অনেক অনেক দুশ্চিন্তার রাত কাটানোর পর সেই রাতে যেন অবশেষে একটু স্বস্তিতে ঘুমিয়েছিল সারাদেশের মানুষ। আকাশ ভরা জোছনা নিয়ে সেই রাতে চাঁদ উঠেছিলো বাংলায়। আগের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর তারও আগের অনেক অনেক বছরের সংগ্রামের ইতিহাস বিজয়ে ইতি টেনেছিলো ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সেই রাতের মায়াময়ী চাঁদঘেরা রাতটিকে তাই অ্যাখ্যায়িত করা হয়েছিল কোজাগরী পূর্ণিমার রাত হিসেবে। চাঁদ উঠেছিলো বাঙালির মনে, ঘরে-ঘরে।
একদিকে বিজয় উল্লাস, অন্যদিকে প্রিয়জন হারানোর বেদনা। একদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার আনন্দ, অন্যদিকে প্রিয়জনের মরদেহের সন্ধান। একদিকে যতটুকু পাওয়া যায় ততটুকু দিয়েই মিষ্টিমুখ, অন্যদিকে স্বজনের কুলখানি-চেহলামের প্রস্তুতি। এরকমই ছিল ১৬ ডিসেম্বর, একাত্তরের সেই রাত।
ওইসময়ের বর্ণনা দিয়ে ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেছেন: আজ শরীফের কুলখানি।.… জেনারেল নিয়াজী নব্বই হাজার পাকিস্তানী সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পন করেছে আজ বিকেল তিনটার সময়।
যুদ্ধ তাহলে শেষ? তাহলে আর কাদের জন্য সব রসদ জমিয়ে রাখবো?
আমি গেস্টরুমের তালা খুলে চাল, চিনি, ঘি, গরম মসলা বের করলাম কুলখানির জর্দা রাঁধবার জন্য। মা, লালু, অন্যান্য বাড়ির গৃহিনীরা সবাই মিলে জর্দা রাঁধতে বসলেন।
রাতের রান্নার জন্য চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি এখান থেকেই দিলাম। আগামীকাল সকালের নাশতার জন্য ময়দা, ঘি, সুজি, চিনি, গরম মশলা এখান থেকেই বের করে রাখলাম।’
সেই দিন ও রাতটির কথা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের ১০ম খণ্ডে উঠে এসেছে এভাবে: ‘মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যদের রাজধানীতে প্রবেশের খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। উল্লাসের জোয়ারে লক্ষ লক্ষ লোক নেমে আসে রাস্তায়। জনমানববিহীন নি:শব্দ নগরী মুহূর্তে ভরে উঠে মানুষের বিজয় উল্লাসে। ওরা এসেছে এই বাণী উচ্চারিত হতে থাকে মানুষের মুখে মুখে। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধ্বনি উঠে জয় বাংলা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। যৌথ বাহিনীর জন্য মানুষ এগিয়ে আসে ফুলের ডালি নিয়ে হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা নিয়ে।……”
সেই দিনের আরো কিছু সময়ের বর্ণনা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে বিজয় মুহূর্ত নিয়ে আবারো লেখা হয়েছে: ‘বিজয়ের মধ্যে দিয়ে নয় মাসের দু:স্বপ্নের অবসান ঘটলো। বাংলার মানুষ আবার তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার পেলো। পথে প্রান্তরে, পর্বতাঞ্চলে নদনদী খালে বিলে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে বাঙালি আবার নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে। ছায়ার মতো অনুসারী মৃত্যুর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকতে হবে না। আর রাতের অন্ধকারে প্রতিটি অচেনা শব্দ মৃত্যুর অশুভ পদধ্বনি হয়ে আসবে না। চারদিকে আনন্দ আর উল্লাসের ঢেউ।’
আনন্দ বেদনা মিশ্রিত সেই রাতটির বর্ণনা করেন সিনিয়র সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ওই দিনের পরিবেশটা দেশের একেক জায়গায় একেক রকম ছিল। তবে সারাদেশেই যেন একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর রাতে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত হয় পাবনার প্রণবেশ সেন রচিত ও দেবদুলাল বন্দ্যেপাধ্যায় উচ্চারিত সংবাদ পরিক্রমা। সেই সংবাদ পরিক্রমায় তিনি বলেন, আজ এই কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে আমি সব মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতে চাই দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। আর কোনো রক্তপাত নয়। এখন নিজ দেশ রক্ষায় এগিয়ে যেতে হবে।
জাফর ওয়াজেদ বলেন, সাধারণত লক্ষ্মীপূজার রাতকে কোজাগরী রাত বলা হয়। কিন্তু সেই রাতটাও যেন একটা লক্ষ্মীময় রাত হয়ে এসেছিল তাই এ নামে ভূষিত করা হয় সেই রাতটিকে।
‘বিশেষ ওই রাতটি অনেক অনেক রাতের পরে এসেছিল বাঙালির জীবনে। পাকিস্তানী সেনাদের ভয়ে এর আগে কারো বাড়িতে লাইটও জ্বলতো না। মোমবাতি দিয়ে কোনোক্রমে কাজ সারতো সবাই। এদিন যেন আবার আলোকজ্জ্বল হয়ে উঠলো বাড়িগুলো। রাস্তাঘাটেও আলো ছিল না দীর্ঘদিন। পকিস্তানী হানাদার বাহিনী নষ্ট করে ফেলেছিলো অনেক কিছু। সেসবে আলো যেন আবার ফিরলো। অন্ধকারে কোনো জনমানবের সাড়া না থাকায় যুদ্ধের সময়গুলোতে দূর থেকে ভেসে আসতো কুকুরের ডাক। সেদিন চারদিকে শুধু জয় বাংলা স্লোগান। অনেকদিন পর মানুষ যেন সেদিন রাতে নির্বিঘ্নে ঘুমালো। কোন কিছু হারানোর ভয় ছাড়া শান্তির এক ঘুম।
ওইসময় কমবয়সী জাফর ওয়াজেদ বিজয়োল্লাস দেখেছেন একভাবে। অন্যভাবে দেখেছেন ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য রাইসুল ইসলাম আসাদ।
তিনি বলেন: একদিকে ওই রাতটিতে যেমন বিজয়ের আনন্দ ছিল, পাশাপাশি ছিলো কাছের মানুষকে হারানোর বেদনা। আনন্দ বেদনার এক মিশ্র অনুভূতি তৈরি হযেছিল সেদিন। দেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে সেটা ঠিক কিন্তু অনেকেতো হারিয়েও গেছে। একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি এমন অনেককে হারিয়েছি যুদ্ধে।
‘যুদ্ধে কিন্তু কেউ জেতে না, সবাই হারায়, শুধুই হারায়। তবে সেই রাতে স্বস্তি ছিল মানুষের মনে যে অন্তত এখন আর পাকিস্তানী সেনারা তাদের ধরে নিয়ে যেতে আসবে না।’
সেদিনের কথা ভাবলে আজও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন সাংবাদিক আলমগীর রেজা চৌধুরী। তিনি বলেন, ওই রাতে পূর্নিমা ছিল সেটুকু বলতে পারি। আর বলতে
পারি আনন্দ বেদনার মিশ্রণে একটা অনুভূতি হয়েছিল সেদিন। ওই সময়ের অনুভূতি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মনে পড়ে ওই সময় আমি এসএসসি ক্যান্ডিডেট ছিলাম। সুতরাং সময়টাকে দেখার আমারও একটা দৃষ্টি ছিলো। বিজয়ের খবর শোনার পরই ‘জয় বাংলা’ বলে গঞ্জের দিকে দৌড় দিয়েছি। এক দৌঁড়ে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেছি গঞ্জে।
‘নয়মাসের সেই মুক্তিযুদ্ধে সবাই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেউ হারিয়েছে তাদের প্রিয়জন। সুতরাং প্রতিটি মানুষের ভেতরে একধরনের মিশ্রিত অনুভূতি ছিলো। একটা শব্দ আছে- লিলুয়া বাতাস। বিজয়ের খবর যেন সেই লিলুয়া বাতাসের মতোই প্রশান্তির ধারা এনে দিয়েছিল সবার মনে। সেই দিনটিতে বাংলার প্রতিটি মানুষ বেদনার মধ্যে দিয়ে আনন্দ পেয়েছে। তবে সেই সময়ের অনভূতি এখন কাউকে বোঝানোর মতো না।’