জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার এই চার মূলনীতি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথাই বলেছেন। তিনি বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কথা বলেছেন। তার বক্তৃতায় বাঙালি জাতির উপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাষকদের নির্যাতনের করুণ বর্ণনা দিয়েছেন। একই সাথে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বাঙালি জাতির গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি তুলেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণে শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্রের প্রতিফলনও আমরা দেখতে পাই। তিনি তার বক্তব্যে একদিকে যেমন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি জানিয়েছেন, তেমনি অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমজীবী গরীব মানুষের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। সব শেষে বঙ্গবন্ধু তার ৭ই মার্চের ভাষণে ধর্মনিরপেক্ষতার সাক্ষর রেখেছেন। তিনি তার বাঙালি জাতীয়তাবাদ চেতনার প্রতিষ্ঠায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি সবার কথাই বলেছেন।
বঙ্গবন্ধু তার ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা আজ পর্যন্ত আর কোন নেতা পারেননি। তিনি ৭ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন “আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে, আমরা শাসনতন্ত্র তৈরী করবো এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, বাংলার মানুষের মুমূর্ষু আর্তনাদের ইতিহাস, রক্ত দানের করুণ ইতিহাস। নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস”। অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আলোকে উদ্ভাসিত।বঙ্গবন্ধু ভাষণে অর্থনৈতিক মুক্তি দাবি জানানো হয়েছে, শোষণ মুক্ত সমাজের দাবী জানানো হয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণে যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক তিনি দিয়েছিলেন সেখানে তার শ্রমজীবী মানুষের উপর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি তার ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার সময় বলেছিলেন: “গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন”। পাহাড় সম প্রতিকূলতার মধ্যে দাড়িয়েও বঙ্গবন্ধু গরীব দুঃখী ও শ্রমজীবী মানুষের কথা চিন্তা করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে গণতন্ত্র। যদি তৎকালীন পাকিস্তানে গণতন্ত্রের বিজয় আমরা দেখতেই পেতাম তাহলে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের আর প্রয়োজনই হত না। সম্পূর্ণ বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকারের ন্যায্য দাবী জানিয়েছেন। তিনি যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।
“এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, অ-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়”। এই বাক্যটিই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নীতির বহিঃপ্রকাশের একটি অনন্য উদাহরণ। দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে যে পাকিস্থানের জন্ম হয়েছিল সেটি যে একটি ঐতিহাসিক ভুল ছিল তার বড় প্রমান হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা। বাংলাদেশ জন্মের অন্যতম মূল উদ্দেশই ছিল ধর্মনিরেপেক্ষ একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। যদিও বঙ্গবন্ধুর মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পূর্বে প্রদান করা হয়েছিল তথাপি ৭ই মার্চের ভাষণের যে ভাষা তার মাধ্যমে আমরা বঙ্গবন্ধুকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রুপকার হিসেবেই দেখতে পাই।
আমাদের সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণকে পঞ্চম তফসিল দ্বারা আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। উপরন্তু সংবিধানের ৭(খ) অনুযায়ী সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের একটি অ-পরিবর্তনযোগ্য বিধান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে পঞ্চম তফশিলে উল্লেখিত বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি আমাদের সংবিধানের একটি অপরিহার্য ও অপরিবর্তনীয় অংশে পরিণত হয়েছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ষষ্ঠ এবং সপ্তম তফসিল স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রের মূল পাঠকে সংবিধানের সাথে সংযোজিত করেছে মাত্র। কিন্তু যেটা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই সেটা হলো- ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান থেকেই এই দুটি বিষয়কে আমাদের সংবিধানের অন্তর্গত করা হয়েছে। আমাদের সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র দুটিই আমাদের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলেও স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রকে ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি হিসেবে চিহ্নিত করে সংবিধানের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। একইভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা আছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই হচ্ছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি। সুতরাং এই বিষয় নিয়ে বিতর্ক অর্থহীন ও অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত যা সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল।
১৯৭১ সালের ৭ ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিশলাকা যা প্রজ্জ্বলিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের ওই দাবানলের যার সামনে টিকতে পারেনি শক্তিশালী পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগিরা। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে স্বাধীনতার সংগ্রামে। এই ভাষণ ছিল আমাদের সেই সময়ে দিশেহারা জাতির জন্য আলোকবর্তিকা স্বরূপ।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ আমাদের বাংলাদেশের জন্য অতীব তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক দলিল যাকে অতিসম্প্রতি ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)