কওমি মাদ্রাসার নেতৃবৃন্দ তাদের সনদের স্বীকৃতি নিতে হেফাজতের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। খবরটা টেলিভিশনে দেখার পর আমার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে একটা ভয়াল উদ্বেগ, তাদের রাতের ঘুম হারাম করেছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু কিছু কওমি মাদ্রাসা হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত এমন কথা জানা থাকলেও গোটা দেশের কওমি মাদ্রাসার নেতৃত্ব হেফাজতের অধীনে চলে যাওয়ায় এই উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ধর্মপারয়ণ পরিবারগুলোতে।
গবেষণায় দেখা গেছে কওমি মাদ্রাসার ৪৭% শিক্ষার্থী সাধারণ ধর্মপরাায়ণ পরিবারের, ৩২% আসে অতি দরিদ্র পরিবার থেকে (যে দরিদ্র পিতা মাতা বাধ্য হয়ে বিনা খরচার কওমি মাদ্রাসায় সন্তান দিয়েছেন) আর ২১% সাধারণ শিক্ষার সুযোগ সহজলভ্য না থাকায় বা স্বপ্রণোদিত হয়ে অথবা অন্যের দ্বারা প্রণোদিত হয়ে কওমি মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন।
আমাদের পরিবারের নিকট আত্মীয়দের মধ্যে ৬ জন আলেম রয়েছেন কওমি মাদ্রাসা খেকে পাশ করা, কওমি মাদ্রাসায় পড়ছেন ১৮ জন। অমন হিসাব আমরা রাখছি একারণে যে হেফাজত ইসলামের ঢাকা অবরোধের সময় চট্ট্রগামের কোন এক মাদ্রাসায় পড়া আমাদের এক দরিদ্র বর্গাদারের একমাত্র ছেলে প্রাণ হারিয়েছিল।
তারপর আমার নিকট আত্মীয়দের মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিষয়টি নিবিড় পর্যবেক্ষণে আনা হয়। গত দুবছরে নিকট আত্মীয় তিনজন মাদ্রাসা ছাত্রের মাদ্রাসা বদল করা হয় ওই মাদ্রাসাগুলোর হেফাজত সংশ্লিষ্টতার কারণে। আমাদের পরিবারে নিকট আত্মীয় মহল থেকে কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী যাবার তিনটি প্রধান কারণ আমি খুঁজে পেয়েছি।
এক. পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কেউ মনে করেছেন তাদের মৃত্যুর পর তার রক্তের কেউ তার জানাযা পড়বে তাই ছেলে বা নাতিদের একজন মাদ্রাসায় গেছে।
দুই. মধ্যপ্রাচ্যে সুদীর্ঘসময় চাকুরীজীবীদের কেউ কেউ সেখানে বসে দেশে তাদের একজন সন্তানকে আলেম বানাতে চেয়েছেন।
তিন. ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অন্তরের আকর্ষণ থেকেও সন্তানকে দিয়েছেন কওমি মাদ্রাসায়। অমনভাবেই কওমি মাদ্রাসায় যাচ্ছে বিভিন্ন সাধারণ ধর্মপরায়ণ পরিবারের সন্তানেরা। আবার ধর্মান্ধ পরিবারের সন্তানেরাও যাচ্ছে কওমি মাদ্রাসায় কিন্তু তার সংখ্যা খুব বেশী নয়।
আমাদের পরিবারটি গোড়া আওয়ামী লীগ পরিবার। ২০০০ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ পরিবার ছাড়া অন্য কোন পরিবারে বিয়ে দেয়া-নেয়াও হতো না। ২০০০ সালে সেই ‘ফ্যামিলি কনভেনশনে’ কিছুটা সংশোধনী আনা হয় যখন আমাদের এক ভ্রাতুস্পুত্র তার সহপাঠি ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীকে বিয়ে করে ফেলে। তখন থেকে বিধান হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হতে হবে।
রাতে ফোন দিলেন আমার সমবয়সী এক চাচা। তার বড় পুত্র মুফতি শ্রেণিতে পড়ছে ঢাকার এক মাদ্রাসায়। ছেলের পছন্দের একটা এনড্রয়েড ফোন তিনি কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ফোন ব্যবহার করতে দিতে রাজী হয়নি। ছেলের চোখের জল দেখে মনখারাপ করে ফোনটা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। চাচা বললেন ‘যে মাদ্রাসায় মোবাইল ফোন নিষেধ সেই মাদ্রাসা হেফাজতের নেতৃত্বে চলে গেলে আমার পুলার আর মুফতি হওয়া লাগবে না। আমি কালই ওকে বাড়ি নিয়ে আসবো।’
অমন ধর্মপরায়ণ পরিবারে এই নতুন উদ্বেগের কারণ যদি বিশ্লেষণ করি তাতে কী দেখবো? হেফাজতের নেতৃত্ব মেনে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি নিয়ে আসা এবং সে প্রতিনিধিদলকে মেনে নেয়া মানে হেফাজতকে গোটা দেশের কওমি মাদ্রাসার আধিপত্য দিয়ে দেওয়া ।
দেশের সাধারণ ধর্মশিক্ষাঙ্গণকে এক ভয়াল সঙ্কটে ফেলে দেয়া হলো। সাধারন ধর্মপরায়ণ পরিবারগুলোর উদ্বেগ কি তিনি বুঝতে পারবেন না এ আমরা বিশ্বাস করি না। ধর্মচর্চাকে কপট রাজনীতির কবলমুক্ত রাখা খুব জরুরী।
আজকের বিশ্বে ইসলাম ধর্ম ও সাধারণ মুসলমানরা কেন যে সংকটে পড়েছে তা কে না জানে। কারা এই হেফাজতে ইসলাম? জাতির সামনে তাও আজ স্পষ্ট। চরম উগ্রবাদী আইএস এর মানসজাত হেফাজতিরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাম্প্রদায়িক করা, ভাস্কর্য শিল্প নির্মূল, নারীর অগ্রগতিকে টেনে ধরা, দেশজ শিল্প সংস্কৃতির উপর আঘাত হানাসহ দেশকে চরম সংকটে ফেলতে উদগ্র এক গোষ্ঠী।
আমরা মেনে নিচ্ছি প্রধানমন্ত্রী যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা অত্যন্ত জরুরী। সাধারণ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা দেশের একটি বাস্তবতা। এই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত জনগোষ্ঠীকে দুরে সরিয়ে রাখলে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখলে কেবল অনর্থ-আশঙ্কাই বাড়াবে।
কিন্তু তা নিরেট সরকারের অধীনে না রেখে হেফাজতের নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দিলে চরম সর্বনাশ হবে। প্রধানমন্ত্রী কি এর ভয়াবহতা বুঝতে পারছেন না ?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)