কিছু হলেই বলতেন “তুই আমার বোন না?” বিভিন্ন ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথোপকথনে আমার সাথে তার মতানৈক্য হতো অনেক। স্পষ্টভাষী আমার মুখটি বন্ধ করে দেয়ার এটা ছিল শেষ অস্ত্র।
তাকে আমি সব বলতাম ও বলতে পারতাম। তার রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে দেখতাম আশেপাশের অনেকেই তাল দিচ্ছে বিভিন্ন কথায়, যার অনেক কিছুই তার জন্য মঙ্গলকর বলে আমার মনে হত না। আমি আমাদের ব্যক্তি-আলাপনে তাকে আমার মনোভাব স্পষ্ট করে বলতে কুণ্ঠিত হই নাই কখনও। তিনি কখনও ক্ষুব্ধ হননি। কথা খুব কড়া হতে থাকলে তখন আমার মুখ বন্ধ করে দিতেন ওই কথাটি বলে। যে ভাই কথা শোনেনা, নিজের ভালমন্দ নিয়ে উদাসীন তার জন্য যত শুভ কামনাই থাকুক না কেন, শত প্রচেষ্টাতেও কার্যত ফল হয় শূন্য। খুব দুঃখ হয় আরও কিছু কি করার ছিল আমাদের?
আমার বা স্বপ্নীল কারোই বড় ভাই নাই। খুব নিঃশব্দে, কোন ভাবাবেগের আতিশয্য ছাড়াই সেই স্থানটি পূরণ করে দিয়েছিলেন শাকিল ভাই। এই সম্পর্ক শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই ছিল না। ছিল পারিবারিক পর্যায়ে। আমার মায়ের সাথেও খালাম্মার (শাকিল ভাইয়ের আম্মা) ময়মনসিংহের সেই কৈশোরের দিনগুলোতে যোগাযোগ ছিল। আমার মাকে খালাম্মা নাম ধরেই ডাকেন। অসুস্থতার জন্য খালাম্মা প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি থাকতেন স্বপ্নীলের তত্ত্বাবধানে। আমি প্রায়শই দেখতাম শাকিল ভাইকে কিছু বলার জন্য খালাম্মা শাকিল ভাইকে ফোন না করে, ফোন করছেন স্বপ্নীলকে। শাকিল ভাই নিজে যেতে অপারগ হলে আমাকে বলতেন খালাম্মাকে দেখে আসতে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত খালাম্মা আজও আসতেন শরীরটা খারাপ হলে। আমার জন্য চালতার আচার নিয়ে আসতেন মাঝে মাঝে। ময়মনসিংহ তার ঘর ভর্তি আচার ভরা বৈয়াম। কিন্তু যার জন্য আচারগুলো বানানো সেই ছেলেটি চলে গেছে বহু দূরে। খালাম্মার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেগুলো আমাদের মত কিছু ভালবাসার মানুষদের দিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন কিনা জানি না। তবে আমাদের মন বিষাদে ছেয়ে যেত এই ভালবাসার দায়ে।
ময়মনসিংহ মেডিকেলে পড়তে যাবার পরে স্বপ্নীলের রাজনীতির হাতেখড়ি শাকিল ভাইয়ের হাত ধরে। আর অবসান নাকি আমার কারণে। অন্তত, শাকিল ভাইয়ের তাই অভিমত ছিল। এটা নিয়ে আমার উপর তার রাগও ছিল। বলতেন প্রকাশ্যেই। শাকিল ভাইয়ের অনেক পরিকল্পনা ছিল সেই সময় ছাত্ররাজনীতিতে স্বপ্নীলকে ঘিরে। বুদ্ধিমত্তা, লেখালিখির ভাল হাত, ভাল ছাত্রত্ব, পারিবারিক পরিচয়, আচরণের পরিশীলতার সমন্বয়ে স্বপ্নীলকে তার ছাত্ররাজনীতির নেতৃত্বের উপযুক্ত মনে হয়েছিল এবং ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নেতৃত্বের জন্য গড়ে তোলার অভিলাষ ছিল। প্রায়ই অনুযোগ করে আমাকে বলতেন,“তুই ওকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলি”। আমি একটু হাল্কা করে বলতাম,”আপনি ধরে রাখতে পারলেন না কেন?” কিন্তু বুঝতাম এটা নিয়ে তার আক্ষেপ আছে। ডাক্তারী জীবনের ব্যস্ততার কঠিন বাস্তবতায় স্বপ্নীলের লেখালিখিও তখন বন্ধ। স্বপ্নীলের লেখার বিষয়বস্তু ছিল রাজনীতি। ছাত্রাবস্থায়ই দুটি বই বের হয়েছিল তার। শাকিল ভাই-এর খুব ইচ্ছা ছিল যেন আবার সে লিখে। তিনি জীবিত থাকতে তা করেনি স্বপ্নীল। আজ অবাক হয়ে দেখি যখনই পারছে লিখছে স্বপ্নীল, ক্লান্তিকে উপেক্ষা করে। মনে হয়, কথা না রাখার অপরাধবোধ থেকে, চলে যাওয়া ভাইটির কথা রাখার এই অক্লান্ত চেষ্টা যেন ওর।

আমি আপনজন হারিয়ে বেশ অভ্যস্ত। জীবনের শুরুই করেছি হারিয়ে ফেলাকে মেনে নিয়ে। বাবা, জোয়ার ভাই, পাপ্পা, আব্বা একে একে অনেক ভালবাসা ও নির্ভরতার আশ্রয়স্থল। তাই হৃদয়ের কোন একটা জায়গা কেমন যেন শক্ত, শীতল হয়ে আছে। শাকিল ভাই মারা যাওয়ায় আবার সেই স্থানটি যেন আরও শীতল হয়ে আমি আরও শক্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু স্বপ্নীল তার বাবা-মার খুব আদরের ছেলে, আপনজনের মৃত্যুকে দেখেছেও কম। শাকিল ভাই মারা গেলেন আমার শ্বশুর মারা যাবার কিছুদিন পর। পরপর বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যুতে স্বপ্নীল একদম ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এত ভেঙ্গে পরতে তাকে আমি কখনও দেখিনি। মনে হল এই পৃথিবীতে স্বপ্নীল যেন একদম একা হয়ে গেল। এই বয়সেই সে হয়ে উঠলো আমাদের সবার মাথার উপর ছায়া। কিন্তু স্বপ্নীলের মাথার উপর ছায়া হয়ে আর যেন কেউ রইলো না। ঐ একটা সময় খুব কষ্টকর গিয়েছিল। ওই সময় একজনের ভালবাসা, তার নিজের অজান্তেই আমার ও স্বপ্নীলের মাথার উপর দৃঢ় আশীর্বাদ ও ভরসার স্থল হয়ে উঠলো, আমাদের এই অসহায়ত্ব কাটাতে সাহায্য করলো তিনি আমাদের ছোট আপা। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।
আদর্শিক আন্দোলনগুলোতে আমার অংশগ্রহণ তাকে খুশি করতো। আদর্শিক আন্দোলন আর রাজনীতি মাঝে মাঝেই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়, তা যতই একই আদর্শভিত্তিক হোক না কেন। আমার সকল আক্ষেপ, অনুযোগ, বিরাগ, ক্ষোভ বলবার জায়গা ছিলেন শাকিল ভাই। এটা ছিল আমার এমন এক জায়গা যেখানে সবকিছু আমি বলতে পারতাম। আমাকে ভুল বোঝার কোন সম্ভাবনা ছিল না তার সাথে, আমার আবেগের জায়গাটা বুঝতেন ও নিজেও ধারণ করতেন, কোন ট্যাগ, লেবেলিঙ-এর ভয় ছিল না। আমার অনেক শঙ্কা দূর হতো তার সাথে একটু কথা বললেই। অনেক সিদ্ধান্ত নিতেও আমি পূর্ণ বিশ্বাসে তার সাহায্য নিতাম। মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারগুলোর জন্য নীরবে করতেন। মুক্তিযোদ্ধার গায়ে রডের বাড়ি পরেছে, শহীদ সন্তানের হাতে হাতকড়া, শহীদ পরিবারের জমি দখল হয়েছে, আমি ক্ষুব্ধ হয়ে ফোন করেছি, রাগ করেছি, তিনি ধৈর্য ধরে শুনেছেন, এতটুকু রাগ করেননি। শান্ত কণ্ঠে শুধু বলতেন, ‘দাঁড়া আমি দেখছি’। আমি জানতাম কিছু একটা বিহিত হবে। আড়ালে থেকে কতজনের জন্য যে কতকিছু করেছেন তা তার মৃত্যুর পরে অনুধাবন করেছি। শাকিল ভাই চলে যাওয়ায় আমার মাথার উপর সেই ছায়া যেন চলে গেছে। সব ছোট-বড় বিষয় নিয়ে সবার কাছে সব সময় বলা যায় না, অনুমতি থাকলেও বাধে, বিরক্ত করতে সংকোচ হয়। রাজনীতির বাস্তবতায় আমার আবেগের অনেক কথাই হয়তো অবাস্তব হয়। শাকিল ভাই-এর সাথে এই সংকোচ আমার ছিল না। আমি বিভিন্ন ঘটনায় তার অভাব খুব অনুভব করি।
প্রধানমন্ত্রীর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবার, শোষিত মানুষের প্রতি আবেগ সর্বজনবিদিত। অন্যদিকে শিক্ষা , সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতিও তার আগ্রহ সম্বন্ধে সকলেই অবহিত। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, শহীদ পরিবার, সংস্কৃতিকর্মী, তৃণমূলের ত্যাগী কর্মীদের প্রাত্যহিক জীবনের আশা-আকাঙ্খা, সমস্যা ও তার সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে যোগসূত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিলেন শাকিল ভাই। এই মানুষগুলো শাকিল ভাই-এর অভাব গভীরভাবে অনুভব করেন।
আমার জীবনের খুব অসাধারণ একটি উপহার আমাকে নিয়ে লেখা তার একটি কবিতা, যেটা তার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘মন খারাপের গাড়ি’-তে সংযুক্ত আছে। আমি সেটা পেয়েই উচ্ছ্বসিত ছিলাম। কিন্তু চলে যাবার মাত্র দু-তিনটা দিন আগে বলেছিলেন আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবেন। আমার মত মানুষকে নিয়ে কি লেখার আছে ভেবে না পেলেও, তার শক্তিশালী লেখনীর আখরে নিজের উপস্থাপন নিশ্চিতভাবেই আমার জন্য অনেক আগ্রহের উৎস ছিল। কিন্তু সেই উপহার আমার পাওয়া হল না, আক্ষেপ থেকেই গেল।
বড় অসময়ে চলে গেলেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অনেক কিছু দেয়ার ছিল। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় আক্ষেপ শাকিল ভাই-এর মত বিশ্বস্ত, আদর্শিকভাবে আপোষহীন মানুষ চলে গেল প্রধানমন্ত্রীর পাশ থেকে। অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন নেত্রীকে, বড় আপাকে। তার এই বিশ্বস্ততা আমাকে খুব স্বস্তি দিত। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কোন লোভ, কোন ভয়, কোন কারণেই শাকিল ভাই কখনও নেত্রীকে ভুল তথ্য দেবেন না, ভুল পরামর্শ দেবেন না। এমনকি, আপার অসন্তুষ্টির ঝুঁকি নিয়েও প্রয়োজনীয় কথা বলার সৎ সাহস ও আন্তরিকতা তার ছিল বলেই আমার বিশ্বাস। তাই আমার খুব মনে হতো তার মত একজন মানুষ আপার পাশে দরকার ছিল দীর্ঘ দিন। কিন্তু তা আর হল না।
তবু যেখানেই থাকুক শাকিল ভাই, যদি ওপার থেকে শুভকামনা জানানোর ক্ষমতা থাকে চলে যাওয়া মানুষগুলোর তাহলে বাংলাদেশের উপর, তার পরম শ্রদ্ধার বড় আপার উপর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপর, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের উপর তার শুভকামনা নিশ্চয়ই জড়িয়ে আছে সর্বক্ষণ। তার জন্য আমি সর্বান্তকরণে আল্লাহর কাছে দোয়া করি আল্লাহ যেন আমার অভিমানী, স্বপ্নচারী ভাইটিকে চিরশান্তিতে রাখেন।
