সম্প্রতি দেশজুড়ে বয়ে যাওয়া রেকর্ড কম তাপমাত্রা সহকারে শৈত্যপ্রবাহের পরে ধীরে ধীরে উঞ্চ হয়ে উঠছে আবহাওয়া। ঋতু পরিবর্তনের খেলায় শীতকাল চলে গিয়ে আসছে বসন্তকাল। ঋতুর মতো রাজনৈতিক পালাবদলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে আবহাওয়ার মতো দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়াও গরম হয়ে উঠছে। সেই গরম রাজনৈতিক পরিবেশে লু হাওয়া আনতে শুরু করেছে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নামে দায়েরকৃত জিয়া অরফানেজ মামলা রায়ের তারিখ। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ হবে ওই রায়।
৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ৬ জনের রায় ঘোষণা হবে। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিন সরকারের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় দায়ের করা ওই মামলায় খালেদা জিয়াসহ ৬ আসামি হলেন- তার বড় ছেলে তারেক রহমান, মাগুরার সাবেক বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য কাজী সলিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও শহীদ জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর বকশীবাজারের বিশেষ আদালত ৫ এর বিচারক ড. আখতারুজ্জামান মামলার রায় ঘোষণার জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করে দেন।
সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও বিএনপির শীর্ষনেতাদের পাল্টাপাল্টি নানা মন্তব্যে জনগণের মধ্যে নানামুখি উৎকণ্ঠা আর বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন, ‘৮ ফেব্রুয়ারি কী হবে?’। আদালতের রায়ের বিষয়ে আইনজীবী ও রাজনীতিবিদরা নানামুখি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছেন। সংবাদপত্রের উপ-সম্পাদকীয়, অনলাইনের মতামত কলাম আর টেলিভিশনের টক-শোগুলোও জনগণের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তবে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আসলে অপেক্ষা করতে হবে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
ওইদিন যদি রায় হয় এবং ২ বছরের অধিক সাজা হলে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। একথা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের এ কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগসহ তাদের জোট নেতারাও তেমনটিই ভাবছেন। প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বৈঠকে তারা বক্তব্য দিচ্ছেন ৮ ফেব্রুয়ারির রায়কে কেন্দ্র করে। সেইসঙ্গে রায়ের পরে সম্ভাব্য কোনো ধরণের সহিংসতার বিষয়ে হুশিয়ারিও দিচ্ছেন তারা।
অন্যদিকে বিএনপি ও শরীক জোটের নেতারাও ধরেই নিয়েছেন রায়ে সাজা হবে খালেদা জিয়ার। সাজা হলে নির্বাচনে অযোগ্য হবেন, সে আশঙ্কায় তারা তাদের নেত্রীকে ছাড়া নির্বাচন হতে দেবেন না বা নির্বাচনে যাবেন না বলে বক্তব্য দিচ্ছেন। এছাড়া ‘কঠোর আন্দোলন’ করারও ঘোষণা দিচ্ছেন। যদিও বিএনপির এধরণের আন্দোলনের সক্ষমতা নিয়ে বরাবরের মতো সন্দেহ রয়েছে বিভিন্ন মহলে, এ বিষয়ে তারা হালকা-রসিকতারও শিকার।
কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের জবাব খুঁজলে ৮ ফেব্রুয়ারির রায় ও রায় পরবর্তী পরিস্থিতির একটি সাধারণ প্রেক্ষাপট বোঝা যাবে। প্রশ্নগুলো হলো- মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হবে কিনা, সাজা হলে কী হবে, না হলে কী হবে, নিম্ন আদালতে সাজা হলেই খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য হবেন কি না, সাজা হলে উচ্চ আদালতে আপিল করার পর কী হবে, নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালত স্থগিত করলে বা না করলে কী হবে, স্থগিত না হয়ে উচ্চ আদালতে শুধু বিচারাধীন থাকলে কী হবে বিএনপিতে ভাঙন হবে কি, বিএনপি ছাড়াই কি আবারো একতরফা নির্বাচন হবে?
দেশের রাজনীতির ইতিহাস বলে, দিন-তারিখ নির্ভর কোনোধরণের উত্তাপ আসলে শেষ পর্যন্ত তেমনকোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। যেহেতু আরেকটি মামলায় হাজিরা শেষে খালেদা জিয়া আদালত থেকে ফেরার পথে পুলিশের ওপর হামলা ও প্রিজন ভ্যান থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে, সেজন্য জনগণসহ সবার নজর ওইদিনকে ঘিরে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে ৮ ফেব্রুয়ারি আসলে তেমন কিছু হবে বলে মনে হয় না। বড় বড় ঘটনা আসলে হঠাৎ করেই হয়েছে অতীতে।
বিএনপি ৮ ফেব্রুয়ারি লাখ কর্মী সমাবেশের/জমায়েতের ঘোষণা দিয়ে আসছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ রাজধানীতে বিশেষ সতর্কতা জারি করেছে। যে কোন নাশকতা ঠেকাতে সতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সন্দেহভাজন আবাসিক হোটেল মেসবাড়ী ও বস্তিতে চলছে অভিযান। রায়ের দিন ভোর ৪টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত রাজধানীতে সব ধরনের বিস্ফোরক, অস্ত্র ও লাঠিসোটা বহন এবং রাস্তা বন্ধ করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছেন ঢাকার পুলিশ কমিশনার। অলিখিত আরেকটি বিষয় ঘটে এধরণের দিন-তারিখ ভিত্তিক আন্দোলন কর্মসূচি ও বড় ইস্যুকে ঘিরে, তা হলো বিনা নোটিশে রাজধানীর গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। আন্ত:জেলা ও নগর পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় অফিসমুখী জনগণকে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এদিনও তেমনটিই হবে বলে মনে হচ্ছে। নিরাপত্তার চাদরে য়াকা থাকবে রাজধানী। তবে মফস্ফল জেলা ও থানাশহরগুলোতে সংহিসতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে অতীতের এধরণের কর্মসূচির ফলাফলে দেখা ধারণা করা হচ্ছে।
সিনিয়র ও মাঠের আন্দোলনের বিভিন্ন নেতা ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটকের কারণে বিএনপি ও শরীকজোটের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাদের মধ্যেও ‘কী হবে, কী করবো’ ধরণের দ্বিধা থাকায় তারাও অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন। আন্দোলন করে খুব একটা সুবিধা করা যাবে না, দীর্ঘ ৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে এটা তারাও বুঝতে পারছেন হাড়ে হাড়ে।
বিএনপি নেতারা তাদের মতো করে নানা বক্তব্য দিলেও খালেদা জিয়া দলের নির্বাহী সভায় যে বক্তব্য দিয়েছে তা লক্ষ করার মতো। ওই সভায় তিনি বলেছেন, ‘নিম্ন আদালত সরকারের কবজায়। সরকারের কথার বাইরে তাদের হাজারও চিন্তা থাকলেও সঠিক রায় দিতে পারবে না। বিচার বিভাগ আজ স্বাধীন নয়। তারা সবচেয়ে বেশি পরাধীন। তারা হকুমের আদেশে থাকেন। শেখ হাসিনা নিজেকে এখন আল্লাহর পরের স্থান হিসেবে বিবেচনা করে। সে যখন যা ইচ্ছা করবে এ দেশে তাই হবে! কিন্তু ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়।’ রায়কে ঘিরে তার দলের মধ্যে ষড়যন্ত্র ও ভাঙ্গনের সুরও তিনি টের পেয়েছেন। সেজন্য ‘বেঈমানি করলে ক্ষমা নেই’ বলেও হুশিয়ারি দিয়েছেন। সবশেষে তিনি দলের নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা জানি আমরা জুলুমের শিকার হচ্ছি। মানুষ ভালো নেই। সর্বত্র অরাজকতা। আমাদের নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে ঘায়েল করা হচ্ছে। গুম-খুন, হামলা নিত্যদিনের ঘটনা। দেশে কোন গণতন্ত্র নেই। মানুষের মৌলিক অধিকার নেই। এই অবস্থায় আমাদের আন্দোলন করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নামতে হবে সবাইকে। আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করি। দেশের মানুষকেও আহ্বান জানাই। তবে এ আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে।’
২০১৩ সালের ৪ মাস আর ২০১৫ সালের প্রথম ৯৩ দিন বিএনপি আন্দোলনের সময় পেট্রোল বোমা আর আগুন সন্ত্রাস দেশের মানুষ যে পছন্দ করেনি, তা হয়তো খালেদা জিয়া বুঝতে পেরেছেন। রায়ে যাইহোক, খালেদা জিয়া ও বিএনপি হয়তো তা আইনত ও রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করবে।
বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তা মোটামুটি নিশ্চিত। তারা খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণে ও সমতার ভিত্তিতে নির্বাচনী ক্যাম্পেইন করার সুবিধার কথা বলে আসছেন অনেকদিন ধরে। তাছাড়া আরেকটি ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচনের রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সাহস কোনোটাই আওয়ামী লীগের নেই বলেও মনে হচ্ছে। আর্থ-সামাজিক ও জনগণের অবস্থার পরিবর্তনের কারণে জ্বালাও-পোড়াও-ভাঙচুরের সংস্কৃতি পছন্দ করে না দেশের মানুষ। গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার থেকেও দীর্ঘদিন বাইরে থাকাও পছন্দ না তাদের। সবমিলিয়ে দেশের জনগণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে আরেকটি নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে, এই পরিস্থিতি মাঠ দখল আর মাঠের রাজনীতি নিজেদের দিকে রাখতে ৮ ফেব্রুয়ারি একটি পেন্ডুলামের মতো কাজ করছে।
বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর দায়-দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও অনেক দায়-দায়িত্ব রয়েছে। সব দলগুলো দেশের ভবিষ্যত চিন্তা করে, জনগণের স্বার্থ ভেবে ও নিজেদের ভাবমূর্তি বিবেচনা করে বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন বলে আশা করা যেতেই পারে। সবকিছু ছাপিয়ে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সুস্থ ও সুষ্ঠু ধারায় গণতান্ত্রিক পথে চলুক, সাধারণ জনগণ তাই প্রত্যাশা করছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)