চলচ্চিত্রকে বলা হয় সমাজ বদলের বড় একটি হাতিয়ার। সাধারণ মানুষের জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটে চলচ্চিত্রে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার হলেও খুব কমই নির্মিত হয়েছে এর উপর চলচ্চিত্র। তাই আক্ষেপের শেষ নেই চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের।
গণঅভ্যুত্থান নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’ যা সামাজিক প্রেক্ষাপটে গভীর দাগ কেটেছে।
১৯৭০ সালে মুক্তি পেয়েছিল জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’। ছবিতে দেখানো হয়েছে একগোছা চাবির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী স্বৈরচারী শাসন ক্ষমতা, প্রভাতফেরির চিত্র এবং ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান। এ চলচ্চিত্রে ব্যবহার হয়েছে দুটি গান- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ ও ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। পরবর্তীতে এই দুটি গানের প্রথমটি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, অন্যটি একুশের গান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ।
১৯৭০ সালে নির্মিত ফখরুল আলম পরিচালিত ‘জয়বাংলা’চলচ্চিত্রটি পাকিস্তান সেন্সর বোর্ড আটকে রাখে। ১৯৭২ সালে এটি মুক্তি পায়। ছবিটি মুলত ৬ দফা দাবির উপর নির্মিত হয়েছিল।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ ও ‘এ স্টেট ইজ বর্ন’। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীতার মুখে জহির রায়হান তার একটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের কাজ শেষ করতে পারেননি। সেটি হলো ‘লেট দেয়ার বি লাইট’।
আলমগীর কবির তৈরি করেন ‘লিবারেশন ফাইটার্স’। এছাড়া বাবুল চৌধুরী নির্মাণ করেন ‘ইনোসেন্ট মিলিয়ন’। এসব প্রামাণ্যচিত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা, গণহত্যা, শরণার্থী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, মুজিবনগর সরকারের তৎপরতাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়।
১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ওরা এগারোজন’। এর পরিচালক পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম। ছবির অধিকাংশ কলাকুশলীই ছিলেন সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ১১জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে গঠিত গেরিলা দলের অভিযান এ চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়। এই এগারোজনের দশজনই ছিলেন সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধা। এরা হলেন খসরু, মঞ্জু, হেলাল, ওলীন, আবু, আতা, নান্টু, বেবী, আলতাফ, মুরাদ ও ফিরোজ। ১১ দফার ছাত্র আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে মাথায় রেখে প্রতীকী অর্থে এ চলচ্চিত্রের নামকরণ করা হয় ‘ওরা ১১ জন’। ১১ আগস্ট ১৯৭২ এ মুক্তি পায় এই চলচ্চিত্রে। ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ এবং ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলা স্বাধীনতা আনলে যাঁরা’ গানগুলো ব্যবহার করা হয়েছিলো।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত মোট দশটি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
১৯৭২ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি পায় সুভাষ দত্তের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’। কুসুমপুর গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, নারী নির্যাতন এবং প্রতিবাদে বাঙালিদের মুক্তি সংগ্রাম এবং যুদ্ধশিশুর মত বিষয় বেশ গুরুত্বের সাথে ফুটে উঠেছে এই চলচ্চিত্রে।
১৯৭২ সালে আলমগীর কবির ‘ডায়েরিজ অব বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর তৈরি করে ‘দেশে আগমন’।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় মমতাজ আলীর পরিচালনায় ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং আনন্দের পরিচালনায় ‘বাঘা বাঙালী’।
১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় আলমগীর কবির পরিচালিত ‘ধীরে বহে মেঘনা’, আলমগীর কুমকুম পরিচালিত ‘আমার জন্মভূমি’ এবং খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’। যুদ্ধপরবর্তী জীবনকে কেন্দ্র করে হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলিও দেখানো হয়েছে।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় চাষী নজরুল ইসলামের ‘সংগ্রাম’, আনন্দের ‘কার হাসি কে হাসে’ এবং নারায়ণ ঘোষ মিতার ‘আলোর মিছিল’ চলচ্চিত্রগুলো।
১৯৭৬ সালে হারুনুর রশিদ নির্মাণ করেন ‘মেঘের অনেক রং’। এ চলচ্চিত্রের পুরো কাহিনী উঠে এসেছে একটি শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে।
১৯৮১ সালে শহীদুল হক খানের চলচ্চিত্র ‘কলমীলতা’ মুক্তি পায়। ‘কলমীলতা’ মুক্তি পাওয়ার পর প্রায় ১৩ বছর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। ওইসময় মূলধারার চলচ্চিত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধ হারিয়ে গেলেও বিকল্পধারা হিসেবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের নির্যাস।
১৯৮৪ সালে মোরশেদুল ইসলাম তৈরি করেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’। ১৯৮৫ সালে আলমগীর কবীর নির্মাণ করেন ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’। ১৯৮৮ সালে মোরশেদুল ইসলামের পরিচালনায় ‘সূচনা’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। ১৯৯২ সালে আবু সায়ীদ নির্মাণ করেন ‘ধূসরযাত্রা’।
স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের এইধারায় ১৯৯৩ সালে শাহরিয়ার কবিরে উপন্যাস ‘একাত্তরের যীশু’ অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। গল্পকার ক্রুশবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের যীশুর সঙ্গে তুলনা করে চলচ্চিত্রের নামকরণ করেছেন ‘৭১-এর যীশু’।
এই সময় বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর উদ্যোগেও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার মধ্যে হারুনুর রশিদ পরিচালিত ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ (১৯৯৩), রফিকুল বারী চৌধুরী পরিচালিত ‘বাংলা মায়ের দামাল ছেলে’ (১৯৯৭) এবং বাদল রহমান পরিচালিত ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’ (২০০৮) উল্লেখযোগ্য।
১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’। মুক্তিযুদ্ধে এক তরুণীর আত্মত্যাগের ঘটনাসহ যুদ্ধকালীন নানাদিক উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে।
১৯৯৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ধারার প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ। আমেরিকান সাংবাদিক লিয়ার লেভিনের তোলা মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন চলচ্চিত্র নিয়ে নির্মিত হয় এটি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশি শিল্পীরা বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও রণাঙ্গনে গান গেয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার যে ভূমিকা পালন করেছিলেন তা উঠে এসেছে এই প্রামাণ্যচিত্রে। পরবর্তীতে তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ এই ছবির সিক্যুয়াল হিসেবে নির্মাণ করেন ‘মুক্তির কথা’(১৯৯৮) এবং ‘নারীর কথা’ (২০০০)।
১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় তানভির মোকাম্মেল পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘নদীর নাম মধুমতি’। ১৯৯৭ সালে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের গল্প অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম নির্মাণ করেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। একই বছর খান আতাউর রহমান নির্মাণ করেন ‘এখনো অনেক রাত’।
২০০২ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র ‘শ্যামল ছায়া’। একই বছর আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এগুলো হলো- তৌকির আহমেদের ‘জয়যাত্রা’ এবং কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেন ‘মেঘের পরে মেঘ’।
২০০৬ সালেও চাষী নজরুল ইসলাম তৈরি করেন আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্র ‘ধ্রুবতারা’ । একই বছর মাহমুদুল হকের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস অবলম্বনে ‘খেলাঘর’ তৈরি করেন মোরশেদুল ইসলাম।
২০১০ সালে তারেক মাসুদের ‘নরসুন্দর’ এবং তানভীর মোকাম্মেল-এর ‘রাবেয়া’ মুক্তি পায়। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয় এ ছবিতে।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে ২০১১ সালে মুক্তি পায় নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এ চলচ্চিত্রটি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা ছবি হিসেবে পুরস্কৃত হয়। দেশে অর্জন করেছে বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার।
একইবছর সরকারি অনুদানে মুহম্মদ জাফর ইকবাল-এর জনপ্রিয় একটি শিশুতোষ উপন্যাস অবলম্বনে ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ ছবিটি নির্মাণ করেছেন মোরশেদুল ইসলাম।
২০১১ সালে মুক্তি পায় রুবাইয়াত হোসেনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মেহেরজান’। ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে শাহজাহান চৌধুরীর ‘আত্মদান’ এবং জাহিদুর রাহিম অঞ্জলের চলচ্চিত্র ‘মেঘমল্লার’।
গত দুই বছরে মুক্তি পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিক্তিক ছবি ‘৭১ মা জননী’, ‘জীবনঢুলী’ ছবি দুটি। ২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে নির্মিত হয়েছে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র । এগুলো হলো-শোভনের স্বাধীনতা, একাত্তরের ক্ষুদিরাম, বাপজানের বায়োস্কোপ ও অনিল বাগচীর একদিন প্রভৃতি।
২০১৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এগুলো হলো- লাল সবুজের সুর ও ভূবন মাঝি। এর মধ্যে শেষের ছবিটি সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণের সংখ্যা কম প্রসঙ্গে নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘আসলে নির্মাতাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবণতা কম। একটি সমস্যাও আছে অবশ্য। সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে লগ্নীকারক পাওয়া যায় কম। এজন্য হয়তো মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহ পায় না অনেকে। তবে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার। আগামী প্রজন্মের কাছে এর সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’
ছবি : সংগৃহীত