প্রজ্ঞা, মেধা, মনন, দায়িত্বশীলতা, সৃজনশীলতা এবং সততায় সৃষ্টিশীল মানুষগণ তাদের সবটুকু আলোকচ্ছটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার আগেই হারিয়ে যান পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। কিন্তু এ স্বল্প সময়ের তাদের জ্ঞানের আর কর্মের কারণে আশেপাশের মানুষ পেয়ে থাকে আশার আলো, পায় ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা, অন্যেরা হয়ে উঠেন আলোকিত।এ রকমই একজন প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন মাহবুবুল হক শাকিল। তার জীবনাচরণে আশাহীন যুবক পেতে পারে সৃষ্টিশীল জীবনের হাতছানি। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে থেকেও লালসাহীন জীবনযাপনের জন্য তিনি ছিলেন অনন্য। দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির পেশাজীবীদের নিকট তিনি আলাদা মর্যাদার আসন তৈরি করতে পেরেছিলেন নিজস্ব ধারাতে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে তিনি যে ভূমিকা কিংবা বিশেষ নজির তৈরি করতে পেরেছিলেন, ভবিষ্যতে অন্য কেউ তেমন উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবেন কি না সময়ই তার উত্তর দেবে।
একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় খুব সহজেই মেশার সুযোগ হয়েছিলো শাকিল ভাইয়ের সাথে। ব্যক্তিত্বের মাধুর্যতা, চরিত্রের উজ্জ্বলতা, সহনশীলতা, বিচক্ষণতা এবং সকলের নিকট দায়িত্বশীলতা শাকিল ভাইয়ের চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। যে কোন কাজকে অত্যন্ত গুরুত্বের সহিত বিবেচনায় নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতেন সাবলীলভাবে অর্থাৎ সকলের নিকট বোধগম্য করে তুলতেন বিষয়টিকে। তিনি কবি হিসেবেও মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে তিনি সামাজিক অসংগতি, বিশৃঙ্খলা ও অনাচার নিয়ে তার কাব্যে তুলে ধরেছেন এবং কাব্যগ্রন্থগুলি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ’খেরোখাতার পাতা থেকে’, ’মন খারাপের গাড়ি’ এবং ’জলে খুঁজি ধাতব মুদ্রা’ নামক তিনটি কাব্যগ্রন্থই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এবং বই মেলায় বিক্রির শীর্ষে ছিল। প্রেম, ভালবাসা, বেদনা, সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ তিনি অত্যন্ত দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন আপন মহিমায়। কাব্যের নবায়ন নির্যাসে তিনি একটি বিশেষ পাঠকমহল তৈরিতে সমর্থ হয়েছিলেন। প্রতিটি বইমেলায় তথা তার মৃত্যুর পরেও অজস্র পাঠকের সমাবেশ অন্তত তাই প্রমাণ করে থাকে। তিনি তার পাঠকের নিকট মহিরুহের ন্যায় জাগরুক থাকবেন এবং বেজে উঠবেন মুক্তির স্লোগানে।
শাকিল ভাই বিভিন্ন মেয়াদে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি মূলত ছাত্ররাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্রলীগকে তিনি হৃদয়ে ধারণ করতেন কারণ ছাত্রলীগের মাধ্যমেই তার রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটে। পাশাপাশি ছাত্রলীগকে নিয়ে কেউ ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করলে তিনি তার লেখনির মাধ্যমে তার প্রতিবাদ করতেন। এখনো ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা একজন শাকিল ভাইকে হারানোর শোকে মুহ্যমান। ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের অবস্থানকে শাকিল ভাইয়ের মাধ্যমে তুলে ধরতো। শুধু কি ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের যে কোন নেতাকর্মীই শাকিল ভাইয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পেতেন। অর্থাৎ তাদের বিষয়গুলোকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতেন আর প্রধানমন্ত্রীও শাকিল ভাইকে ছেলের মতই স্নেহ করতেন। দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি তার মতামত প্রধানমন্ত্রীর কাছে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতেন।
লেখক ও কবি হিসেবে তিনি বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন যেমন রাজনৈতিক বক্তব্য লিখনে তেমনি কবিতার পংক্তিমালায়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় দলের পক্ষ হতে প্রেস নোট দেওয়ার সময় যে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হতো তার বেশির ভাগই আসতো শাকিল ভাইয়ের প্রচেষ্টায়। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরী ও আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকানের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো শাকিল ভাইয়ের। নিবিষ্ট চিত্তে গবেষণার মাধ্যমে দলের জন্য উপাত্ত সংগ্রহ করতেন তিনি। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শাকিল ভাইয়ের ছিল অসামান্য অবদান। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তার তৈরি ড্রাফট সহজেই পছন্দ হতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আওয়ামী লীগের থিঙ্কট্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত সিআরআই এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের প্রতি শাকিল ভাইয়ের আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। দলের যে কোন সংকট বা দুঃসময়ে তিনি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে করার চেষ্টা করেছেন।
শিল্প-সাহিত্য তথা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পী সমাজের সাথে শাকিল ভাইয়ের ছিলো সুসম্পর্ক। প্রধানমন্ত্রীর সাথে উল্লেখিত সেক্টরের মানুষের ভাল-মন্দের যোগসূত্র তথা সেতুবন্ধন তৈরিতে শাকিল ভাইয়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে কোন অসুস্থ শিল্পী বা সাংবাদিকের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে করার ব্যবস্থা করা হতো শাকিল ভাইয়ের মাধ্যমেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সৃজনশীল মানুষের পক্ষে বরাবরই সংবেদনশীল। কোন শিল্পী বিদেশে চিকিৎসারত অবস্থায় মারা গেলে তার দেশে আনার ব্যাপারে সরকারি সুযোগ সুবিধা ব্যবস্থা কিন্তু শাকিল ভাইয়ের মাধ্যমেই হতো। মৃত্যুর পরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দাফন পর্যন্ত সবকিছুর তদারকি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শাকিল ভাই দক্ষ চালকের ন্যায় সামলেছেন।
মাহবুবুল হক শাকিল তার ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ জীবনে কখনো কারো চৌর্যবৃত্তি করেননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন মৃত্যুঅবধি। নিজের দক্ষতা ও পেশাগত কারিশমার মাধ্যমে ময়মনসিংহের ছেলে শাকিল ভাই জাতীয় রাজনীতিতে অর্থপূর্ণ অবস্থানে উঠে এসেছিলেন। কাজের প্রতি অত্যন্ত নিবিষ্ট ছিলেন এবং কোন কাজ শুরু করলে শেষ না করে শান্তি পেতেন না। কাজের ব্যাপারে খুব খিটখিটে ছিলেন, নিজের শতভাগ দিয়ে কাজ পুনরুদ্ধার করার চেষ্টায় নিবেদিত প্রাণ ছিলেন তিনি। তিনি আড্ডাবাজ ছিলেন, বন্ধুদের জমিয়ে রাখতেন নিজের হাস্যরসাত্নক কথামালায়। ছেলেমানুষিও লক্ষ্য করা গেছে শাকিল ভাইয়ের চরিত্রে, মাঝে মধ্যে বন্ধুমহল ও পরিচিতজনদের পকেটে রিকশা ভাড়ার টাকাও গুঁজে দিতেন। বইমেলায় ভক্তদের সাথে ছবি তুলতে পছন্দ করতেন। দলের কর্মীসমর্থকদের বই পড়ার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করতেন। ভ্রমণপিপাসু ছিলেন শাকিল ভাই, সময় পেলেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেরিয়েছেন সহকর্মীদের সাথে।
শেখ হাসিনার ছায়াসঙ্গী ছিলেন মাহবুবুল হক শাকিল। ‘কারাগারের রোজনামচা’ শীর্ষক বইয়ের ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইটির পান্ডুলিপি পাঠকের হাতে তুলে দেওয়ার নেপথ্যে শাকিল ভাইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে সজাগ থাকায় রিপোর্ট তৈরিতে সহজ হত শাকিল ভাইয়ের। তাছাড়া কোন জটিল বিষয়কে সহজ সাবলীল ভাষায় রূপান্তরের বিষয়ে তার জুড়ি মেলা ভার। জটিল বিষয়গুলো খুব সহজেই আত্নস্থ করে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে শাকিল ভাই ছিলেন অভিনব। দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর সাথে থাকায় প্রধানমন্ত্রীর চাহিদা মোতাবেক অফিসিয়াল তথ্যাদি যথাযথভাবে সরবরাহ করতেন এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগিতা করেছেন।
দলের ক্ষতিগ্রস্থ নেতাকর্মীদের বিশেষ করে দুঃসময়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রতি শাকিল ভাইয়ের ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা। নিজ উদ্যোগে তিনি তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন এবং সাধ্যানুযায়ী কিছু একটা করার চেষ্টা করতেন। সারাদেশের ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীদের রাজনীতির মাঠে সক্রিয় করার জন্য তিনি ফোন কিংবা চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করতেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দীর্ঘদিন ছিলেন কিন্তু তার বিরুদ্ধে ক্ষুণাক্ষরেও তার শত্রুরাও দুর্নীতির কোন অভিযোগ তোলার সাহস পাননি। নিজ দায়িত্বটাকেই পবিত্র মনে করে প্রধানমন্ত্রীকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছেন।যেখানে নিজের ব্যক্তিগত আকাঙ্খা কখনোই প্রকাশ পায়নি।
একটা মানুষ পৃথিবী থেকে চলে যাবার পর তার ভালমন্দ সহজেই সকলের গোচরীভূত হয়। শাকিল ভাই কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তা অনুমান করা গিয়েছে তিনি মারা যাবার পর পরই। শাকিল ভাইয়ের মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশ কিছুটা সময়ের জন্য হলেও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ফেসবুকে শোকে মাতম হয়ে গিয়েছিলো পুরো বাংলাদেশ। অনেকেই শাকিল ভাইয়ের এই অকাল মৃত্যুকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে শাকিল ভাইয়ের জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিলো। শাকিল ভাইয়ের প্রাণের শহর ময়মনসিংহে ২য় জানাজায় জনস্রোত নেমেছিলো।
শাকিল ভাই বেঁচে থাকবেন তার সৃষ্টিতে, তার কর্মের মাধ্যমেই বাংলার মানুষ স্মরণ করবে তাদের প্রিয় কবিকে। যেখানেই থাকুন ভাই সৃষ্টিকর্তা আপনাকে অপার শান্তিতে রাখুন।