সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর বিভিন্ন হাসপাতালের অবহেলায় চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে সাংবাদিক শামীম আহমেদের শিশুকণ্যা স্বর্ণা। শামীম আহমেদ বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন নিউজের নেত্রকোনা জেলা প্রতিনিধি। সাড়ে চার বয়সী শিশু কন্যা স্বর্ণা দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার পর নেত্রকোনা ও রাজধানীর নামকরা হাসপাতালগুলোতে ঘুরেও শামীম আহমেদ যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা পাননি বলে অভিযোগ উঠেছে।
মেয়ের চিকিৎসা পেতে হয়রানির অভিজ্ঞতা সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করেছেন তার সহকর্মী আরাফাত সিদ্দিক সোহাগ। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, গত ২৪ এপ্রিল নেত্রকোণায় নিজেদের বাড়ির পাশেই বন্ধুদের সঙ্গে খেলছিলো। পাশেই ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ঠিক করছিলো এক লোক। হঠাৎ যান্ত্রিক গোলযোগে অটোরিকশাটি ছুটে এসে স্বর্ণাকে চাপা দেয়। আহত হয় আরও একজন। অটোর সামনের একটি রড স্বর্ণার মাথায় আঘাত করে।
স্বজনরা মেয়েকে নিয়ে যায় নেত্রকোণা সদর হাসপাতালে। সেখানে স্বর্ণার মাথায় ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করা হয়। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তবে সেখানেও ডাক্তাররা জানান, মাথায় আঘাতের চিকিৎসা ওই হাসপাতালে সম্ভব নয়। তারাও নতুন করে ব্যান্ডেজ করে। স্যালাইন লাগায়।
রক্তক্ষরণে স্বর্ণার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। স্বর্ণার বাবাই তাকে রক্ত দেয়। রক্তের ব্যাগসহ তুলে দেয়া হয় অ্যাম্বুলেন্সে।
সন্ধ্যা নাগাদ স্বর্ণা ও তার স্বজনরা সাবেক বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছুলে ডাক্তার জানান, হাসপাতালে কোন সিট খালি নেই। আর সিট খালি না থাকলে চিকিৎসা দেবার নিয়ম নেই তাদের।
পরে স্বর্ণাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসা শুরু হয়। ওইদিন রাতে শিশুটির সিটি-স্ক্যান করানো হয়। স্বর্ণাকে রাখা হয় ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডের বারান্দায়। বুধবার রাত দুটার দিতে স্বর্ণার অবস্থার অবনতি হয়। চিকিৎসকরা দ্রুত আইসিইউতে নেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আইসিইউতে সিট খালি ছিল না।
আইসিইউ এর জন্য স্বর্ণাকে নেয়া হয় ল্যাবএইড হাসপাতালে, বয়স আর ইনজুরির ধরণ শুনে, বলা হয় সিট নেই আইসিইউতে। সেখান থেকে সেন্ট্রাল হসপিটাল। সেখানেও ভর্তি নেয়নি। স্কয়ার হাসপাতালও একই কথা বলে। তবে অপারগতা প্রকাশের আগে স্কয়ার হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়। স্কয়ার থেকে হতাশ হয়ে স্বর্ণাকে নেয়া হয় মহাখালীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালে। সেখানেও নানা টালবাহানার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় তারা রোগী রাখবে। তবে প্রতিদিন ভাড়া গুনতে হবে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার।তাদেরকে লিখিত দিতে হয় যে, দুপুরের আগে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা জমা দেয়া হবে।
মেট্রোপলিটনের আইসিইউতে নেয়ার পর, সেখানকার ডাক্তার রোগীর অবস্থা থেকে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। চিকিৎসক জানান, তাদের এখানে এনআইসিইউ বা পিআইসিইউ নেই। প্রয়োজনে বাচ্চাটিকে লাইফ সাপোর্ট দিতে পারবেন না তারা।
উপায় না দেখে আবারো হাসপাতাল পরিবর্তন করে স্বর্ণাকে নেয়া হয় আয়েশা মেমোরিয়ালে। স্বর্ণাকে সরাসরি তারা পিআইসিইউতে নিয়ে যায়।সেখানকার ডাক্তার জানায়, বাচ্চাটাকে হয়তো লাইফ সাপোর্ট দেয়া লাগতে পারে। আবার নাও লাগতে পারে। তবে মাথায় অপারেশন লাগবে। মাথার খুলির কিছুটা অংশ ভেঙ্গে ঢুকে গেছে। সকালে নিউরো সার্জন এসে সিদ্ধান্ত নেবেন কী করবেন।
পরদিন তারা ১১টার দিকে তারা জানালো স্বর্ণার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। একটু স্থিতিশীল না হলে অপারেশন করা সম্ভব না। রাতে কবি নির্মলেন্দু গুণ স্বর্ণাকে দেখতে হাসপাতালে যান। ডাক্তার জানান, শুধু মাথার খুলি নয়, স্বর্ণার কানের পাশে হাড়ও ভেঙ্গেছে। তবুও একটু আশায় ছিলেন তিনি। যদি কোন মিরাক্যাল হয়। শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো।
পরদিন স্বর্ণার অবস্থা একটু ভালো হলো। তবে সন্ধ্যায় ডাক্তার জানালেন, আর কিছুই করার নেই তাদের। এভাবেই শিশু স্বর্ণা দেশের চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থার নির্মম চিত্রের ভূক্তভোগী হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করে।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ ও দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন অনেকে। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ক্ষোভ ঢেকে রাখতে না পেরে লিখেছেন, ‘মা স্বর্ণা-তুই আমাদের ক্ষমা করিস না’।