চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে’

তাঁকে যাঁরা দূর থেকে অবলোকন করেন, এমনকি যাঁরা কাছাকাছিও হয়েছেন, তাঁদের কাছে মনে হতে পারে, রসকষহীন নিরেট একটি পাথর। যেন তাঁর কোনো লাবণ্য নেই। সুষমা নেই। সৌন্দর্য নেই। এমনটি মনে হওয়ার কারণ, তিনি সবার সঙ্গে খুব একটা মেলামেশা করেন না। যার-তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রশ্নই আসে না। তাঁকে খুব একটা হাসতেও দেখা যায় না। বেশির ভাগ সময় চুপচাপ থাকেন। কাজ করেন আপন মনে। তাঁকে গম্ভীর প্রকৃতির বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। তিনি তাঁর চাবুকের মতো সুগঠিত দেহের মতো স্ট্রেইটকাট। কাউকে পরোয়া করেন না। আর আপোষ করার প্রশ্নই আসে না। নিজে যেটা বিশ্বাস করেন, সে বিষয়ে তাঁকে টলানো আর পাহাড় ধাক্কা দিয়ে নড়ানোর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। আলোচনার টেবিলে তাঁকে দেখা যায় ভিন্ন মেজাজে। পাকা বিতার্কিকের মতো তাঁর মুখে যেন কথার খই ফোটে। রাজনৈতিক বিষয় হলেতো কথাই নেই। ইতিহাসের পাতা থেকে অবলীলায় একের পর এক উপস্থাপন করেন বিভিন্ন প্রসঙ্গ। তাঁর সামনে হকচকিয়ে যান ঝানু ঝানু আলোচকরাও। তিনি যিনিই হন না কেন, তাঁর কথা শুনতে বাধ্য না হয়ে পারেন না। কণ্ঠের তীব্রতা, যুক্তির ধার আর ইস্পাতদৃঢ় মনোবল নিয়ে তিনি যখন আলোচনার ঝড় তোলেন, তখন দেখতে পাওয়া যায় টগবগিয়ে ফুটতে থাকা একজন বিপ্লবীকে। তাঁর উপস্থিতিতে সব সময় আলোচনা যে সুখকর হয়, তা বলা যাবে না। প্রায়শই তপ্ত হয়ে ওঠে আড্ডার মেজাজ। পাল্টা যুক্তি দিয়ে তাঁকে কাবু করার চেষ্টা করা হয়। তাতে তিনি দমে যাওয়ার পাত্র নন। এ কারণে মনোমালিন্যও হয়। অনেকে তাঁকে আগ্রাসী ও উগ্র মেজাজী হিসেবেও অভিহিত করেন। এ নিয়ে তাঁর খুব একটা ভাবান্তর হয় না। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের অনুরক্ত হওয়ার কারণে তাঁকে ‘আয়রনম্যান’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। সামনাসামনি এমনটি বলা হলেও তাঁর চিকন হাসিটি ঠিকই অনুভব করা যায়। আর তিনি হলেন এক ও অদ্বিতীয় সুধীর কৈবর্ত দাস।


ঘটনাবহুল এক জীবন পেরিয়ে এসেছেন তিনি। যে অবস্থান থেকে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, তা মোটেও সহজ ছিল না। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সন্তান হলেও ১৯৫০ সাল থেকে তাঁর বেড়ে ওঠা ও প্রতিষ্ঠা মূলত ঢাকার শাঁখারিবাজারকে কেন্দ্র করে। সামাজিকভাবে একটু আড়ালে থাকা এ এলাকায় তিনি ছিলেন প্রতিবাদী এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ। সেই ষাট দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। প্রকম্পিত রাজপথের মিছিলে তিনিও ছিলেন সাহসী এক মুখ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তদানীন্তন ছাত্রনেতা গয়েশ্বর রায়, স্বপন চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় তিনি সক্রিয়ভাবে তাতে অংশ নেন। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের টাটকা স্মৃতি নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতির পাশাপাশি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। একটা পর্যায়ে হয়ে ওঠেন পুরোদস্তর পেশাদার সাংবাদিক। দীর্ঘ জীবনে অর্জন করেছেন বৈচিত্র্যময় ও বর্ণময় অভিজ্ঞতা।

আপাতদৃষ্টিতে বহিরঙ্গের সুধীর কৈবর্ত দাসকে কঠিন ও কর্কশ মনে হলেও খুব গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারলে অনুভব করা যায় তাঁর ভিতরের ঐশ্বর্য ও পেলবতাকে। অনেকটা তালশাঁসের মতো। তাঁর বুকের মধ্যে বয়ে চলে ভালোবাসার স্রোতস্বিনী নদী। সেটা কিন্তু বাইরে থেকে অনুধাবন করা যাবে না। তাঁকে যাঁরা অন্তরঙ্গভাবে চেনেন কিংবা জানেন, তাঁরা অন্তত সেটা অনুধাবন করতে পারেন। অনেকেই পেয়েছেন তাঁর আন্তরিকতা, স্নেহ ও ভালোবাসা। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে তিনি মোটেও দ্বিধা করেন না। এ কারণে নীরবে গড়ে ওঠেছে তাঁর একদল অনুসারীও।

এবারের বইমেলায় নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়েছেন সুধীর কৈবর্ত দাস। বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিবরে বিভূতি’ এবং গল্পগ্রন্থ ‘সৌপ্তিক’। তাঁর বুকের মধ্যে যে লুকিয়ে আছে একজন সৃজনশীল লেখক, সেটা এবার যেন পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করা যায়। তাঁর গ্রল্পগন্থে স্থান পেয়েছে সাতটি গল্প। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে লেখা গল্পগুলো ছাপা হয় বিভিন্ন পত্রিকায়। গল্পের বিষয়বস্তু ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সমস্যা-সংকট, মানসিক দ্বিধা-দ্বন্ধ, নিম্নবিত্তের কঠিন জীবন সংগ্রাম, নগরজীবনের আর্থ-সামাজিক টানাপড়েন, মানবিক মূল্যবোধ, শরণার্থী জীবনের দুঃসহতা। তাঁর লেখায় একইসঙ্গে বাঙময় হয়েছে শহর ও গ্রামীণ জীবনের দৃশ্যপট। আঞ্চলিক ভাষায়ও তিনি তাঁর মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।

আবেগ, উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা যে সুধীর কৈবর্ত দাসকে দারুণভাবে আপ্লুত করে, সেটা অনুধাবন করা যায় তাঁর কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করলে। তাঁর কবিতায় প্রেম-প্রীতি, পরিবেশ-প্রকৃতি, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা, শ্রম-ঘাম, চাওয়া-পাওয়া, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, আক্ষেপ, হাহাকার মূর্ত হয়ে ওঠেছে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের লড়াই-সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধও স্থান করে নিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রেমিক, বিপ্লবী, সামাজিক, রাজনৈতিক ও মানবিক সত্তা। গদ্য ও পদ্যে তিনি যে সমান দক্ষ, সেটাও বুঝতে পারা যায়।


সুধীর কৈবর্ত দাসের হৃদয়ে সাহিত্যের বীজ রোপিত হয় তরুণ বয়সে। ১৯৬৭ সালের মে মাসে শিশু-কিশোর সাহিত্যপত্র মাসিক ‘মুকুল’-এ ছাপা হয় তাঁর প্রথম লেখা ‘আগন্তুক’। রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাগত কারণে লেখালেখিতে তিনি নিয়মিত ছিলেন না। তবে সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বরাবরই তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। ১৯৭৮ সালে নিজের উদ্যোগে প্রকাশ করেন সাহিত্য পত্রিকা ‘তমসুক’। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। আশির দশকে অনিয়মিতভাবে গল্প লেখা শুরু করেন। গল্পকার হিসেবে তাঁর মধ্যে সম্ভাবনা থাকলেও তিনি তাতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করেননি। সেই সময় থেকে দেশের প্রধান বইয়ের বাজার বাংলাবাজারের সঙ্গে নানাভাবে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নর্থব্রুক হলের সর্বজনীন পূজা কমিটির পূজা সংখ্যা ‘শঙ্করী’ এবং সংঘমিত্র পূজা কমিটির পূজা সংখ্যা ‘অকালবোধন’ পত্রিকার সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। দীর্ঘ দিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৩ সাল থেকে প্রকাশনা সংস্থা ‘অক্ষরবৃত্ত’-এর তিনি ছিলেন অন্যতম কাণ্ডারি। এ প্রতিষ্ঠান থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীসহ দেশবরেণ্য অনেক লেখকের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নানা কারণে সম্ভাবনাময় এই প্রকাশনা সংস্থাটি দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। বছর পাঁচেক আগে জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে প্রকাশিত ‘কবিতাপত্র’ পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠলে তিনি নতুন করে নিমগ্ন হন কবিতার ভুবনে। আর এখনতো লেখালেখিটা হয়ে ওঠেছে তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিডিয়া সেন্টারে গেলে দেখা যায়, কম্পিউটারের মনিটরের সামনে ধ্যানস্থ হয়ে আছেন তিনি। হয় লিখছেন নতুন কোনো কবিতার পংক্তি কিংবা বাবুই পাখির মতো বুনে চলছেন গল্পের নকশা। কখনো কখনো সুরেলা কণ্ঠে গুন গুন করে চলেছেন মান্না দে কিংবা পুরনো দিনের কোন জনপ্রিয় গানের কলি। তখন তাঁকে একদমই অচেনা মনে হয়।


আবুল হাসানের কবিতা ‘আবুল হাসান’-এর অমর সেই পংক্তি ‘সে এক পাথর আছে কেবলি লাবণ্য ধরে, উজ্জলতা ধরে আর্দ্র’ অনেকটাই যেন খাপ খেয়ে যায় সুধীর কৈবর্ত দাসের সঙ্গে। তাঁকে ‘পাথরমানব’ মনে হলেও বুকের মধ্যে যে লালিত্য, যে মাধুর্য, যে সৌন্দর্য তিনি বয়ে বেড়ান, তার নাগাল সবার পক্ষে পাওয়া সম্ভব হয় না। তবে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশিত হচ্ছেন একজন আশেক, একজন অনুভূতিশীল, একজন হৃদয়বান সুধীর ‘কুমার’ দাস। সরি, সুধীর কৈবর্ত দাস।