের অরণ্যে অনাবিল ভাবে ডুবসাঁতারের সিনেমা। কথা ও কাব্য এখানে শুধুই উপকরণ, কারণ আমীরুল অবলোকন করে শিল্পের অরণ্য, যেখানে সে আমাদের জন্য একটি দরোজা খুলে দেয়। দরোজাটি একটি ইশারা অন্য এক বাস্তবের, যা কেউ কেউ পরাবাস্তব বলে ভুল করতে পারে। পরাবাস্তব তো বাস্তব অতিক্রান্ত। কিন্তু আমীরুল নির্মিত-বাস্তবের ভেতরে গিয়ে এর মৌল সার দেখতে চায়, দেখাতে চায়। আমি যেটাকে বলবো মৌলবাস্তব। এরকমই মৌলবাস্তবের ছোঁয়া পাওয়া যায় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ত্রিস্তান জারা ও তাঁর বন্ধুদের automatic writing-এ। জেমস জয়েসের stream of consciousness বা চেতনার প্রবাহেও আছে এর বীজ কিছুটা অন্যভাবে।
আমীরুলের আরেকটি অর্জন সে আন্তেমেনায় প্রামাণ্য সিনেমার প্রথাবদ্ধ ধারণাকে ভেঙ্গেছে। প্রায় সবার কাছেই প্রামাণ্য সিনেমা একটি বার্তাকে উপজীব্য করে গ্রন্থিত হয়। তার বিপরীতে আন্তেমেনায় আমীরুল একটি বোধকে ভর করে মৌলবাস্তবকে অগ্রন্থিত করে মানব-অস্তিত্ত্বের মুক্ত প্রবাহকে গড়ন দিয়েছে।
আমীরুলের সিনেমায় তাৎক্ষণিকতা মৌলবাস্তব অন্বেষণের জন্য একটি টোকা। সিনেমা দেখতে দেখতে মনে হয় এ যেন ব্রহ্মার সৃষ্টি খেলা, ছন্দ আছে, অর্থ খুঁজতে গিয়ে বাড়িতে গিয়ে অনিদ্রায় কাটে রাত। কিন্তু রাতগুলো বড়ই মধুর। আন্তেমেনা সৃষ্টি ও রূপান্তরের ইশারা দেয়।