অন্যের লেখা পড়ে সংবাদপত্রে পর্যালোচনার পোশাকি নাম ‘রিভিউ’। হুমায়ূন আহমেদ তার সমকালীন কিংবা অনুজ লেখকদের লেখা নিয়ে কোন রিভিউ লিখেছিলেন কি না জানা নেই। তবে ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমির প্রকাশনা ‘উত্তরাধিকার’ এ কাজী ইমদাদুল হক এর উপন্যাস ‘আবদুল্লাহ’ এবং শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের রিভিউ লিখেছিলেন বাংলা কথাসাহিত্যের জাদুকর হুমায়ূন।
তার নিজের হাতে লেখা রিভিউয়ের কপি চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে এসেছে। অন্যপ্রকাশ প্রকাশনীর প্রকাশিত ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’ বইয়ের ওপর রিভিউ লিখেছিলেন তুমুল জনপ্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। ২০০৮ সালের বই মেলায় উপন্যাসটি বের হয়েছিল। আর ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় ২০০৮ সালেই বের হয়েছিল রিভিউটি।
সেখানে হুমায়ূন আহমেদ যা লিখেছিলেন তা হল- ‘আমার দখিন হাওয়ার বাসায় অনেক দিন ধরে একটা বই পড়ে আছে। লেখকের নাম শাকুর মজিদ। বইটির নাম – ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’। বইটির প্রথম পাতায় লেখকের অটোগ্রাফ। লেখক বইটি দিয়েছেন মিলনকে। মিলনকে দেয়া বই আমার বাসায় কেন?
বইটির ভূমিকা পড়লাম। মুক্তধারার চিত্তবাবুকে নিয়ে লেখা অংশটা পড়ে যথেষ্টই মজা পেলাম। নবীন কোন লেখকের লেখা পড়ার আমার কিছু নিয়ম আছে। প্রথম পড়ি লেখক নিজের সম্পর্কে কি লিখছেন। এই লেখাটা সাধারণত ফ্ল্যাপে থাকে। লেখক নিজেই অতি যত্নে লিখেন। তবে ভাব ধরেন যেন লেখা অন্য কেউ লিখেছে। একজন লেখক নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন-তাঁর প্রতিটি রচনা কালজয়ী। তিনি টলস্টয় ঘরানার লেখক।”শাকুর মজিদ নিজের সম্পর্কে লিখেছেন – আচ্ছা এই অংশ থাকুক। পাঠক পড়ে নেবেন।
ফ্ল্যাপের লেখা পড়ার পর, আমি যাই উৎসর্গ পত্রে। তারপর ভূমিকায়। মূল লেখা এক সিটিং এ প্রথম দশ পাতা পড়ি। যদি ভাল লেগে যায় তবেই পুরোটা পড়া হয়। শাকুরের বইয়ের পঞ্চম লাইনটি পড়ে আমি বুঝলাম লেখাটা ভাল হবে। পঞ্চম লাইনে লেখা – অফিসে ইত্তেফাক পত্রিকা এলেই আমি শফিক স্যারকে জিজ্ঞেস করতাম, স্যার আমার রিজাল্ট বারইছেনি?’ ‘বারইছেনি’ খাঁটি সিলেটি শব্দ। সিলেটবাসীরা নিজেদের কথ্য ভাষা নিয়ে সামান্য সংকুচিত থাকেন। শাকুর সরাসরি এই ভাষা ব্যবহার করছে। তারচেয়েও বড় কথা, মূল গদ্যে হঠাৎ হঠাৎ সিলেটি ভাষা ঢুকিয়ে তিনি গদ্য ধারায় ঢেউ এর মত তৈরি করেছেন। এই কাজ তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে করেছেন নাকি অজান্তে করেছেন তা আমি জানি না। যে ভাবেই থাকুন এতে তাঁর গদ্য স্বাদু হয়েছে। বাংলা ভাষার কিছু বড় লেখক এ ধরনের পরীক্ষা অতীতে করেছেন। চলতি ভাষার লেখা গদ্যে হঠাৎ হঠাৎ তৎসম শব্দ ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যেমন – “তখন রাত্রি হয়েছে।”
সিলেটিরা নিজেদের ভাষা নিয়ে কিছুটা সংকুচিত থাকে বলে কি আমি আবার তাদের আহত করছি নাতো! একটা গল্প বলি – আমাদের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী সিলেটের সৈয়দ আব্দুল মজিদ সাহেবের গল্প। রবীন্দ্রনাথ এসেছেন সিলেটে। এ উপলক্ষে স্বাগত বক্তৃতার দায়িত্ব পড়েছে কাপ্তান মিয়ার উপর। উনি বললেন, আমার সিলেটি বাংলা দিয়ে এত বড় কবির কাজকে পীড়িত করতে চাই না। আমি ইংরেজিতেও বক্তৃতা দেব না। কারণ ইংরেজি বিদেশী ভাষা।
কাপ্তান মিয়া দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন চোসত উর্দুতে। কাপ্তান মিয়ার প্রসঙ্গ থাকুক, শাকুরের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বইটিতে শাকুর তার কথা আন-রিক ভঙ্গিতে বলেছে। লিখতে গিয়ে ভান করেনি যে “আমি অতি মহান একটি রচনা লিখছি। একদিন এই রচনা ক্যাডেট কলেজে পাঠ্য হবে।” সে সহজিয়া ভঙ্গিতে তার স্বপ্ন এবং স্বপ্ন ভঙ্গের কথা, আনন্দ এবং বেদনার কথা লিখে গেছে। আমি তার চোখে পাবলিক স্কুলের ছবি দেখতে পেয়েছি। খেলার মাঠ, দুরের পাহাড়। অন্যকে নিজের দেখা ছবি গল্পের মাধ্যমে দেখানো সহজ কর্ম না।
পাবলিক স্কুল নিয়ে বিদেশী কিছু পড়েছি। ছবি দেখেছি। বাংলা সাহিত্যে জরাসন্ধের একটা লেখা আছে – পাবলিক স্কুল ঠিক না, বরস্ট্যাল স্কুল। দুষ্টু এবং অপরাধী ছেলেদের জেলখানা টাইপ স্কুলের কাহিনী। শাকুর মজিদ সম্ভবত প্রথম ক্যাডেট কলেজের গল্প শুনাতে এসেছে। এবং ভাল শুনিয়েছে।
কেউ যদি আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, বইটির কোন দিকটা আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে – আমি বলব, লেখকের সাবলাইম হিউমার।
কেউ যদি বলে সবচেয়ে অপছন্দ হয়েছে কি? আমি বলব ….. না থাক, বলব না। সাহিত্যের ঝাড়-দার হবার শখ আমার নেই। গদ্য লেখক হিসেবে আমি জানি, গদ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা কত কঠিন। এই কাজটি লেখক করতে পেরেছেন। গদ্যের কঠিন ভূমিতে তাঁকে জানাচ্ছি সুস্বাগতম।পরম করুণাময়ের করুণা তার উপর বর্ষিত হোক এই তার প্রতি আমার শুভ কামনা।
*পুনশ্চ। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। শাকুর মজিদ ক্যাডেট কলেজ থেকে অসাধারণ রেজাল্ট করে এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করেছিল। মূল বইতে এই সাফল্যের কথা সে একবারও উল্লেখ করেনি। এই সংযম সে দেখাতে পেরেছে এটাও অনেক বড় ব্যাপার।’
এ প্রসঙ্গে উপন্যাসটির লেখক শাকুর মজিদ চ্যানেল আইকে অনলাইনকে বলেন, ‘২০০৮ সালে লিখি ‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’। অন্যপ্রকাশ বের করবে। স্যারের প্রকাশকও মাজহার। স্যার জানতে পেরে বললেন, দিওতো পড়ব। তার কাছে পাণ্ডুলিপি পৌঁছে দেওয়া হয়। পরে শাওনের মুখে শুনেছি, স্যার পাণ্ডুলিপি নিয়ে পড়ছিলেন সকালের নাস্তা খাবার সময়। স্যার সাধারণত নাস্তা খেতে খেতে পড়তেন যে কোন কিছু। তার পর লিখতেন। একটু ঘুমাতেন দুপুরে। আবার বিকালে এবং সন্ধ্যায় লিখে আড্ডা দিতেন। কিন্তু সেদিন আমার লেখা পুরোটা শেষ করেন এক বসায়। পরে মাজহারকে ফোন করে বলেন আমকে যোগাযোগ করতে। আমি সাড়ে ৩টার দিকে ফোন করে তাকে ঘুমন্ত পাই। পরে সাড়ে ৫টায় ফোন করলে তাকে পাই।তিনি দারুণ প্রশংসা করে বললেন, বোর্ডিং জীবন নিয়ে এমন লেখা বাংলা সাহিত্যে নেই। গদ্য অনেক ভালা। কাল বউ সহ আসো। ট্রিট দেব। শাওন নিজের হাতে রান্না করবে। অসাধারণ রান্না আর টুটুলের গান। ভুলতে পারিনা আজও। পরে তিনি ইত্তেফাকে এই বইয়ের রিভিউ লিখেছিলেন ‘শাকুর যখন ক্লাস সেভেনে’ এই শিরোনামে। পরে শাওন বলেছিলেন, স্যার মাত্র দুটো রিভিউ লিখেছেন জীবনে। তার মধ্যে একটি আমার।’