আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ শিশুর সুস্থ, মানসিক ও সৃজনশীল বিকাশের জন্য প্রকৃত ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। ইতিহাস তথা কোন বিষয় প্রতিষ্ঠার পিছনে যে সব ঘটনাগুলো রয়েছে সেগুলো জানা থাকলে সুনির্দিষ্ট ভবিতব্য তথা দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে জানা সহজতর হয়। সেক্ষেত্রে অভিভাবক ও সচেতন মহলের দায়িত্ব থাকবে নতুন প্রজন্মের নিকট তথা আগামী দিনের ভবিষ্যতের নিকট সঠিক তথ্য সরবরাহ করা।
কারণ শিশুরা তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে যে বিষয়ে আত্মস্থ জ্ঞান লাভ করে থাকে সে বিষয়টাকেই সঠিক হিসেবে মনে করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোচিং এর শিক্ষকরা কোন বিষয়ে ভুল শিক্ষা দিলেও ছোট্ট শিশুটি সেটিকেই আত্মস্থ করে বুঝতে শিখে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সঠিক তথ্য তথা ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কাজেই, সঠিক ইতিহাস জানা ও পর্যালোচনার জন্য সকলকেই দায়িত্বশীল হতে হবে।
এ নিবন্ধটি তৈরিতে কয়েকজন লেখক ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সঠিক তথ্য উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। ৭ নভেম্বর বাঙালি জাতির জীবনে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে সন্নিবেশিত হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার মিশন শুরু হয় ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে। বিপ্লবের নামে সেদিন ৩ জন খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। এরা হলেন, খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, কে এন হুদা বীর উত্তম এবং এটিএম হায়দার বীরবিক্রমকে। সে সময়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে কোন চেইন অব কমান্ড ছিল না।
সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহ্যাস উল্লেখ করেন: এদিন উচ্ছৃঙ্খল জওয়ানরা একজন মহিলা ডাক্তারসহ ১৩ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এমনকি একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকেও এ সময় হত্যা করা হয়। এ রকম জঘন্য ঘটনায় ভরপুর ছিলো ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বরসহ পরবর্তী ঘটনাগুলো। আবার অনেক ঘটনায় হয়তো রিপোর্টের নজর এড়িয়ে গেছে কিংবা সংরক্ষণে রাখা হয়নি।
৭ নভেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের উপর লিখিত গোলাম মুরশিদের ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ বইয়ে উল্লেখ করেন: একবার ফারুক-রশিদ (বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত প্রাপ্ত খুনি) ইত্যাদির শৃংখলা ভঙ্গকে ক্ষমা করার পর জিয়া সেনাবাহিনীকে শৃংখলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে খুবই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একটার পর একটা অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীতে হতেই থাকে। প্রতিটি অভ্যুত্থানের পর বহু সেনা সদস্যকে তিনি ফাঁসিতে ঝোলান কোন রকম বিচার ছাড়াই। অনেককে বিনা বিচারে পাইকারিভাবে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয় যাদের লাশ পর্যন্ত পরিবারের লোকেরা গ্রহণ করতে পারেনি। বিশেষ করে ৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমান বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর শত শত লোককে বিনা বিচারে অথবা সংক্ষিপ্ত বিচারে হত্যা করা হয় যেখানে মানবাধিকারের কোন বালাই ছিল না। ফলে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, বিমান-বাহিনীতে মাত্র ১১ জন কর্মকর্তা থাকেন। তাদের মধ্যে বিমান চালাতে পারতেন মাত্র তিনজন। এ রকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসের নজির কোন স্বাধীন দেশে আছে কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দিহান।
মার্কাস ফ্র্যান্ডার এর মতে, ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের কারণে আড়াই হাজার সেনা সদস্য নিহত হয়। একবার চিন্তা করা যায়, ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটা রক্তপিপাসু করে তুলতে পারে!
বিগ্রেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন তার ‘বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় (১৯৭৬-৮১)’ বইয়ে ৭ নভেম্বর নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ড স্ট্রাকচার সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়ে এবং চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা ধারণ করে। এ রকম অস্থিতিশীল অবস্থা পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না এবং কারো পক্ষে কিছু বলার বা করার ও ছিল না। ৭ নভেম্বরের রেশ থেকে যায় দীর্ঘদিন এবং সেনাবাহিনীতে ক্যু স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়। ৭ নভেম্বরের পর থেকে জেনারেল জিয়া হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সর্বমোট ২১ টি ছোটবড় সশস্ত্র রক্তাক্ত অভ্যুত্থান হয় এবং ২১ তম অভ্যুত্থানে নিহত হয় জিয়াউর রহমান।
কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে উদ্ধার করে কথিত বিপ্লবের সূচনা করেন এবং জিয়া ক্ষমতা দখলের পর ২৩ নভেম্বর থেকে জেএসডির বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে শুরু করেন। প্রথমে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করে থাকেন এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলাকা থেকে তাহেরকে গ্রেফতার করা হয়। পালাক্রমে দেশব্যাপী অভিযানের মাধ্যমে জেএসডির দশ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় এবং জিয়া দেশের ভেতরে শক্তিশালী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকেন। ১৯৭৬ সনের ২১ জুলাই দেশদ্রোহিতার অভিযোগে সংক্ষিপ্ত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে কর্ণেল তাহেরের ফাঁসির ব্যবস্থা করেন জিয়া।
লেঃ কর্ণেল (অবঃ) এম এ হামিদ পিএসসি’র লিখিত “তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা” বইয়ের মাধ্যমে সেনা অভ্যুত্থান, জেল হত্যা ও ৭ নভেম্বরের জঘন্য ঘটনা নিয়ে নানামুখী তথ্য জানা যায়। তিনি এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন “শ্রেণিহীন সেনাবাহিনীর প্রবক্তা কর্ণেল তাহেরই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে নভেম্বর সেপাই বিপ্লবের প্রধান স্থপতি। কিন্তু জিয়ার সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলে তাকে প্রাণ দিতে হয়।” এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্নস্বীকৃত খুনি কর্ণেল ফারূক ও রশিদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ৭ নভেম্বরের পটভূমি সম্বন্ধে তথ্যবহুল উপাত্ত পাওয়া যায়।
তাদের প্রদত্ত বক্তব্যের মাধ্যমে জানা যায়, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে জেনারেল জিয়া এবং অধিকাংশ উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা লাভবান হয় এবং জিয়াউর রহমানের নেপথ্য পরিকল্পনা ও প্ররোচনার ফসল ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান।
৭ নভেম্বরের বর্ণনা দিতে গিয়ে ফারুক এবং রশিদ উল্লেখ করেন: জিয়া তার নিজ বাসভবনেই ছিলেন এবং ব্যক্তিগত দেহরক্ষী এবং পদাতিক বাহিনীর কোম্পানির প্রহরাধীন ছিলেন, ছিল ব্যক্তিগত স্টাফরাও। সুতরাং তিনি বন্দী ছিলেন না এবং বিদ্রোহ দমনের জন্য কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টাও করেননি। জিয়ার স্ত্রী; ফারুক এবং রশিদকে এই মর্মে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তার স্বামী আটকাবস্থায় নেই এবং কতিপয় সামরিক অফিসারদের সাথে মিটিং করছেন। পদবীর অপব্যবহার করে জিয়া মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য ও সাধারণ জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, কী পরিমাণ ছলচাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করেছিল কুটিল চক্র।
কর্ণেল শাফায়াত জামিল রচিত “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” শীর্ষক বইটিতেও স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সেনা অভ্যুত্থান ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের উপর বিশদ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। শাফায়াত জামিল উল্লেখ করেন “৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের হাত থেকে চিরদিনের জন্য দায়মুক্ত থাকার ব্যবস্থা হিসেবে অত্যন্ত সুচতুরভাবে দিনটিকে “জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস” রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে জিয়ার একটি মানবতা বিরোধী পদক্ষেপ।” তিনি আরো উল্লেখ করেন, সিপাহী বিদ্রোহে অংশ নেওয়া সিপাহীরা ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত এবং তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোন ব্যাটালিয়নে ছিল না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যড়যন্ত্র এবং জঘন্য হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্যই বিশেষ মহল ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। আর বিশেষ মহলের নেপথ্যে কারা ছিল তা জাতির নিকট অত্যন্ত স্পষ্ট।
এসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে সুস্পষ্ট মতামত দেওয়া যায় যে, ৭ নভেম্বর বাঙালি জাতির জীবনে ছিল কলঙ্কস্বরূপ। প্রাজ্ঞজনদের মতামতের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতার দুরভিসন্ধি তথা রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার প্রয়াসে পাকিস্তান ফেরত সৈনিকদের দিয়ে সেনা হত্যা তথা মুক্তিযোদ্ধা হত্যার মিশনে নামে পাকিস্তানী প্রেতাত্মা চক্র।
আর সেই চক্রের নায়ক বলা হয় জেনারেল জিয়াকে। কাজেই এটি বুঝতে কারো বাকি নেই, পরবর্তীতে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াবার কিংবা স্বৈরশাসককে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস যাতে কেউ দেখাতে না পারে সেরকম অন্তর্নিহিত বিশ্লেষণ করেই অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান তথা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়। ৭ নভেম্বর নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার বিচার এখনো হয়নি, তাই সরকারের কাছে নিবেদন সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার বিচার করতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)