চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

অফিসাররা গুলি করতে করতে দরজা ভেঙে সেরনিয়াবাতের বাড়িতে ঢোকে

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়। ভয়াবহ সেই দিনটির কথা উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষীদের জবানবন্দিতে। জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায় সেদিনের ভয়াবহতার চিত্র। জানা যায় ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন ৩২ নম্বরের বাড়িটির ভেতরে-বাইরে। সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে চ্যানেল আই অনলাইনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দশম পর্ব।

প্রসিকিউশনের ২৭নং সাক্ষী হাবিলদার হারুন-অর-রশিদ আদালতকে বলেন, ঘটনার সময় ২-ফিল্ড আর্টিলারির ‘পাপা’ ব্যাটারিতে কর্মরত ছিলেন তিনি। মেজর মহিউদ্দিন তাদের ব্যাটারি কমান্ডার ছিলেন। ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে নাইট ট্রেনিংয়ের জন্য মার্চ করে নিউ এয়ারপোর্টে এবং পরে প্রায় ৩.৩০টার সময় মেজর মহিউদ্দিনের নির্দেশে গাড়িতে উঠে বালুর ঘাটে যান। সেখানে ল্যান্সার বাহিনীসহ অনেক আর্মি অফিসার দেখেন। রাত প্রায় ৪টার সময় একটি গাড়িতে কলাবাগানের কাছে লেকের পাড়ে গেলে তাদের ২-৩ জনকে মেজর মহিউদ্দিন রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে ওই রোডে লোক চলাচল বন্ধ রাখার ডিউটি দেয়। বালুর ঘাট থেকে আসার সময় তাদের গাড়িতে কামান ‘হুক’ করা ছিল। ১০-১৫ মিনিট পর উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হালকা অস্ত্রের গুলির শব্দ শোনেন। সঙ্গে কামানের গোলার আওয়াজও শোনা যায়।

পরের দিনের কথা জানিয়ে হারুন-অর-রশিদ বলেন, সকাল ৬টার পর একটি আর্মি গাড়ি এসে তাদেরকে গণভবনে নিয়ে যায়। তখন মেজর ডালিমের রেডিও ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কথা শোনেন। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর মেজর মহিউদ্দিনের হুকুমে কামানগুলি সেখান থেকে নিয়ে যান। তারাও ইউনিটে ফেরত যান। ইউনিটে গিয়ে মেজর ডালিম, মেজর ফারুক, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নুর, মেজর হুদা, মেজর রশিদ, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর আজিজ পাশা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করেছে বলে জানতে পারেন।

২৯নং সাক্ষী নায়েক সিহাব উদ্দিন
প্রসিকিউশনের ২৯নং সাক্ষী নায়েক সিহাব উদ্দিন আদালতকে জানান, ঘটনার সময় ২-ফিল্ড আর্টিলারির হেড কোয়ার্টার ব্যাটারিতে ছিলেন তিনি। ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে নাইট ট্রেনিংয়ের জন্য রোর্ড মার্চ করে নিউ এয়ারপোর্ট যান। রাত প্রায় ৩.৩০টার সময় তাদেরকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে কাছে বালুর ঘাট ল্যান্সার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ল্যান্সার ইউনিট থেকে গুলি নেন। তারপর মেজর রাশেদ চৌধুরী তাদেরকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে শহরের দিকে রওনা দিয়ে ভোর ৪.৩০টার সময় মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবনের কাছে এসে গাড়ি থামায়। তাদের পিছনে আরেকটি গাড়ি এসে সেখানে থামে। তখন মেজর রাশেদ চৌধুরীর নির্দেশে তারা মন্ত্রী সেরনিয়াবাতের বাসভবনের চারদিকে ডিউটি করেন।

ঘটনার বর্ণনা করে তিনি আদালতকে বলেন, মেজর রাশেদ চৌধুরী ও অন্যান্য অফিসাররা গুলি করতে করতে বাসভবনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢোকে। একটু পরেই ব্রাশফায়ার ও চিৎকারের আওয়াজ শোনেন। তারপর মেজর রাশেদ চৌধুরী ও অন্যান্যরা বাড়ির বাহিরে এসে তাদের সবাইকে গাড়িতে উঠিয়ে রেডিও সেন্টারে নামিয়ে দিয়ে চারদিকে তাদের ডিউটি বণ্টন করে। পরে জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু, সেরনিয়াবাত, ফজলুল হক মনি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। মেজর ফারুক, মেজর রশিদ, মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মেজর মুহিউদ্দিন (আর্টলারি), মেজর নুর, ক্যাপ্টেন মোস্তফা, ক্যাপ্টেন হুদা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল বলে জানতে পারে।

৩২নং সাক্ষী হাবিলদার সাজেদুল হক
প্রসিকিউশনের ৩২নং সাক্ষী হাবিলদার সাজেদুল হক ঘটনার সময় ২-ফিল্ড আর্টিলারিতে কর্মরত ছিলেন। তিনি আদালতকে বলেন, ক্যাপ্টেন মোস্তফা তাদের হেডকোয়ার্টার ব্যাটারির কমান্ডার ছিলেন। ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে নাইট ট্রেনিংয়ের জন্য রোড মার্চ করে নিউ এয়ারপোর্টে যান। লেঃ হাসান তাদের সাথে ছিল। রাত প্রায় ৩.৩০টার সময় মেজর রশিদ, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন জোবায়ের সিদ্দিকী, ক্যাপ্টেন মোস্তফা, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেঃ হাসান, মেজর ডালিমকে সেখানে দেখেন। মেজর ডালিমকে আগে থেকেই চিনতেন তিনি। মেজর রশিদের নির্দেশে তাদেরকে ট্রাকে উঠিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরের পারের রাস্তায় তাদের ৩-৪ জনকে নামিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার ডিউটি দেয়। ডিউটিতে থাকা অবস্থায় তাদের ৬টি কামান ও অনেকগুলি আর্মি গাড়ি ওই রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেন।

ফজরের আযানের পর পশ্চিম দিকে গুলির আওয়াজ শোনেন। সকাল বেলা ক্যান্টনমেন্টমুখী সৈনিকদের কাছে তাদের সৈনিকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কথা শোনেন। বিকেলে ইউনিটে গিয়ে জানতে পারেন মেজর ডালিম রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছে, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মোস্তাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হয়েছে।’ আরও জানতে পারেন মেজর ফারুক, মেজর রশিদ, মেজর ডালিম, মেজর নুর, মেজর আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন হুদা, মেজর মুহিউদ্দিন(আর্টিলারি), মেজর রাশেদ চৌধুরী এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল।

৩৪নং সাক্ষী সুবেদার জয়নাল
প্রসিকিউশনের ৩৪নং সাক্ষী সুবেদার জয়নাল জানান সাক্ষী দেওয়ার সময় কুমিল্লায় ফিল্ড আর্টিলারির সুবেদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। ঘটনার সময় ঢাকা সেনানিবাসে ২-ফিল্ড আর্টিলারিতে ছিলেন। মেজর মহিউদ্দিন তাদের ‘পাপা’ ব্যাটারির কমান্ডার ছিলেন। ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে নাইট ট্রেনিংয়ের জন্য নিউ এয়ারপোর্টে যান। রাত প্রায় ৪টার সময় তাদের ৬টি গান নিয়ে ধানমন্ডি লেকের পূর্ব পাশে গিয়ে আড়াআড়ি অবস্থান নেন। গানগুলি সেখানে বিভিন্ন জায়গায় সেট করা হয়। একটি গানের চার্জে হাবিলদার আবু তাহের, আরেকটি গানের চার্জে ল্যান্সনায়েক শামসু ছিল। তখন মেজর মহিউদ্দিন গানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সৈনিককে গলির মাথায় ডিউটি দেয়া হয়। যাতে লোকজন চলাচল করতে না পারে।

কিছুক্ষণ পর উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে হালকা হাতিয়ারের গুলির আওয়াজ শোনেন। সাথে সাথে মেজর মহিউদ্দিনের পাশের গান থেকে গুলি ছোঁড়া হয়। তাকে মিরপুর রোডের পূর্ব পাশে একটি বাড়ির ছাদে ডিউটি দেওয়া হয়। সকাল প্রায় ৭.৩০ টার সময় নায়েক সিরাজ তাকে ডেকে আনে। তখন গানগুলি ‘হুক করা’ অবস্থায় দেখেন। তারপর মুভ করার আদেশ পেয়ে সবাই গণভবনে যায়। দুপুরের পরে গান গাড়িসহ তারা ক্যান্টনমেন্টে ফেরত যায়। ইউনিটে গিয়ে জানতে পারেন যে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। দুপুরে খাবারের পর তারা ১০-১২ জন রেডিও সেন্টারে গিয়ে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ডিউটি করতে থাকেন।

৩৫নং সাক্ষী সুবেদার মেজর আনিসুল হক চৌধুরী
প্রসিকিউশনের ৩৫নং সাক্ষী সুবেদার মেজর আনিসুল হক চৌধুরী বলেন, ঘটনার সময় তিনি ২-ফিল্ড আর্টিলারির সুবেদার মেজর ছিলেন। মেজর রশিদ কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। তখন তাদের রেজিমেন্টে মেজর মুহিউদ্দিন ভারপ্রাপ্ত টু আই সি এবং ‘পাপা’ ব্যাটারির কমান্ডার ছিলেন। মেজর রাশেদ চৌধুরী এক সময় তাদের ইউনিটে ছিলেন। পরে তার চাকরি চলে যায়। ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাতে কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদের নির্দেশে ব্যাটারি কমান্ডারগণ নাইট ট্রেনিংয়ের জন্য সৈনিকদের নিয়ে নিউ এয়ারপোর্ট বালুর ঘাটে যায়।

রাত প্রায় ১০টার সময় মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক, জীপযোগে তাদের অফিসে এসে ‘চা’ খেতে চায়। কিন্তু সমস্ত লোক নাইট ট্রেনিংয়ে জানালে বলেন, দরকার নাই। তারপর তারা চলে যায়। পরের দিন ১৫ই আগস্ট সকাল ৬টার সময় মেজর রশিদের ড্রাইভার নায়েক আলী মিয়া এসে জানায় যে শেখ সাহেবকে মেরে ফেলেছে। এই বলে সে চলে যায়। তিনি অফিসে গেলে কোড ও এমিউনিশন গার্ড তাকে জানায়, কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, নায়েব সুবেদার মুহিবুর রহমান, হাবিলদার মেজর ফোরকান ও অন্যরা এসে স্টোর খুলে এমিউনিশন নিয়ে গেছে।

১৭ই আগস্ট সকাল ৮টার দিকে নায়েব সুবেদার দবির উদ্দিন এবং হাবিলদার সাইফুর রহমান তাকে জানায়, ক্যাপ্টেন মোস্তফা তার পার্টি ও সঙ্গে আরো অফিসার/ফোর্স নিয়ে মন্ত্রী সেরনিয়াবাতের বাড়িতে গেছিল। হাবিলদার তাহের ১৭ই আগস্ট সকাল ৯-১০টার সময় তাকে জানায় মেজর মহিউদ্দিন তার ‘পাপা’ ব্যাটারির বেশির ভাগ লোক নিয়ে ধানমন্ডির দিকে গেছিল। নায়েব সুবেদার সমসের আলী জানায়, তার পার্টি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এবং রেডিও সেন্টারে ছিল। তখন ফোর্সদের কাছে জানতে পারেন মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর হুদা, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর ডালিম, মেজর মুহিউদ্দিন (আর্টিলারি), মেজর নুর, মেজর শাহরিয়ার, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মুহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মেজর শরিফুল হোসেন, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, ক্যাপ্টেন কিসমত, ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন, ক্যাপ্টেন মাজেদ, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন মোস্তফা, ক্যাপ্টেন জোবায়ের সিদ্দিকী, লেঃ হাসানসহ আরো অফিসার ও সৈন্য বঙ্গবন্ধু ও তার আত্মীয়-স্বজনকে হত্যার ঘটনায় জড়িত ছিল।

প্রসিকিউশনের ৩৭নং সাক্ষী মোঃ রিয়াজুল হক
প্রসিকিউশনের ৩৭নং সাক্ষী মোঃ রিয়াজুল হক আদালতকে বলেন, সাক্ষী দেওয়ার সময় তিনি বাংলাদেশ বেতারে স্টেশন প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ঘটনার সময় বাংলাদেশ বেতার ভবনে রেডিও ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ওই সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার আগেই নির্ধারিত ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী তার সকাল ৬-২টা পর্যন্ত অফিস ছিলো। তিনি সরকারি গাড়িতে বাসা থেকে অফিসে রওনা দেন। সেই গাড়িতে তার সহযোগী টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজাউল করিম, টেকনিক্যাল অপারেটর কাউসার জাহান এবং মেকানিক খান নবীও ছিলেন। তারা বেতার ভবনের সামনে গেলে আর্মি সিপাহীরা তাদেরকে যেতে বাধা দেয়। পরিচয় দিলে তাদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে ভেতরে কন্ট্রোল রুমে বসিয়ে রাখে। তখন সকাল প্রায় সাড়ে ছয়টা হবে।

সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে রিয়াজুল হক আদালতকে জানান, কিছুক্ষণ পরে রেডিও স্পিকারে শুনতে পান ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, আর্মি ক্ষমতা দখল করেছে, কারফিউ জারি করা হয়েছে।’ চারজন বসা অবস্থায় বাইরে থেকে একটি টেলিফোন আসে। টেলিফোনটি তিনি ধরলে অপর প্রান্ত থেকে বলে ‘আমি মেজর রশিদ বলছি, মেজর ডালিমকে দাও।’ তখন কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিপাহীকে বললাম ‘মেজর ডালিমকে ডেকে আনেন।’ ডালিম টেলিফোনে কথা বলে। ডালিম টেলিফোনে বলছে, ‘গোলাবারুদ পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

সকাল প্রায় ৭টার দিকে একজন আর্মি সিপাহী ১২০০ ফিটের ৭-৮টি টেপ কন্ট্রোলরুমে নিয়ে আসে এবং বলে ‘ভাষণ রেকর্ড করা হবে, আপনারা চলেন।’ তারা ২নং বুথে গিয়ে আগের শিফটে রেডিও ইঞ্জিনিয়ার প্রণব চন্দ্র রায়, টেকনিক্যাল অপারেটর মহাম্মদ আলী এবং মেকানিক আনোয়ারকে কর্মরত দেখেন। পাশে ২নং স্টুডিওতে খন্দকার মোস্তাককে বসা দেখেন। কিছুক্ষণ পর তাহের উদ্দিন ঠাকুর ওই স্টুডিওতে আসে।

তখনও মেজর ডালিম আগের মতোই ঘোষণা দিচ্ছে, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, আর্মি ক্ষমতা দখল করেছে, কারফিউ জারি করা হয়েছে।’ এই ঘোষণা শোনার পর তাহের উদ্দিন ঠাকুর খন্দকার মোস্তাকের সঙ্গে আলাপ করে বলে- শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এই ঘোষণা দেওয়া ঠিক হবে না। তখন তাহের উদ্দিন ঠাকুর নিজ হাতে ঘোষণা লিখে দেয় ‘শেখ মুজিব এবং তার স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করে খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে এবং কারফিউ জারি করা হয়েছে।’ তার লিখিত ভাষণটি মেজর ডালিমের কণ্ঠে রেকর্ড করিয়ে প্রচার করা হয়। তখন আগের শিফটের লোকসহ তারা যৌথভাবে কাজ করতে থাকেন।

এই সময় ২নং স্টুডিওতে খন্দকার মোস্তাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মেজর ডালিম, মেজর শাহরিয়ার খন্দকার মোস্তাকের ভাষণ তৈরি করে। তাহের উদ্দিন ঠাকুর নিজ হাতে ওই ভাষণ তৈরি করে। সকাল প্রায় ৮টার দিকে ওই ভাষণটি খন্দকার মোস্তাকের কণ্ঠে রেকর্ড করিয়ে রেডিওতে প্রচার করা হয়। সকাল প্রায় ৯টার সময় তিন বাহিনী প্রধান বিডিআর প্রধান, পুলিশের আইজিকে নিয়ে কয়েকজন আর্মি অফিসার মেজর রশিদ, মেজর ডালিম ২নং স্টুডিওতে নিয়ে আসে। তিন বাহিনী প্রধান আইজিপি ও বিডিআর প্রধানের আনুগত্য ভাষণ তাহের উদ্দিন ঠাকুর নিজ হাতে লিখে। ঐ লিখিত ভাষণগুলি তাদের নিজ নিজ কণ্ঠে রেকর্ড করিয়ে পর্যায়ক্রমে প্রচার করা হয়।

কিছুক্ষণ পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, কর্ণেল তাহের, জেনারেল ওসমানী ২নং স্টুডিওতে আসে। তারপর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, খন্দকার মোস্তাকের সাথে আলাপ করতে দেখেন। ওই দিন বিকেল ৪টার সময় পরবর্তী শিফট আসার পর তারা মেজর শাহরিয়ারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যাওয়ার আগে ভাষণকৃত টেপগুলি বেলা ৩টার দিকে মেজর ডালিমকে বুঝিয়ে দেন। ৩-৪ দিন পর মেজর ডালিম এসে বলে ‘আমার ভাষণকৃত টেপটি জমা দাওনি? টেপটি তাড়াতাড়ি দাও। নাহলে তোমাকে গুলি করে মারব।’ জবাবে তিনি বলেন ‘সব টেপ আপনাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। এখন আমি কোথায় পাব আপনার টেপ?’ তখন তার শিফটের রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে জানায়, ১৫ তারিখে একটি টেপ সে কন্ট্রোল রুমে পায়, যেটা তার নিজস্ব ড্রয়ারে আছে। তখন ড্রয়ার ভেঙে টেপটি বের করে এবং বাজিয়ে দেখেন যে সেটাই মেজর ডালিমের ভাষণকৃত টেপ। সঙ্গে সঙ্গে ওই টেপটি আঞ্চলিক পরিচালক আসফাকুর রহমানের কাছে জমা দেন। অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে মেজর ডালিম মেজর শাহরিয়াসহ আরো ৪-৫ জন অফিসারকে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মৃতদেহের ছবি দেখা দেখি করতে দেখেন। সেসময় তিনিও বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের মৃতদেহের ছবি দেখেন।