হলমার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটন করে নিজেই বিপদে পড়েছিলেন সোনালী ব্যাংকের জিএম মাসরুরুল হুদা সিরাজী। সত্য উদঘাটন করে নানাভাবে অপদস্তও হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। অবশেষে ধৈর্য্য আর সততার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের এমডি হিসেবে তাকে নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
বাংলাদেশ-সুইডেন পলিটেকনিকে শিক্ষক মাইনুল এইচ সিরাজী তাকে নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ।
সিরাজীর স্ট্যাটাসটি এখানে তুলে ধরা হলো-
আপনাদের কি মনে আছে সোনালী ব্যাংকের সেই জিএম মাসরুরুল হুদা সিরাজীর কথা? যিনি হল-মার্ক কেলেঙ্কারি উদ্ঘাটন করে নিজেই বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়েছিল, বছরের বছর থেকেছেন পদোন্নতিবঞ্চিত৷ সামাজিক-পেশাগত জীবনে অপদস্ত হয়েছেন৷ কিন্তু তিনি একদিকে রক্তচক্ষু অন্যদিকে লোভনীয় প্রস্তাব উপেক্ষা করে সততা, সাহস আর নিষ্ঠার প্রশ্নে অবিচল ছিলেন৷ ভেঙে পড়েননি৷ সততার জয় অবশেষে হয়েছে৷
গত বছরের জানুয়ারিতেই তাকে পদোন্নতি দিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ডিএমডি করা হয়। সন্তুষ্ট অর্থমন্ত্রী এবার সিরাজীর ওপর আস্থা রাখলেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী হিসেবে। আজ ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন শুরু করলেন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের এমডি হিসেবে।
সিরাজী ২০১২ সালের ১ জানুয়ারি সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বিভাগের (আইটিএফডি) জিএম পদে যোগ দিয়েই ডিসেম্বরের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন থেকে স্থানীয় শাখা, রূপসী বাংলা শাখা ও গুলশান শাখার অনিয়মের কিছু তথ্য পান।
তিনি জানতে পারেন, রূপসী বাংলা শাখায় এই গুরুতর অনিয়ম শুরু হয়েছে ২০১০ সাল থেকে। কালক্ষেপণ না করে তাৎক্ষণিক এই তিন শাখা পরিদর্শনের জন্য অনুমতি চান এমডি’র কাছে। তৎকালীন এমডি নিরীক্ষা চালানোর অনুমোদন দিলেও এর সঙ্গে একটি মৌখিক নির্দেশ দেন― সবার শেষে যেতে হবে রূপসী বাংলা শাখায়। সেভাবেই কাজ চলছিল। কিন্তু রূপসী বাংলা শাখা নিরীক্ষার সময় এলে বাধা হয়ে দাঁড়ান অডিটের ডিএমডি।
হলমার্ক গ্রুপকে রূপসী বাংলা শাখা থেকে লুটপাটের সুযোগ করে দেয়ার জন্য সময়ক্ষেপণের কৌশল নেন তিনি। পরিদর্শন দলের সদস্যদের বিভিন্ন সময় ডেকে এনে অন্য কাজ দেন। এই সুযোগে বাড়তে থাকে রূপসী বাংলা শাখার অনিয়ম।
কর্তৃপক্ষের প্রচণ্ড বিরোধিতা সত্ত্বেও ১ এপ্রিল অডিট নোট ইস্যু করিয়ে নেন জিএম সিরাজী। ঠিক হয় ৪ এপ্রিল, ২০১২ থেকে শুরু হবে পরিদর্শনের কাজ। কিন্তু এরপর শুরু হয় নতুন এক সঙ্কট। ওই দিনই আইটিএফডির জিএম মাসরুরুল হুদা সিরাজীকে বদলি করা হয় সিলেটে। পরদিনই ছাড়পত্র দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ৩ মাস পর পাঠানো হয় আবার রংপুরে। সিরাজীর গঠন করা চৌকস অডিট টিম ভেঙে দিয়ে নিজেদের পছন্দমতো টিম গঠন করা হয়।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণমাধ্যমে হলমার্ক কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যায়। সমালোচনা আর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সোনালী ব্যাংক আর হলমার্ক গ্রুপের বিরুদ্ধে। আর পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসেন জিএম সিরাজী। কারণ তার কারণে উদ্ঘাটিত হয়েছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যাংক কেলেংকারির ঘটনা। গণমাধ্যম, ব্লগ, ফেসবুকে দারুণ প্রশংসিত হন তিনি। মাসরুরুল হুদা সিরাজীকে জাতীয় বীর হিসেবে পুরস্কৃত করার দাবিও উঠেছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে।
কিন্তু ‘পুরস্কার’ তিনি পান অন্যভাবে। দুর্নীতি দমন কমিশন ৩৭টি মামলায় তাকে আসামি করে দেয়।
তদন্ত চলাকালীন দুই বছরে বিপর্যয় নেমে আসে তাঁর জীবন ও ক্যারিয়ারে। নিবেদিতপ্রাণ, সাহসী কর্মকর্তাকে তার সৎসাহসের অভূতপূর্ব খেসারত দিতে হয়। তার ‘অবৈধ সম্পদ’র খোঁজে দেশব্যাপী চালানো হয় অভিযান। তবে ব্যাংকঋণে কেনা ঢাকায় ছোট্ট একটি ফ্লাট ছাড়া কিছুই খুঁজে পায়নি দুদক। এই সময়ে তিনি সামাজিক ও পেশাগতভাবে অপদস্থ হন। বঞ্চিত হন পদোন্নতি থেকে। অবশেষে ৩৭টি মামলার চার্জশিটে জিএম সিরাজীকে অভিযুক্তের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে।
কিন্তু দেরীতে হলেও সততার জয় হয়েছে৷ আজ তিনি ব্যাংকের সর্বোচ্চ পদে যোগ দিলেন৷ তাঁর দুঃসময়ে যাঁরা পাশে থেকেছেন, সবার প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন৷