মুনাফালোভী মালিকপক্ষের উদাসীনতা আর অব্যস্থাপনার বলি হয়ে সাভারের রানা প্লাজা ধসে নিহত হন সহস্রাধিক শ্রমিক। এতে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ আহত হন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল বিশ্ব বিবেককে নাড়িয়ে দেয়া এ শিল্প দুর্ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম দুর্ঘটনা।
সেদিন সকালে দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী/উদ্ধারকর্মীদের পাশাপাশি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন অনেক সংবাদকর্মী। দিনের পর দিন সেখানে অবস্থান করে খাওয়া-দাওয়া ভুলে শ্রমিকদের করুণ মৃত্যুর খবরসহ দুর্ঘটনার সার্বিক চিত্র ইন্টারনেট, টিভি পর্দা এবং পত্রিকার পাতায় প্রতি মুহুর্তে তুলে ধরেছেন।
দৈনিক প্রথম আলোর জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক গোলাম মর্তুজা এবং যমুনা টেলিভিশনে কর্মরত তখনকার সময় টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করা মনিরুল ইসলাম তাদের মধ্যে অন্যতম। সেই সময়ের দু:সহ অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানতে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে এ দুজনের কথা হয়।
তাৎক্ষনিক বিহ্বলতা, প্রকৃত তথ্য নিশ্চিতের চ্যালেঞ্জ, স্বাস্থ্যগত ও পেশাগত নানা ঝুঁকি, মানবিকতা ও পেশাদারিত্বের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি, অনভিজ্ঞতা বনাম নৈতিকতার চ্যালেঞ্জ এবং মানুষের দুর্দশায় মানুষের সবকিছু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার যে অনুপম দৃষ্টান্ত তারা ঘটনাস্থলে থেকে দেখেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের কাছে তা তুলে ধরেছেন।
প্রকৃত ঘটনা বুঝে উঠতে সময় লেগেছিল
একদিকে রানা প্লাজার ভেতর থেকে লাশের পর লাশ বের হচ্ছে অন্যদিকে স্বজনদের আহাজারি এবং উদ্ধারকর্মীদের ছুটোছুটি। দুর্ঘটনাটি যে ভয়াবহ তা বুঝতে পারলেও প্রকৃত ঘটনাটা বুঝে উঠতে সময় লেগেছিল বলে জানান গোলাম মর্তুজা।
তার বর্ণনায়, দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে আমি মোটরসাইকেলে করে সাভারে ছুটে যাই। আমার পৌঁছতে ৪৫-৫০ মিনিটের মতো সময় লাগে। সেখানে গিয়ে অনেকটা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি। মানুষের আর্তচিৎকার আর ছুটোছুটি দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
‘এরপর এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে গেলাম। গিয়ে দেখি ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সেখানে অনেকগুলো মরদেহ জমে গিয়েছে। কেউ কেউ আবার কমবেশি আহত হয়ে এসেছেন। তখন যারা অল্প আহত হয়েছিলেন তাদের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিলাম। তাদের মুখ থেকেই আসলে ধারণা পেলাম রানা প্লাজায় কী ঘটেছে বা সেখানে কত লোকজন ছিলেন।’
তথ্য নিশ্চিতে বেগ পেতে হয়েছিল
মনিরুল ইসলামের ভাষ্যমতে, ওখানে যারা কর্তব্যরত ছিলেন তারা একেকজন একেক রকম তথ্য দিচ্ছিলেন। তাছাড়া ভুল তথ্যও ছড়াচ্ছিল অনেক। তাই প্রকৃত তথ্য নিশ্চিত করতে বেগ পেতে হয়েছিল।
তিনি বলেন, প্রথমে আসলে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। এরপর ঘটনা ঘটার কিছুক্ষনের মধ্যেই যখন সেনাবাহিনী এর দায়িত্ব তুলে নিল তখন তাদের দেয়া তথ্যকে ভিত্তি ধরে প্রচার করেছি।
ঘটনার পর অনেক দিন মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলাম
দু’য়েকদিন বিরতি দিয়ে টানা ১৯দিন স্পটে থেকে ঘটনা কভার করা গোলাম মর্তুজা বলেন, ঘটনার পর দীর্ঘদিন আমি মানসিক ট্রমার মধ্যে ছিলাম। ওই ট্রমার প্রভাবে মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠতাম। আমার স্ত্রী তখন আমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করেছেন।
মরদেহের দুর্গন্ধ দুর করার জন্য রানা প্লাজা এলাকায় অনেকে ‘এয়ার ফ্রেশনার’ ব্যবহার করেছিলেন। পরবর্তীতে কোনো ‘এয়ার ফ্রেশনারের’ গন্ধ নাকে আসলে তার রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি মনে ভেসে উঠতো বলে জানান এ সাংবাদিক।
বুম ফেলে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল
মানুষের দুঃখ দুর্দশা হৃদয়ে ধারণ করলে অনেক সময় মানুষ ভুলে যায় তার পেশাগত দায়িত্ব। মানবিকতা এবং পেশাদারিত্বের এক চরম দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়তে হয় তাকে। এমন এক পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করছিলেন মনিরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, যে যেভাবে পারছে তার সামর্থ্য নিয়ে আহত মানুষ এবং তাদের স্বজনদের জন্য সাহায্য নিয়ে ছুটে যাচ্ছে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে তা সেখান থেকে সরাসরি সম্প্রচার করছিলাম বটে, কিন্তু মন চাইছিল বুম ফেলে আমিও উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে ছুটে যাই, স্বজনহারাদের সেবা করি।
‘মানুষ মানুষের জন্য’ প্রবাদের বাস্তব দৃষ্টান্ত দেখেছি
মানুষের বিপদে মানুষ যে কীভাবে এগিয়ে আসে, কীভাবে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে আর্তমানবতার সেবায় ঝাপিয়ে পড়ে তার বাস্তব দৃষ্টান্ত নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতা কথা জানান এই দুই সাংবাদিক।
গোলাম মর্তুজা বলেন, খবর পাওয়া মাত্র শুধু আশেপাশের নয়, সারাদেশের মানুষ সেদিন ছুটে আসেন সাভারে। যার যতটুকু সামর্থ ছিল তা নিয়ে এগিয়ে আসেন মানবতার সেবায়। যার দেয়ার মত কিছুই ছিল তাকেও দেখেছি কয়েক বোতল পানি কিনে মানুষের মাঝে বিতরণ করছেন।
এনাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সেবার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে এ সাংবাদিক বলেন, শিক্ষার্থীরা রাস্তার দুই পাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে গেল, যাতে অ্যাম্বুলেন্সগুলোর আসতে কোন সমস্যা না হয়। দলবেধে ট্রলি নিয়ে রোগীগের এগিয়ে আনছেন। তাকে রেখে আবার অন্যজনকে। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে এই মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান আসলে কোনদিন ভুলে যাওয়ার মতো নয়।
মনিরুল ইসলাম বলেন, মানুষের কোন বিপদে মানুষ যে কীভাবে ছুটে আসে, আত্মীয়ের জন্য আত্মীয়ের যে কি মায়া এবং টান তা এত কাছ থেকে আর কখনও দেখিনি। একটি লাশ আসছে আর মানুষেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে যে এটা তার আত্মীয়ের লাশ কি না! নিখোঁজদের তালিকা দেয়ালে দেয়ালে টাঙিয়ে খুঁজে ফিরছে স্বজনদের। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য।
সেবা ছাড়া মানুষের মনে অন্য চিন্তা ছিল না
মানুষের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোন কুচিন্তা মানুষের ছিল না সেদিন সাভারে আসা মানুষের মধ্যে। এ প্রসঙ্গে একটি ছোট ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গোলাম মর্তুজা বলেন, একদিন সকালে এনাম মেডিকেল কলেজের সামনে আমার বাইকটি রেখে তার পেছনের সিটে ল্যাপটপের ব্যাগটি রাখি। অন্যান্য কাজ করতে গিয়ে সেকথা ভুলে যাই। দুপুরে কাজ শেষ করে যখন নিউজ লিখতে যাবো, তখন ল্যাপটপের কথা মনে হলো। পরে এনাম মেডিকেলে আমার বাইকটির কাছে গিয়ে দেখি ল্যাপটপের ব্যাগ সেভাবেই পড়ে আছে।
সেবা করেছিলেন তারাও
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরাসরি সেবা করার সুযোগ ছিল না। তবুও তারা নিজের জায়গা থেকে চেষ্টা করেছেন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। গোলাম মর্তুজা ব্যাগে রাখা বিকল্প টিশার্টটি তুলে দিয়েছিলেন একজনকে। আর গাছপালাহীন অধরচন্দ্র স্কুল মাঠে প্রখর রোদের মধ্যে চ্যানেলের গাড়িতে নিজে না বসে বসতে দিয়েছিলেন দুর্গতদের স্বজনদের।
অনভিজ্ঞতা বনাম নৈতিকতা
এত বড় ঘটনা বাংলাদেশে এর আগে না ঘটায় অনভিজ্ঞতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে কিছু টেলিভিশন কাভারেজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে মনে করেন মনিরুল ইসলাম। তবে তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই মনে করেন তিনি। তার ভাষ্যমতে, নৈতিকতা বজায় রেখে রিপোর্ট করতে সাংবাদিকদের চেষ্টার কমতি ছিল না। যে কয়েকটি লাইভ রিপোর্ট এবং কভারেজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল সেগুলো অনভিজ্ঞতার কারণেই হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
গোলাম মর্তুজা বলেন, বিভৎস ছবি আমরা সাধারণত প্রকাশ করি না। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আহতরা নিজেরাই অনুরোধ করেছেন তা প্রকাশের জন্য। যেমন, পাখি নামের একটি মেয়ের দুই পা কেটে ফেলতে হয়, সাদ্দাম নামের একটি ছেলের একটি হাত। তারাই অনুরোধ করেন তা প্রকাশের জন্য যেন তাদের সহায়তা পেতে একটু সুবিধে হয়।