
৩০ মার্চ বাংলা ধারাভাষ্যের কিংবদন্তি খোদা বক্স মৃধার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। মাইক্রোফোন জাদুকরের চলে যাওয়ার দিনে, তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চ্যানেল আই অনলাইনে লিখেছেন তারই শিষ্য, এই প্রজন্মের নন্দিত ক্রীড়া ভাষ্যকার মোঃ সামসুল ইসলাম।
‘শ্রোতাবন্ধুরা, খেলার এ পর্যায়ে ধারাভাষ্যে পরিবর্তন। মাইক্রোফোনে আসছেন, আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন সামসুল ইসলাম।’
আমি বলতাম, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় খোদা বক্স মৃধা।’ ধারাভাষ্যকক্ষে মাইক্রোফোন চেঞ্জ ওভারের সময় গুরু শিষ্যের সম্পর্ক এভাবে এগিয়ে চলত। বাংলাদেশে বাংলা ক্রীড়া ধারাবর্ণনার জগতে এক নক্ষত্র খোদা বক্স মৃধা। তার নিবিড় সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলাম বলেই আজ ক্রীড়া ভাষ্যকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি। আজও তার দেখানো পথ ধরেই এগিয়ে চলেছি।


গুরুর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ শৈশবে, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। সেই বয়সে সাহস হয়নি তার সাথে দেখা করে, সামনাসামনি কিছু কথা বলি। বেতার ও টেলিভিশনে ক্রিকেট ম্যাচ দেখা ও ধারাভাষ্য শোনার আগ্রহ শৈশব থেকেই। টিভিতে চোখ আর বেতারে কান পেতে রাখতাম নিয়মিত। তখনই আবিষ্কার করলাম, অন্য সবার চেয়ে খোদা বক্স মৃধার ধারাবর্ণনা সম্পূর্ণ আলাদা, বৈচিত্র্যপূর্ণ। কারণ তিনি একই সাথে ‘বল টু বল’ ধারাভাষ্য দিচ্ছেন, পাশাপাশি প্রকৃতি, আবহাওয়া ও খেলায় এর প্রভাব, গ্যালারি, দর্শক, নানাবিধ দুর্লভ পরিসংখ্যান উপস্থাপন, নিয়মিত স্কোর আপডেট, ইত্যাদি সবই তার ধারাভাষ্যে সচেতনভাবে তুলে ধরছেন। একজন সচেতন শ্রোতা হিসেবে আমি যা শুনতে চাই, তার সবই পাচ্ছি তার ধারাবর্ণনা থেকে, উপরন্তু বাড়তি স্পাইস হিসেবে নানাবিধ উপমা, উদাহরণ, উক্তি, স্মৃতিকথা, মোহনীয় উপস্থাপনা সবমিলিয়ে অসাধারণ। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ব্যারিটন ভয়েস, সুন্দর ও যথার্থ শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস ও তার গাঁথুনি সর্বোপরি ছন্দময় ধারাবর্ণনা এবং দ্রুত খেলার মৌলিক বিষয়ে ফিরে গিয়ে ম্যাচ সম্পর্কিত তথ্য ও উপাত্ত পরিবেশনের মাধ্যমে তার সময়টুকু শ্রোতা ও দর্শকদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারতেন। আমি খুব দ্রুত তার ধারাবর্ণনার প্রেমে পড়ে গেলাম। এভাবেই খোদা বক্স মৃধা হয়ে ওঠেন আমার প্রিয় ক্রীড়া ভাষ্যকার।
১৯৯৬ সালের শেষের দিকে, কোন এক পড়ন্ত বিকেলে গুরুর সাথে আমার প্রথম কথা বলার সুযোগ হয়। ধারাভাষ্যে আমার আগ্রহ শুনে খুব স্বাভাবিক ও সরল ভঙ্গিমায় আমাকে কিছু টিপস দেন। বললেন, ‘মাঠে-ময়দানে আমি যখন-যেখানে ধারাভাষ্য করি, তুমি চলে আসবে, দেখবে আমরা কীভাবে কাজ করি। আর বেতারে সুযোগ পেতে হলে তোমাকে অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে।’ আরও বললেন, ‘তোমার আগ্রহ দেখে আমার ভালো লেগেছে। ধারাভাষ্য শিল্পে নতুনদের প্রয়োজন। তুমি এক কাজ করো, কদিন পরেই রাজশাহী স্টেডিয়ামে একটা গেমস আছে, আমি থাকব সেখানে চলে আসবে।’
নির্ধারিত দিনে গিয়ে হাজির হলাম রাজশাহী স্টেডিয়ামে। চলছে মেয়েদের হ্যান্ডবল ম্যাচ। বললাম, ‘স্যার আমি ক্রীড়া ভাষ্যকার হতে চাই, আপনি আমাকে আসতে বলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাশের চেয়ারে বসিয়ে হ্যান্ডবল সম্পর্কে কিছু সাধারণ টিপস দিলেন। জানতে চাইলেন আমি প্রস্তুত কিনা? সম্মতি জানাতেই মাইক্রোফোনে বলে উঠলেন, ‘ক্রীড়া ধারাবর্ণনা একটি শিল্প, আর এই শিল্পের প্রেমে আকৃষ্ট হয়ে সম্প্রতি তরুণরাও এগিয়ে আসছে। দর্শকবৃন্দ আজ আপনাদের সাথে তেমনি এক তরুণকে পরিচয় করিয়ে দিব। মাইক্রোফোনে আসছেন তরুণ ও নবাগত ক্রীড়া ভাষ্যকার মোঃ সামসুল ইসলাম।’ আমিও সাহস করে শুরু করলাম। লক্ষ্য করলাম, মৃধা স্যার আমাকে মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। প্রায় ১০ থেকে ১২ মিনিট পর নিজ থেকেই মাইক্রোফোন চেঞ্জ করলাম। তৎক্ষণাৎ একাধিক কর্মকর্তা আমাকে ঘিরে ধরে একসাথে জানতে চাইলেন, কোথায় বাড়ি, কী করি, ইত্যাদি। সাধ্যমতো সকলের কৌতূহল মেটালাম। অতঃপর মৃধা স্যার আমাকে সরাসরি বললেন, ‘তোমার বলার ঢংটা বেশ ভালো, চলবে। তবে প্রচুর অনুশীলন করতে হবে এবং বিভিন্ন খেলার নিয়ম-কানুন ভালোভাবে জানতে হবে।’ এই যে পথচলা শুরু হলো, আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। নিয়মিত অনুশীলন চলতে থাকলো, অন্যদিকে খোদা বক্স মৃধার সহযোগিতার হাত অব্যাহত থাকল। দেখা হলেই তিনি কিছু না কিছু টিপস দিয়ে দিতেন, সুযোগ পেলেই ভুল শুধরে দিতেন এবং কিছু দিক নির্দেশনাও থাকতো আমার ও আমার মতো আরও অনেক তরুণ ভাষ্যকারদের জন্য। হঠাৎ একদিন আমাকে রাজশাহী বেতারে ডাকলেন। আমাকে সাপ্তাহিক ক্রীড়াঙ্গন অনুষ্ঠানে পাণ্ডুলিপি লেখা ও পড়ার সুযোগ দেয়ার জন্য মাসুদ সাহেবকে অনুরোধ করলেন। পরের মাস থেকেই বেতারে অনুষ্ঠান পেলাম।

১৯৯৯ সালে এভাবেই সুযোগ পাই রাজশাহী বেতারে। নানামুখী অনুশীলন চলতে থাকলো নিয়মিত। যতই দিন যায়, খোদা বক্স মৃধার সহযোগিতার হাত অকৃপণভাবে প্রসারিত হতে থাকে আমার জন্য। অনেক অপেক্ষার পর ২০০৩ সালে রাজশাহী বেতারে ক্রীড়া ভাষ্যকার হিসেবে অডিশন দেয়ার সুযোগ আসে। আমি কৃতিত্বের সাথে পাশ করি। কর্মসূত্রে ঢাকায় চলে আসি ২০০৩ সালেই। নতুন চাকুরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। হঠাৎ স্যারের ফোন, ‘কী ব্যাপার তোমার কোন খবর নাই, খুব ব্যস্ত নাকি?’ এরপর ঢাকা বেতারে ডাকলেন। আব্দুল আজিজ সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এ হলো সামসুল। ফোর ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছেলে, ক্লাস ওয়ান সরকারি কর্মকর্তা, খুব ভালো কমেন্ট্রি করে। ওকে আপনার মহানগর অনুষ্ঠানে ক্রীড়া পর্যালোচনায় ঢুকিয়ে দেন। এরপর পর্যায়ক্রমে বেতারের সবগুলো ইউনিটের সকল ক্রীড়া বিষয়ক অনুষ্ঠানে আমাকে কাজ করার সুযোগ করে দেন তিনি। আমি একজন পাশ করা ক্রীড়া ভাষ্যকার হলেও সরাসরি মাঠ থেকে কমেন্ট্রি করার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। ২০০৬ সালে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, বাংলাদেশ -কেনিয়া ওডিআই ম্যাচে বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে আমার অভিষেক হয়। সেখানেও খোদা বক্স মৃধার অবদান অনস্বীকার্য। চতুর্থ ভাষ্যকার হিসেবে আমার স্পেল শুরু করতেই দেখি মৃধা স্যার তাঁর ছোট রেডিও সেটটি কানে লাগালেন। মিনিট কয়েক পর দৌড়ে এসে বললেন, ‘সব ঠিক আছে, কিন্তু ভয়েসটা ক্রমাগত নিচু হয়ে যাচ্ছে। তুমি কণ্ঠটা একটু উঁচু স্কেলে তুলে কথা বলো। কণ্ঠের মডিউলেশনটা ঠিক রেখো। আড় চোখে লক্ষ্য করলাম প্রায় ১৫-২০ মিনিট ধরে আমার কমেন্ট্রির পুরো স্পেলটাই শুনলেন। নিজ হাতে গড়া শিষ্য যাতে সারভাইভ করতে পারে, ভালো কমেন্টেটর হতে পারে, সেজন্য তার ব্যাকুলতা দেখে সেদিন আমিও অবাক হয়েছিলাম। এই হলেন খোদা বক্স মৃধা, যখন যা করতেন পূর্ণ নিষ্ঠা ও একাগ্রতা নিয়েই করতেন। যখন যে কাজে হাত দিয়েছেন, সেখানেই পেয়েছেন অধরা সব সাফল্য। এভাবে চলতে থাকল। ক্রমেই ধারাবিবরণীতে আমাদের ব্যস্ততা বাড়তে থাকলো। ঢাকায় নিয়মিত কাজ করছি, এরই মধ্যে হয়তো সিনিয়র কমেন্টেটর আলফাজ ভাই কোনো একদিন আসতে পারেননি, তখনই মৃধা স্যারের ফোন, ‘সামসুল তুমি কোথায়? এখনই মাঠে চলে আস।’ অর্থাৎ যেখানে যতটুকু সুযোগ ছিল, তার পুরোটাই তিনি আমার অনুকূলে ব্যবহার করেছেন। ইতিমধ্যে আমি পারফরম্যান্স দিয়ে শ্রোতা-দর্শক এবং বেতার কর্তৃপক্ষের আস্থা ও মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছি।
পরবর্তীতে ঢাকার মাঠ পেরিয়ে চট্টগ্রামেও নিয়ে গেলেন আমাকে। প্রত্যাশা অনুযায়ী নিয়মিত ভালো কাজ করছি। কিন্তু টিভিতে সুযোগ পাচ্ছিনা। লোভ সংবরণ করতে না পেরে একদিন বলেই ফেললাম, আলফাজ ভাইয়ের গ্যাপে আমাকে বিটিভিতে সুযোগ দেয়া যায়না স্যার? তিনি বললেন, ‘দেখি সুযোগ পেলেই আলাপ করব, ধৈর্য ধর।’ অবশেষে খোদা বক্স মৃধার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০৯ সালে প্রথম সুপার কাপে বিটিভিতেও কমেন্ট্রি করার সুযোগ পাই। এভাবেই তিনি আমাকে বেতার ও টেলিভিশনে জায়গা করে দেন। আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি প্রাপ্ত সুযোগটা ধরে রাখতে।
বাংলাদেশের ক্রীড়া ধারাবর্ণনা শিল্পে তার সমসাময়িক অনেকেই ছিলেন কিন্তু তার মতো করে, অন্যরা নবীনদের আকৃষ্ট করতে পারেননি। খোদা বক্স মৃধা তার অকৃপণ সহচার্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন তরুণ ও নবীন ক্রীড়া ভাষ্যকারদের প্রস্তুত করার জন্য। শিক্ষকতার মহান পেশায় ছিলেন বলেই এই সহজাত স্বভাবটা তার মধ্যে সবসময় ছিল। শিক্ষক এবং ক্রীড়া ভাষ্যকারদের গুরু হিসেবে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। তার হাতে গড়া শিষ্যদের অন্যতম আব্দুর রোকন মাসুম, মনিরুল ইসলাম কাজল এবং জামিলুর রহমান, যারা জাতীয় গণমাধ্যমে নিয়মিত কাজ করছেন। এছাড়া মফস্বল এলাকায় গিয়েই খুঁজতেন স্থানীয় কোনো আগ্রহী ব্যক্তি আছেন কিনা, রীতিমতো মাইকে ঘোষণা করে দিতেন। যার কারণে সাহস ও আগ্রহ নিয়ে যারাই এসেছে, তারা সবাই স্যারের দীক্ষা ও স্থানীয়ভাবে ধারাভাষ্য করার সুযোগ পেয়েছে। আগ্রহীদের মধ্যে যারা সম্ভাবনাময়, তাদেরকে তিনি আরো বড় প্লাটফর্মে কাজ করার সুযোগ করে দিতেন। এভাবেই তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষাগুরুর পাশাপাশি হয়ে ওঠেন ক্রীড়া ধারাভাষ্যের মহাগুরু।
গুরু আপনাকে সালাম, আপনি বেঁচে আছেন কোটি শ্রোতার কর্ণকুহরে, আপনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল, আপনার কাজের মাধ্যমে, কোটি ক্রীড়াপ্রেমির হৃদয়ে। যদি কেউ কখনো ভুল করে, আপনাকে ভুলে যেতে চায়, তখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার মতো শিষ্যরাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবেন, তাদের কাজে, কর্মে ও স্মৃতিতে।