চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

১৫ আগস্ট: মার্কিনীদের যত গোপন চিঠি চালাচালি

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার কয়েক মাস আগেও তার উপর প্রাণঘাতী হামলার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। সেই হামলায় ২ জন আহত হলেও বঙ্গবন্ধুর কোন ক্ষতি হয়নি। তবে, ওই হামলার খবর গোপন রাখা হয়।

ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তা থেকে হামলার ঘটনাটি জানা যায়। তারবার্তাটি ২০১৩ সালে উইকিলিক্স ফাঁস করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেসময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যে তারবার্তাগুলো পেয়েছিলেন এটি ছিল তার একটি।

১৯৭৫ সালের ২৩ মে তারিখে পাঠানো সেই তারবার্তা (>1975dacca02535_b, confidential) অনুযায়ী, বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোকে এই ব্যাপারে খবর প্রকাশ না করতে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো।

তারবার্তায় বলা হয়: আমরা দুটি রিপোর্ট পেয়েছি যে ২১ মে বিকেলে প্রেসিডেন্ট মুজিবুর রহমানকে লক্ষ্য করে হত্যা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ঢাকার প্রান্তে  নতুন একটি টিভি স্টেশন পরিদর্শন শেষে তিনি নিজের বাসায় ফেরার পথে হত্যা প্রচেষ্টা চালানো হয়।

এই তথ্যের ‘প্রাথমিক সূত্র’ দূতাবাসের বাঙালি রাজনৈতিক সহযোগী যিনি জানিয়েছেন যে তাকে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা ইউনিটে নিয়োজিত পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট এমনটি জানিয়েছেন। অপর সূত্র একজন সাংবাদিক যিনি তথ্য কর্মকর্তা আলপার্নকে এমনটি জানান।

দুই বিবরণেই বলা হয়, হামলায় গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছিল। সাংবাদিকের রিপোর্ট অনুযায়ী, মুজিব অক্ষত অবস্থায় হামলা এড়াতে পারেন, কিন্তু দুইজন অজ্ঞাত ব্যক্তি আহত হন। তিনি আরও যোগ করেন, ঘটনাটি খবর হিসেবে প্রকাশ না করার জন্য প্রেস ইনফর্মেশন ডিপার্টমেন্ট (পিআইডি) থেকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্পর্ক ভালো ছিল না। কারণ সাধারণভাবে ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সাথে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৫ আগস্টের পর ঢাকা থেকে পাঠানো তারবার্তাগুলোতেও তার প্রতিফলন আছে।

একটি তারবার্তায় ( >1975dacca03964_b, confidential), মার্কিন দূতাবাস জানায়: তার (শেখ মুজিব) মৃত্যুতে কোন বিশেষ উল্লাস না থাকলেও সেখানে একটা নীরব স্বীকৃতি এবং সম্ভবত কিছুটা পরিত্রাণের অনুভূতিও ছিল।

ওই তারবার্তায় বলা হয়: যতটা সহজে ক্ষমতা স্থানান্তর হয়েছে তাতে বুঝা যায় মুজিব বাঙালিদের থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। বাঙালির আকাঙ্ক্ষা মেটাতে না পারা এবং দৃশ্যত ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি ও পারিবারিক কারণে তার (বঙ্গবন্ধুর) আরও ব্যাপকভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার ইচ্ছার কারণে তিনি বস্তুনিষ্ঠ পরামর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন।।

সেই তারবার্তায় জানানো হয়, নতুন সরকারে ‘এখনও স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের দুর্বল প্রশাসনের সাথে থাকা অনেক পরিচিত সদস্যরা রয়েছেন। এটা ধারণা করা যায় যে ঠাণ্ডা যুদ্ধের শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে তারা আরও সংযম এবং আরও ভারসাম্যপূর্ণ হবে।’

এতে বলা হয়: ক্ষমতা সুসংহত করতে জুনের প্রথম থেকে শেখ মুজিবের প্রচেষ্টার দ্রুত গতি, একই সাথে তার ভাগ্নে শেখ মনির বর্ধিষ্ণু প্রভাব, নিঃসন্দেহে ষড়যন্ত্রকারীদের এই সিদ্ধান্তে আনে যে পদক্ষেপ গ্রহণে আর দেরি করা সম্ভব নয়। ভারতের স্বাধীনতা দিবসেই তা বেছে নেওয়াটা হয়তো নিছক কাকতালীয়, কিন্তু আমরা এই কাকতালটা লিপিবদ্ধ করছি।

যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ভারতের প্রতিক্রিয়া
১৫ আগস্টের পর বালাদেশের ব্যাপারে আবারও ভারত হস্তক্ষেপ করে কিনা তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উদ্বেগ ছিল।

নয়া দিল্লির মার্কিন দূতাবাস ভারতীয় আর্মি অফিসারের মন্তব্য নিয়ে ফিরতি বার্তায়  (>1975newde11059_b, confidential) জানায়: আমরা এমন কিছু দেখিনি বা শুনিনি, যা নির্দেশ করে যে বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের ঘটনায় ভারতীয় আর্মির ইস্টার্ন কমান্ড কোন বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে, যদিও এরকম বিষয়ে অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে আমাদের ক্ষমতা অবশ্যই সীমাবদ্ধ। হয়তো এটার গুরুত্ব এমনই, জেনারেল জ্যাকব (ইস্টার্ন আর্মি কমান্ডার) এবং তার ডেপুটি মেজর জেনারেল হারি শেনজেল, (পশ্চিম বঙ্গ) গভর্নর (এ.ল.) দাসের স্বাধীনতা দিবসের অভ্যর্থনায় ছিলেন, ইস্টার্ন কমান্ডের বাকি সব শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে। আমি জ্যাকব এবং শেনজেল দুজনের সাথেই কথা বলি এবং তাদের নিরুদ্বেগ-নির্লিপ্ত বলেই মনে হয়। কেউ বাংলাদেশের ঘটনার কথা উল্লেখ করেননি।”

তবে, যুক্তরাষ্ট্র জানত: অবশ্যই অভ্যুত্থানের ব্যাপারে ভারতের চিন্তা ছিল। এটা আরও পরিষ্কার করে মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তার সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার আলাপচারিতায় (1975dacca11063_b, confidential), যিনি নতুন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

একই তারবার্তায় বলা হয়: অ্যাম্বাসেডর, পররাষ্ট্র সচিব কেওয়াল সিং এবং (প্রধানমন্ত্রীর, পি.এন প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি) ধারের সৌজন্যে ১৫ আগস্টের ডিনারে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিষয়ে তাদের বেশ নিরুদ্বেগ দেখা যায়। ‘পুরনো লোকজন’ আবারও কীভাবে অফিসে (ক্ষমতায়) ফিরে এলো তা নিয়ে ঠাট্টাতেই তারা তাদের মন্তব্য সীমাবদ্ধ রাখেন।

মার্কিন দূতাবাস জানায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমকে নীরব থাকতে বলে ভারত। একটি গণমাধ্যম সূত্র জানায়, ১৫ আগস্ট ভারত সরকার বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে সম্পাদকীয় মন্তব্য করতে নিষেধ করে।

‘র’ থেকে পাওয়া ষড়যন্ত্রের খবর উড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু
ভারত পরে গণমাধ্যমকে নীরব থাকতে বললেও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলছে সেটা সবার আগে তারাই বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিল। ১৫ আগস্টের আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করেছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’। ভারতের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দু’বার এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। এমনকি এই ষড়যন্ত্রে যারা জড়িত তাদের বিবরণও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু, তাদেরকে ‘আমার সন্তান’ অভিহিত করে ‘তারা আমার ক্ষতি করতে পারে না’ বলে ওই তথ্য উড়িয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) এর শীর্ষ কমকর্তা রামেশ্বর নাথ কাও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তাকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু, কাওকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: তারা আমার সন্তান এবং তারা আমার ক্ষতি করবে না।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুমোদন নিয়ে কাও ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

অশোকা রায়নার ‘ইনসাইড র’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, বঙ্গবন্ধু হাত নাড়িয়ে এই উদ্বেগকে উড়িয়ে দেন। কাও তার সঙ্গে কোন তর্ক করেননি। কিন্তু তাকে (বঙ্গবন্ধু) বলেন, ভারতের এই তথ্য নির্ভরযোগ্য এবং তিনি তাকে এই ষড়যন্ত্রের আরও বিস্তারিত পাঠাতে পারেন।

পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের মার্চে কাও ‘র’ এর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ঢাকা পাঠান। ওই কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে তার সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্রের ছক কষা বিভিন্ন ইউনিট এবং কর্মরত ও বহিষ্কৃত সেনা অফিসারদের বিবরণ দেন। ‘কিন্তু আবারও বঙ্গবন্ধু তা গ্রাহ্য করেননি,’ বলে বইটিতে বলা হয়েছে।