চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং উত্থান-পতন নিয়ে সেলিম জাহানের কথামালা

ড. সেলিম জাহান একজন কৃতি বাংলাদেশি। তিনি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের মূল লেখক টিমের অন্যতম সদস্য তিনি। এর আগে ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের উপপরিচালক হিসেবে নয়টি বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রণয়নের ‘কোর টিমের’ সদস্য ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে পড়াশোনা করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগেই দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৯২ সালে ইউএনডিপিতে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন। শিল্প-সাহিত্যের জগতেও রয়েছে তার সরব উপস্থিতি। রবীন্দ্রনাথের অর্থ-চিন্তা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন সেই ১৯৮৪ সালে।

কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই প্রভাষক একই সময়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক পলিসি’র ভিজিটিং স্কলার ছিলেন।

এছাড়া কিছুদিন পরিকল্পনা কমিশনে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।

তার স্ত্রী কিছুদিন আগে মারা গেছেন। সদ্যপ্রয়াত স্ত্রীর স্মৃতি ধারণ করা সেলিম জাহান ব্যক্তিজীবনে দুই কন্যা সন্তানের জনক। তার দুই কন্যাই দুটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত।

সম্প্রতি তিনি দেশে এসেছিলেন, তার ব্যস্ত সময়ের মধ্যে কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে।

শৈশব ও শিক্ষা জীবন
শৈশব, কৈশোর আর শিক্ষাজীবনের বেশিরভাগ সময় তার কেটেছে বরিশালে। মফস্ফলের একজন মানুষ হিসেবে তিনি গর্ববোধ করেন। সেসময়ের স্মৃতি জানিয়ে সেলিম জাহান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বরিশালের যেসব পথে হেঁটে গিয়েছি, সেপথে যদি আবারও হেঁটে যেতে পারতাম! সেখানকার মাঠ-ঘাট, নদী, বন্ধু ও পরিচিতরা এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

শিক্ষাজীবনে বেশি নম্বর আর সার্টিফিকেটের পেছনে না ছুটে, জানার ইচ্ছা থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন বলে জানান তিনি। ১৯৬৯ সালের আগ পর্যন্ত তিনি বরিশালেই ছিলেন। ষাটের দশক থেকে সারাবিশ্ব জুড়ে যে উত্তাল সময় আর শিল্পসাহিত্য বিষয়ক নানামুখী যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তার উত্তাপ পাচ্ছিলেন বরিশালে থেকেই। এরপরে উচ্চশিক্ষা অর্জনে ঢাকায় আসা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন
বরিশাল থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন তিনি। স্যার সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের যাত্রা শুরু করেন।

সেই সময়ের বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতির কথা উল্লেখ করে সেলিম জাহান বলেন, ৬৯ এ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি তখন সারা ঢাকা শহর উত্তাল। আমরা সেই উত্তাপ পাচ্ছিলাম। আইয়ুব খানের পতন হয়েছে, মার্শাল ল জারি হয়েছে। নানা ঘটনাবহুল সেই সময়। তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বে তখন নানা ঘটনা ঘটে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সঙ্গে ন্যাশনাল গার্ডের সংঘর্ষ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, চাঁদে মানুষ নেমেছে, নানা সৃষ্টিশীল ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা চলছে, সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করাটা ছিল এক অন্যরকম ব্যাপার।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া সর্ম্পকে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যা শিখেছি তা শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্লাসের চেয়ে ক্লাসের বাইরে বেশি শিখেছি। বন্ধুবান্ধব-সহপাঠী, সিনিয়র এমনকি ক্যান্টিনে আড্ডা দিতে আসা কবি-সাহিত্যিক উনাদের কাছে থেকেও অনেক শিখেছি। সবার সঙ্গে কোন কিছু শেয়ার করার মানসিকতা সেসময় সবার মধ্যে অনেক ছিল। নতুন কোন বিষয় বা বই এলে, বন্ধুরা বলতো ‘এই বই পড়েছ, ওটা জান কি?’। এভাবেই কেটেছে শিক্ষাজীবন।

মুক্তিযুদ্ধের আগে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষাজীবন শুরু, মুক্তিযুদ্ধের পর শিক্ষা জীবন শেষ করে সেখানেই দীর্ঘ ২০ বছর শিক্ষকতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে এখনও অতি আপন ভাবেন সেলিম জাহান।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি
১৯৭১ সালের মার্চের আগ পর্যন্ত প্রায় পুরোটা সময়ই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বারুদের পাহাড়ে বোমা ফেঁটে গেলে যেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, উত্তাল মার্চে সংসদ অধিবেশ বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঢাকা শহরে সে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল বলে জানান তিনি।

সেসময় ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি দেখা ও শোনার গর্বভরা স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মার্চের ২১ তারিখ পর্যন্ত আমি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই ছিলাম। সেসময়ের সবচেয়ে আলোচিত সেই ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের স্মৃতি আমার কাছে অনেক মূল্যবান। অনেকদিন ধরেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে নানা আলোচনা চলছিল, ৭ মার্চের দিন আমি দিনের বেশিরভাগ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতেই ছিলাম। এখনকার মতো লোহার গ্রিল ছিল না লাইব্রেরিতে, পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলে আমরা বাইরের ওই বারান্দায় গিয়ে বসতাম। আমার পরিকল্পনা ছিল ওখানে বসেই ভাষণ শোনা। ভাষণ দেবার স্থানটি রেসকোর্স ময়দান হওয়ায় সবদিকে ছিল খোলা, এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দেখা যেত। আমরাও বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি থেকে দেখছিলাম সবকিছু। বেলা যতই বাড়তে থাকল ততই জনসমাগম বাড়তে থাকল। তিন জন চার জন করে করে ছোট ছোট দলে বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ আসতে থাকল। এখন যেমন কোন সমাবেশে দলে দলে মানুষ মিছিল ও ব্যানার নিয়ে আসে, তেমন ছিল না বিষয়টি। আমাদের ধারণা ছিল না ঠিক কত লোক আসবে। কিন্তু সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু মানুষের কালো মাথা। মাঠে, রাস্তায়, আশেপাশে যেন জনসমুদ্র। এভাবেই সবাই নিজ তাগিদে চলে এলো। ভাষণ দেবার আগ মুহুর্তে এক ধরণের চাপা উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত নিরবতা ছিল। এরপরে বঙ্গবন্ধু যখন এলেন, সে এক দেখার মত দৃশ্য!’

বাবার সঙ্গে সেলিম জাহান (১৯৯০ সাল)
বাবার সঙ্গে সেলিম জাহান (ফেসবুক থেকে পাওয়া)

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতি জনগণের আকর্ষণের কারণ ও ভাষণের মুগ্ধতার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘সবার মোটামুটি ধারণা ছিল যে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেবেন। সেরকমই আলোচনা ছিল চারিদিকে। এরপরে শুরু হলো বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, এই অংশটুকু তার ভাষণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলেও তার পুরো ভাষণ জুড়ে ছিল এক অসাধারণ ধারাবাহিকতা। কোনো ধরণের ড্রাফট ও লেখা ছাড়া একটি ভাষণে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যেমন ছিল সংযত অথচ শক্ত, ছিল উদাত্ত আহ্বান সঙ্গে সতর্কবার্তা। আমি বন্ধুদের সঙ্গে পুরো ভাষণটি শুনেছি লাইব্রেরির দোতলা থেকে। সে অনুভূতি ভোলার না।’

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরে নানা ঘটনাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। জুলফিকার আলি ভুট্টো এসেছিলেন, সুগন্ধায় বৈঠক, বাইরে থেকে নেতাদের আসা যাওয়া দেখেছেন তিনি।

তিনি বলেন, চারিদিকে নানা গুজব আর জল্পনাকল্পনার ডালপালা। এসবের মধ্যে ভুট্টো এসেছিলেন ঢাকাতে, সুগন্ধার বাইরে অনেক লোক। কী হয় কী হয় উৎকন্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিল মানুষ। সেসময়ের একটি কথা আমার মনে আছে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা একে একে প্রবেশ করছেন। তাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। তাজউদ্দীন আহমেদকে দেখলাম হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করছেন। তিনি প্যান্টের সঙ্গে পাঞ্জাবি গুজে তাড়াহুড়া করে প্রবেশ করছেন। প্রস্তুতি নেবার কোনো সুযোগ না দিয়ে নানা ঘটনা যে কতো দ্রুত ঘটে যাচ্ছে, সে দৃশ্য দেখে উপলব্ধি করছিলাম। মার্চের ২১ তারিখে বাবার ডাকে বরিশালে ফিরে যাই, এরপরে শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ।

অস্ত্র হাতে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও বরিশালে ও প্রত্যন্ত গ্রামে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে গেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন বলে জানান। গ্রামে বসে যুদ্ধের খবর ও অগ্রগতি জানার বিষয়ে তার রয়েছে মিশ্র অনুভূতি।

‘মুক্তিযুদ্ধের খবর পাবার একমাত্র মাধ্যম তখন ছিল বেতার। আমাদের বাড়িতে একটি রেডিও ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিবিসি, জাপান বাংলা, অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং, জার্মান বাংলা রেডিওতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের খবর পেতাম। তবে ভয়েস অব আমেরিকা একদমই শুনতাম না, শুনলেও তা বিশ্বাস করতাম না। কারণ তাদের সেইসব খবরের সঙ্গে পাকিস্তান রেডিও’র মিল ছিল। আমরা বুঝতে পারতাম, সেগুলো মিথ্যায় ভরা।  এমআর আখতার মুকুলের মজার উপস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতাম। এছাড়া পরিচিত অনেক শিল্পী-সাহিত্যিকরা ছদ্মনামে বিভিন্ন কিছু পরিবেশন করতেন, কিন্তু আমরা তাদের কণ্ঠ চিনতাম। বুঝতাম কে কী বলছেন।  তবে বিভ্রান্তি আর উৎকন্ঠাও ছিল অনেক!’

তিনি আরও বলেন, ‘মার্চের শেষদিক থেকে খবর আসতে শুরু করল যে, প্রচুর হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এছাড়া মানুষের মনে সেসময় আরেকটি বড় প্রশ্ন ছিল। ‘বঙ্গবন্ধু কোথায়? তাকে কি মেরে ফেলা হয়েছে? নাকি আটক করা হয়েছে?’ নানা গুজব ছিল চারিদিকে। মার্চ পেরিয়ে ১৭ এপ্রিল যখন মুজিবনগর সরকার গঠন করা হলো, সেখানে দেখা গেল বঙ্গবন্ধু নেই। এরপরে আমরা জানতে পারলাম, তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এবং এই খবরটি আমরা রেডিও পাকিস্তানের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম। এরপরে দিন মাস যতই যাচ্ছিল, উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছিল।  কখনও খবর আসছিল মুক্তিযোদ্ধারা কোনো অভিযানে সফল হয়েছে, আবার কখনও মার খাচ্ছে। এসবের সঙ্গে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে থাকলো, কতো দিন চলবে এই যুদ্ধ? কারণ ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলছে প্রায় ২০ বছর ধরে। তবে বর্ষাকাল আসার পর থেকেই বদলে যেতে থাকে যুদ্ধের চালচিত্র।  সাফল্য আসতে শুরু করে দারুণ গতিতে। পাকিস্তানিরা যুদ্ধে যেমন প্রথাগত কৌশল অবলম্বন করেছিল, আর বাঙালিরা অবলম্বন করেছিল গেরিলা যুদ্ধের কৌশল।  যুদ্ধের একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল ‘হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল অপারেশন’। ওই অপারেশনের খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের সক্ষমতা সর্ম্পকে বিশ্বাস শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আমরা গ্রামে বসেও যেন বিজয় অনুভব করতে শুরু করি।’

তরুণ সেলিম জাহান
তরুণ সেলিম জাহান (ফেসবুক থেকে পাওয়া)

মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি ও কূটনৈতিক বিষয় সর্ম্পকে তিনি বলেন, যুদ্ধের সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে আমরা একটা জিনিসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সেটা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি। কবে ভারত স্বীকৃতি দেবে? কবে বিভিন্ন দেশ সাহায্য করবে? এইসব নিয়ে ভাবতাম আমরা। সেইসঙ্গে বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত/প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদের খবর আমরা পাচ্ছিলাম বিভিন্ন বেতারের খবরে। নিউইয়র্ক টাইমসে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, গার্ডিয়ানে প্রকাশ হয়েছে, এসব খবরে আমরা বুঝতে শুরু করেছিলাম বিশ্ব আমাদের যুদ্ধকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এরপর মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড টেড কেনেডি বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কলকাতা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে এসেছিলেন। নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরের ৩ (ঠিক মনে করতে পারছিলেন না) ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এসেছিলেন। আমরা আশায় বুক বাঁধলাম, হয়তো ঘোষণা আসবে স্বীকৃতির। ইন্দিরা গান্ধী প্যারেড গ্রাউন্ডে ভাষণ দিলেন কিন্তু কিছু বললেন না। এরপর খবর এলো তিনি জরুরি ভিত্তিতে দিল্লীতে যাচ্ছেন। সেসময় পাকিস্তান ভারতে আক্রমণ করেছে। দিল্লীতে গিয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘যেহেতু পাকিস্তান আমাদের আক্রমণ করেছে, আমরা এর জবাব দেবো।’ স্বীকৃতি না পেয়ে আমরা বেশ হতাশ হয়েছিলাম! তারপরে সে স্বীকৃতি আসতে আসতে ৬ ডিসেম্বর। এরপরে বিষয়গুলো খুব দ্রুত ঘটতে শুরু করলো। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিজয়ের খবর আসতে শুরু করলো। অপেক্ষায় ছিলাম ঢাকায় কী হচ্ছে তা বুঝতে। বেতারে খবর পেলাম পাকিস্তান বাহিনী আত্মসর্মপণ করেছে। তবে সেসময়টা আমাদের জন্য ছিল অনেক বিভ্রান্তির। কারণ ১৪ ডিসেম্বর থেকে পুরো ডিসেম্বরই ছিল ঘটনাবহুল। বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সেগুলোর নানা ঘটনার বিবরণ আমরা পরে শুনেছি। কিছু জিনিসতো পারিবারিক সূত্রেই জানতে পেরেছি। কীভাবে মুনীর চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, কারা ছিল সেসময়, নানা বিষয়!

দীর্ঘ ৯ মাস পরে বহুল কাঙ্খিত বিজয়ের পরে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসা। সেসময়ের স্মৃতি সর্ম্পকে তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে ক্যাম্পাসে ফিরে এসে এক বদলে যাওয়া পরিস্থিতির মুখোমুখি হলাম। কেমন রেখে গিয়েছিরাম আর কেমন পেলাম। তাছাড়া আরেকটি বিষয়, তখন শুধু খুঁজে দেখছি কে আছেন কে নেই? বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে যেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে সেখানে রক্তের দাগ তখনও ছিলে, লাশ টেনে নেবার দাগ। বন্ধুদের মধ্যে অনেকের শহীদ হবার পেলাম। একজনের কথা মনে পরে নিজাম উদ্দিন আজাদ, সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। ছাত্র রাজনীতিতে সেসময়ের পরিচিত মুখ ছিল সে। আরেকজন লুৎফুল মতিন, আমাদের এক বছরের সিনিয়র ছিল। এছাড়া বরিশালের অনেক বন্ধু মিসিং ছিল। তারপরে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সর্ম্পকে খবর পেতে থাকলাম। মুনীর চৌধুরি, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরি এদের সবাইকে দেখতাম।  বাংলা বিভাগের অনেক শিক্ষক বেশ মুখচেনা ও তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমরা যেতাম, তাদের কথা শুনতাম। আমার প্রত্যক্ষ শিক্ষকদের মধ্যে পরিসংখ্যান বিভাগের মনিরুজ্জামান, এছাড়া অধ্যাপক রাশেদুল হাসান মারা গেছেন।  খতিয়ানের মতো, কে আছে কে নেই।  এছাড়া বেঁচে থাকা শিক্ষকদের মধ্যে মুখচেনা অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান উনারাতো সরাসরি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে উনারা পরিকল্পনা কমিশনে চলে যান। আবার নতুন করে পড়ালেখা শুরু হয় ক্যাম্পাসে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বদলে যাওয়া সমাজ
মুক্তিযুদ্ধের পরে সমাজের নানা ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন আসতে শুরু করে, যা চোখে পড়ে সেসময়ের তরুণ সেলিম জাহানের চোখে।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেলিম জাহান (ফেসবুক থেকে পাওয়া)
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেলিম জাহান (ফেসবুক থেকে পাওয়া)

তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে একটি বিষয় আমার এখনও মনে আছে, তা হচ্ছে মানুষের ভোল পাল্টে ফেলা। যে মুক্তিযুদ্ধ করেনি সেও নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করতে থাকল। আর যে ও যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং রাজাকার, আল বদর, আল শামস ছিল তারাও নিজের পরিচয় গোপন করছে। এ পরিস্থিতি আমি ঢাকা ও বরিশাল দু’জায়গাতেই দেখেছি। এর কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে, আমাদের সমাজতো সমস্বত্ত্ব সমাজ। পক্ষে বিপক্ষের সবাইতো আসলে কোন না কোন পরিবারের সদস্য। এমনও দেখা গেছে একই পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর আরেকজন বিপক্ষে। ভাই বা বন্ধু ভুল করেছে বলে ক্ষমা করা হয়েছে ও মেনে নেয়া হয়েছে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের অনেক জিনিসের নিষ্পত্তি সেসময় হয়নি। আরেকটি বিষয় ছিল সেটি হচ্ছে প্রতিহিংসা। ধরুন, আপনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ ছিল, যার মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে কোনো সর্ম্পক নেই বা পক্ষে-বিপক্ষের কোনো সর্ম্পক নেই। তারপরও আমি সুযোগ নিয়ে আপনার ক্ষতি করলাম। এরকম বহু ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

দুর্যোগ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নানা ঠিক-বেঠিক ঘটনা ঘটলেও সেগুলোর বিচার হওয়া উচিত ছিল উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, দুর্যোগ ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ধরণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু যখন পরিস্থিতিতে একটা স্থিতি আসে, বা একটি কাঠামো দাঁড় করানো হয় তখন কিন্তু বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হয়। এই ধরুন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে ইহুদি নিধন চলেছে, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। নূরেমবার্গ ট্রায়াল হয়েছে, এডলফ আইখম্যানকে আর্জেন্টিনা থেকে ধরে আনা হয়েছে। বিষয়গুলোর বিচার হয়েছে। আমাদের এই জিনিসটি হয়নি। এই জিনিসটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরপরই না হবার কারণে অনেক বিষয়ে আমরা থেমে আছি। বিষয়গুলো নিষ্পত্তি না হবার কারণে এখন আমাদের পেছনে গিয়ে গিয়ে সেগুলো করতে হচ্ছে। এরমধ্যেই আবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো, তাজউদ্দিন আহমেদসহ চার নেতাকে হত্যা করা হলো। একের পর এক নতুন নতুন সঙ্কট যুক্ত হতে থাকলো। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন আহমেদ ওনাদের হত্যাকাণ্ডকেও আমি আসলে বাংলাদেশের বিরোধীপক্ষের আঘাতের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখি। এদেশকে একেবারে শেষ করে দেবার চেষ্টা। বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের আরও অনেক ভাবার আছে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী আরেকটি বিষয় সামনে এনে তিনি বলেন, একটি বিষয় আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ৪৭ পরবর্তী যে প্রজন্ম যারা পাকিস্তানের দাবিতে সংগ্রাম করেছিল তারা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিলেন। তাদের সংগ্রামের কারণ ছিল, তারা মনে করতো মুসলমান হিসেবে এই ভূখন্ডে বাস করে তারা নির্যাতিত ও পিছিয়ে আছে, তাদের আলাদা রাষ্ট্র দরকার। এটা তারা হয়ত নিজেরা বুঝতে পেরেছিল নয়তো তাদের বুঝানো হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের তৈরি। কিন্তু পাকিস্তান যে ব্রিটিশদের একটি ধোঁকা, এটা যে ডিভাইড এন্ড রুলের শেষ পর্যায় এটা বুঝতে পারেনি কেউ। ধর্মের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র তৈরি হলে সেটাযে কী ভয়াবহ হতে পারে, তার ভুক্তভোগী সেসময়ের বাংলাদেশের মানুষ। তবে এটাও ঠিক ওইসময়ের পঞ্চাশের বেশী বয়সীরা সেসময় মুক্তিযুদ্ধকে বা পাকিস্তান ভেঙে আলাদা রাষ্ট্র মেনে নিতে পারেনি। যেমনটি আমি পাকিস্তানকে মেনে নিতে পারিনি তাদের সেসময়ের আচরণ ও বঞ্চনার মানসিকতার কারণে। যদিও অনেকে বলতে পারেন, সেসময়ের পাকিস্তানি আর এখনকার পাকিস্তানিদের মানসিকতা নিশ্চয় এক না! তারপরেও তাদের বেসিক চিন্তার কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আছে বলে আমার মনে হয় না। আবার আমার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পাকিস্তানিরা হয়তো সেরকম নাও মনে হতে পারে, কারণ তাদের কাছে পাকিস্তানিদের ভাবমূর্তি হয়তো আমার কাছ থেকে শোনা। কিন্তু ৭১ আমার দেখা ও সরাসরি উপলব্ধি।

৭১ এর পরে প্রজন্মের চিন্তাভাবনা সর্ম্পকে সেলিম জাহান বলেন, নতুন দেশের নতুন প্রজন্মের সামনে নানা স্বপ্ন নানা আকাঙ্খা। ওইসময় (৭১-৭২) আমাদের ছিল প্রচণ্ড আবেগ, তা যে সবসময় ঠিক বা ভুল ছিল তা বলছি না। কারণ আবেগের একটা মূল্যতো অবশ্যই আছে।  তবে ৯০ এর দশকে আমি পরিণত ছিলাম, সেসময় কোনটা ভাল, কোনটা করা উচিত তা ভেবে কাজ করেছি। যেমনটা ৭১ পরবর্তী প্রজন্ম করতে পারেনি অনেকাংশে। ধীরে ধীরে চিন্তায় কর্মে পরিণত হতে হয়েছে।  এটা খুবই স্বাভাবিক।

(পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত)