দেশের তরুণদের সবচেয়ে বড় সম্পদ উল্লেখ করে তারা অনলাইন জুয়ার আসক্তির মতো সর্বনাশা নেশায় মেতে উঠেছেন জানিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন চাকরিবিষয়ক ওয়েবসাইট বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী ফাহিম মাশরুর।
‘অনলাইন বেটিং, নতুন শেয়ার মার্কেট : প্রদীপের নিচে অন্ধকার’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন:
“বাংলাদেশে এখন জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি ৯০ সনের পরে জন্মগ্রহণ করেছে। পৃথিবীর খুব কম দেশেই অনুপাতটা এরকম। এর অর্থ আমরা একটি ‘তারুণ্যের দেশ’। সব উন্নত দেশ (ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, জাপান) এখন যেখানে চিন্তিত তাদের জনসংখ্যার মধ্যে তারুণ্যের অভাব নিয়ে, সেখানে ‘তারুণ্য সম্পদ’ আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। এটিকেই অর্থিনীতিবিদেরা বলে থাকে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’।
গত কয়েক বছরে দেশের এই তারুণ্যকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবহার করা যায় সেটির জন্য পরিকল্পনা হচ্ছে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে প্রকল্প হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে এই তরুণরা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে – এই স্বপ্ন আমরা দেখা শুরু করেছি। সোশ্যাল মিডিয়া, আউটসোর্সিং, ফ্রীল্যানসিং এই কথাগুলো আমরা প্রতিদিন শুনছি আর ভাবছি এবার আসলেই কিছু হচ্ছে। শুধু দেশে না, সারা দেশজুড়ে তরুণরা এগিয়ে যাচ্ছে।
এগুচ্ছে, নিশ্চয় এগুচ্ছে – ‘জুমশেপার’এর কাওসারের মতো তরুণদের এগিয়ে যাবার খবর পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখে আমরা আশাবাদী হই। এরকম আরো হাজারো তরুণ দিন রাত তাদের স্বপ্ন নিয়ে প্রানপন চেষ্টা করে যাচ্ছে।
কিন্তু সংবাদপত্র হয়তো আজকাল অনেক কিছুই দেখছে না! দেখছে না, এই তারুণ্যের প্রদীপের নিচে ‘ভয়ানক’ এক অন্ধকার তৈরী হয়েছে!
মূল কোথায় আসি – কিছু দিন ধরে আমার ফেসবুক ফিডে কয়েকটি কিছু টুক-টাক খবর আর কমেন্ট দেখে একটা ব্যাপারে আগ্রহ জন্মালো এবং একটু খবর নেওয়া শুরু করলাম। ২টি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ হলো।
১) নভেম্বর মাসের প্রথম দিক থেকে হঠাৎ করে নেটেলার/পেপাল ডলারের (এই ডলার ব্যালান্স অনেক ফেসবুক ই-কমার্স উদ্যোক্তা ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেবার জন্য ব্যবহার করে) দাম বেড়ে যায়! কারণ হিসাবে অনেকে বললো – বিপিএল শুধু হয়েছে!
২) Alexa ranking -এ bet365. com সাইটটি হটাৎ করে এই মাসে বাংলাদেশে ১৫ নম্বরে চলে আসলো যেখানে Bdnews24. com এর মতো জনপ্রিয় সাইট এর ranking ১৮!
ছোট একটি পোস্ট দিলাম দুই দিন আগে আমার ফেসবুক পাতায়। অনেকেই প্রাইভেট মেসেজ পাঠালো কিছু তথ্য দিয়ে যা আসলেই ভয়াবহ! যেটি জানতে পারলাম তা হচ্ছে এরকম –
“দেশে গত দুই-এক বছর ধরে গ্রামে গঞ্জে এখন ‘অনলাইন বেটিং/জুয়া’ শুরু হয়েছে। কম বয়েসী তরুণ ছেলেরা সহজে টাকা কমানোর নেশায় এর সাথে জড়িয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা যত না বেশি শহর কেন্দ্রিক, তার থেকে বেশি গ্রাম/উপশহর কেন্দ্রিক। এদের কাছে bet365. com সাইটটি খুবই জনপ্রিয় একটি অনলাইন বেটিং সাইট। যেকোনো স্পোর্টস ইভেন্ট (দেশি বা বিদেশী) শুরু হলেই এই জুয়া খেলার পরিমান বেড়ে যায়। বেটিং সাইট গুলোর পেমেন্ট হয় ডলারে। নেটেলার একাউন্ট থেকে এই ডলার লেনদেন হয়। বিপিএল শুরু হবার কয়েক দিন আগে থেকেই অনেকে ডলার মজুদ করা শুরু করে এবং সেই জন্য ডলারের দাম হঠাৎ করে বেড়ে যায়! গত কয়েকদিন ব্যাপক হারে অনলাইন-এ এই জুয়ার আসর চলছে!
ব্যাপারটা আমার কাছে প্রথমে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বেশ কিছু তরুণ আমাকে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা জানানোর পরে আমি এটি বিশ্বাস না করে পারলাম না। কেউ কেউ জানালো তাদের চোখের সামনে অনেককে গত কয়েক মাসে সর্বস্বান্ত হতে দেখেছে। এর সবাই দৰিদ্ৰ পরিবারের এবং লোভে পরে সহজে টাকা উপায় করার জন্য এই বেটিং-এ যোগ দিয়েছিলো। ঘটনাটা যে কাউকেই মনে করিয়ে দিবে ২০১১ সালের ঢাকার শেয়ার বাজারের কথা- যেখানে লাখ লাখ পরিবার তাদের সর্বস্ব হারিয়েছে ‘জুয়ার’ এই ভয়ঙ্কর নেশায় পরে। ব্যাপারটি ছিল শহর কেন্দ্রিক। আমাদের সবার চোখের সামনে হলেও আমরা ঠেকাতে পারি নি সেই বিপর্যয়। আর অনলাইন বেটিং/জুয়ার এই জিনিস ঘটছে গ্রামে গঞ্জে , আমাদের চোখের আড়ালে!
ব্যাপারটা দুই কারণে ভয়াবহ। প্রথমত- এর মাধ্যমে হাজার হাজার লোক নিঃস্ব হচ্ছে এবং হবে। পশ্চিমা বিশ্বে অনেক দেশে অনলাইন ‘বেটিং/জুয়া’ একটি আইনসিদ্ধ ব্যাপার, কেননা সেখানে এটি একটি নিছক ‘বিনোদন’। কিন্তু আমাদের মতো গরিব আর বেকার দেশে এটি বিনোদন নয়- সহজে টাকা বানানোর ‘হাতছানি’। দ্বিতীয়ত -এবং যেটি আমার এই পোস্টার প্রথম অংশের সাথে সম্পর্কিত – এই পুরো ব্যাপারটিই হচ্ছে আমাদের দেশের তরুণদের কেন্দ্র করে – যাদের উপর আমরা সবাই স্বপ্ন দেখছি। কোথায় চলে যাচ্ছে আমাদের তারুণ্য? কোন অতল গহ্ববরে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের সৃজনশীলতা আর কাজের স্পৃহা?
আমরা কি আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদকে এভাবে ধ্বংস হতে দিবো?”