চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সু চি’র রাজনীতি ও বিশ্বব্যাপি মুসলিমদের ভাগ্য

মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চির ভাষণ শুনে দেখলাম অনেকেই মনে করছেন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশের চাপে সু চি তার ভাষণে এখন সুর নরম করে ফেলেছেন। আসলেই কি তাই! তিনি কি এতই কাঁচা রাজনীতিক যে তিনি জানতেন না, এত বড় একটি গণহত্যা করলে বিভিন্ন দেশ থেকে কিছু না কিছু প্রতিবাদ আসবেই! আমার তো মনে হয়, তিনি এর চেয়ে ঢের বেশি প্রতিবাদের জন্য প্রস্তুত থেকেই গণহত্যার অপকর্মটি শুরু করেছেন। কিন্তু তার প্রস্তুতি অনুযায়ী সেই পরিমাণ প্রতিবাদ হয়নি।

আর এই যে ভাষণটি তিনি দিয়েছেন, আমার তো মনে হয় অনেক আগেই গণহত্যার পরিকল্পনার পাশাপাশি ভাষণের স্ক্রিপ্ট কিংবা বিষয়বস্তুও তিনি তৈরি করেই রেখেছিলেন। গণহত্যা শেষ হবে আর সুর নরম করে একটি ভাষণ দিয়ে দেবেন। তার নরম সুরের সাথে সাথে বিশ্বের সুরও নরম হয়ে যাবে। এত বড় একটি হত্যাযজ্ঞ সাধন করে এভাবে একটি নরম সুরে ভাষণ দিয়ে যদি পার পাওয়া যায়, এরকম গণহত্যা একবার কেন, বারবার চালালেই বা সমস্যা কোথায়! তার এই ভাষণে অনেকেই দেখলাম স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। তার এই ভাষণের প্রতিশ্রুতিকে দেখলাম অনেকে বিশ্বাসও করছেন। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন, সু চি তার উদ্দেশ্যটি ইতিমধ্যেই সফল করে নিয়েছেন। তার উদ্দেশ্যই ছিল নিরীহ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে রোহিঙ্গাদের নিজেদের ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত করা। সু চি কি তার সেই উদ্দেশ্যে সফল হননি! এই যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, এদেরকে কি সু চি আদৌ আর কখনো ফেরত নেবেন? নানা টালবাহানা করে, প্রত্যাখ্যান করার একটি পথ তিনি ঠিকই বের করে নেবেন।

মিয়ানমারের মতো এমন কুখ্যাত ক্ষুদ্র একটি দেশ সারা বিশ্বের চোখে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রায় মাসব্যাপী হেলে-দুলে একেবারে স্বাচ্ছন্দ্যে হত্যাযজ্ঞটি চালিয়েছে, শুধুমাত্র লোকদেখানো কাগুজে প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছুই কি হয়েছে! এটিকে শুরুতেই প্রতিহত করার কোন পদক্ষেপ কি কেউ নিয়েছে! ইচ্ছে করলে কি পারতো না! মিয়ানমার কি এতই শক্তিশালী একটি দেশ কিংবা আনবিক বোমায় ক্ষমতাসম্পন্ন কোন পরাশক্তি! দুর্ভাগ্য যে মিয়ানমার এমন একটি ক্ষুদ্র দেশ হওয়ার পরও এই গণহত্যা প্রতিহত করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে সু চি নির্বিচারে হত্যা করলো, এর বিচারও কখনও হবে না। কারণ প্রতিহত যাদের করার কথা ছিল, বিচার যারা করবে তারা সবাই মিয়ানমারকেই সমর্থন দিয়েছে। সুতরাং মিয়ানমার কোন পরাশক্তি না হয়েও এখন অনেক শক্তিশালী, বিশ্বের সমস্ত বড় দেশগুলিই মিয়ানমারের পক্ষে।

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বর্তমানে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তা একেবারেই কৌশলগত। সাপ মরবে কিন্তু লাঠি ভাঙবে না। মুসলিমদের প্রত্যাশাও কি অদ্ভুত! আমেরিকায় ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছেন মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করার শপথ নিয়ে, আর সেই ট্রাম্পের কাছে মুসলিমরা প্রত্যাশা করেন, মিয়ানমারকে আমেরিকা প্রতিহত করবে, রোহিঙ্গাদের উদ্ধার করবে। জঙ্গিবাদে অতিষ্ট হয়ে ইউরোপ মুসলমানদের উপর প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ। মুসলিম শব্দটি ইউরোপে এখন আর একেবারেই শ্রুতিমধুর নেই, যদিও একসময় ছিল। মুসলিম শব্দটি উচ্চারণ করলেই একটি কটাক্ষ দৃষ্টি পরিষ্কার লক্ষ্য করা যায় চারিদিকে। সরকারিভাবে ইউরোপে মুসলিমদের সংকুচিত করে আনার সব প্রক্রিয়াই অব্যাহত, তা কিন্তু এখানকার মুসলমানরা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করছেন। যদিও উগ্রবাদী মুসলিমনরা বিষয়টি গায়ের জোরে অস্বীকার করেন। উগ্রবাদীরা সবসময় সবকিছু গায়ের জোরেই অস্বীকার করে যান, এটিই তাদের মূল নীতি। কিন্তু মূলত ইউরোপে মুসলমানরা মোটেই ভালো নেই।

গণতন্ত্র এবং সভ্যতার একটি ঝাণ্ডা যেহেতু ইউরোপের মাথার উপর উড়ছে, এটিকে ধরে রাখার জন্য এরা নিজেকে সংযত রাখছে। তা না হলে এদেশেও মুসলমানদের অবস্থা মিয়ানমারের মতো কিংবা কাছাকাছিই হতো। মিয়ানমারে প্রকাশ্যে দল বেঁধে সবাইকে হত্যা করছে, আর এখানে প্রকাশ্যে না হলেও, ঝোপ ঝাড়ে কিংবা রাতের অন্ধকারে কোন মুসলমানকে সুযোগমতো একা পেলে ঠিকই কিছু একটা করে দেবে। দু চারটি ঘটনা ঘটেও গেছে এবং ঘটছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নানা কারণে মুসলিমদের উপর যারা অতিষ্ট, তাদের কাছেই মুসলমানরা প্রত্যাশা করছেন মুসলমানদেরকে উদ্ধার করার। ওদিকে, মুসলিম বিশ্ব যে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে তা কিন্তু কেউ মুখে আনতে নারাজ। এতে বিষয়টি এরকম দাঁড়ায় যে, মুসলমানদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব অমুসলিম বিশ্বের আর মুসলিম বিশ্বের দায়িত্ব হলো ঘুমানোর।

রোহিঙ্গাদের পক্ষে একমাত্র ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার কিছুটা তৎপরতা দেখা গেছে। তুর্কীর রাষ্ট্রপ্রধান এরদোগান সরাসরি উগ্রপন্থী এবং মৌলবাদী আদর্শে বিশ্বাস করেন। তিনি উগ্রপন্থী-মৌলবাদী মুসলমানদের প্রশ্রয় দেন এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব করেন। বর্তমান বিশ্বে মুসলিমদের যে সমস্যা তা উগ্রপন্থী মুসলমানদের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং কোন উগ্রপন্থী-মৌলবাদী মুসলিম নেতার নেতৃত্বে মুসলিমদের সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। কারণ এই উগ্রপন্থী মুসলমানদের কারণেই বিশ্বে সাধারণ মুসলিমরা দেশে বিদেশে আজ এভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন। এই উগ্রবাদী মুসলমানদের কারণেই সারা বিশ্ব ধীরে ধীরে মুসলমানদের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমার মনে হয়, মুসলমানরা যদি এখনই গভীরভাবে বিষয়টি নিয়ে না ভাবেন, অদূর ভবিষ্যতে কিংবা দূর ভবিষ্যতে তাদের উপর আরও বিপর্যয় আসার আশঙ্কা থেকেই যাবে। এভাবে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড় তুলে মুসলমানদের বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হবে না। আর তা ছাড়া সু চি কিংবা এইসব সামরিক জান্তারা ফেসবুকে আমাদের পেজ এ ঢুকে ঢুকে আমাদের প্রতিবাদসমূহ পাঠ করে না। এইসব প্রতিবাদে তাদের কিছু আসে যায় না। দূতাবাসের সামনে, মাঠে ময়দানে খণ্ড খণ্ড মিছিলেও তাদের কিছু আসে যায় না। যারা গণহত্যা করে, তারা সবকিছু জেনে শুনে হিসাব-নিকাশ করেই করে। এইসব নিরস্ত্র আবেগি প্রতিবাদকে তারা কখনো ভ্রূক্ষেপ করে না।

ভবিষ্যতে মুসলমানদের বিপর্যয় ঠেকাতে হলে, আমি মনে করি একমাত্র পথ হলো, মুসলমানদের উপর বিশ্বের সুদৃষ্টি ফিরিয়ে আনা। যদিও কাজটি এত সহজ নয়, কারণ অন্য ধর্ম এবং জাতির সাথে মুসলমানরা এত বেশি দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে যে খুব অল্পদিনে খুব সহজে এই দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে না। তবে চাইলে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে একসময় অবশ্যই সম্ভব হবে। ইতিহাসে অনেক সমস্যাই দেখা গেছে যা সমাধানে শত বছরও লেগেছে। কিন্তু শত বছর আগে সমস্যাটি সঠিক ভাবে উপলব্ধি এবং বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে। মুসলিমদের বুঝতে হবে এবং মানতে হবে, হিন্দু খ্রিষ্টান বৌদ্ধসহ বিশ্বের অন্যান্য সব ধর্মাবলম্বীই এখন মুসলমানদের বিপক্ষে। এই যে সবাই মুসলমানদের বিপক্ষে, তা মুসলমানদের জন্য মোটেই শুভ নয়। তাছাড়া এই যে সবাই বিপক্ষে, এজন্য কি শুধু তারাই দায়ী! মুসলিমদের কি এখানে কোন দায় নেই। মুসলমানরা কি সব ফেরেশতা। মোটেই না। মুসলমানদেরও অনেক দায় আছে। তালি এক হাতে বাজে না। মুসলমানদেরও অনেক শোধরাতে হবে। বিশ্বের সাথে সমান তালে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যুগোপযোগী আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মুসলমানদের আগ্রহ একেবারেই কম। এত বড় আরব বিশ্বে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও র‍্যাংকিং-এ দশ বা বিশের মধ্যে তো নেইই, একশোর মধ্যেও নেই। মুসলিম বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং এ মালয়েশিয়ার মালয়া বিশ্ববিদ্যালয় সবার উপরে। তাও র‍্যাংকিং হলো ১১৪। টার্কি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে খুব উৎসুক, কিন্তু সেখানে সবচেয়ে উঁচুমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যংকিং হলো ৪২১। মুসলিম বিশ্বের আর এক শক্তিধর প্রতিনিধি ইরান। তাদের সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং ৪৭১। সৌদি আরবের কিং ফাহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং ইরান আর টার্কির চেয়ে একটু ভালো, ১৭৩। কিন্তু সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধি নাকি ট্রাম্পের প্রতিনিধি, প্রশ্নটি এখন অনেকের।

যাহোক, হয়তো অনেকেই বিরক্ত হবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং এর সাথে মুসলমানদের বিপর্যয়ের কি সম্পর্ক? অনেকে বিরক্ত হলেও আমার মনে হয় অনেকে একমতও হবেন যে সম্পর্ক আছে। কারণ মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্বে মুসলমানদের মর্যাদা কখনো বৃদ্ধি পাবে না। আবার এই শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ার কারণে মুসলমানদের মধ্যে সীমাহীন গোঁড়ামি এবং কুসংস্কার।

এভাবে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থেকে মুসলমানরা নিজেদের গোলপোস্টে নিজেরাই গোল করে যাচ্ছেন। নিজেদের গোলপোস্টে নিজেরা গোল করে অপরকে দোষ দিয়ে কি লাভ? নিজেদের যে কোন দোষ থাকতে পারে, একথাও মুসলমানরা মানতে নারাজ। আত্মসমালোচনা ছাড়া কোন ব্যক্তি বা কোন জাতি কখনোই উন্নতি করতে পারে না। আত্মসমালোচনার কোন বিকল্প নেই! কিন্তু এই আত্মসমালোচনার অভাবেই মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে শত শত গোষ্ঠিতে বিভক্ত হয়ে কলহ বিবাদে জড়িত হয়ে নিজেরা নিজেরাই মারামারি করছেন, নিজেদেরকে নিজেরাই মারছেন। আর সেই সুযোগে অনেকেই মুসলমানদের মধ্যে ঢুকে পড়ছে, মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ টিকিয়ে রাখছে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে যে যার দেশে ফিরে যাচ্ছে। মুসলমানদের সম্পদ দিয়ে তারা আয়েশ করছে। আর মুসলমানরা বসে বসে আঙুল চুষছেন। তাই মিয়ানমারের ঘটনাটি মুসলমানদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। সামনেও কিন্তু মুসলমানদের উপর সমূহ বিপদ আর বিপর্যয় আসার শঙ্কা রয়েছে। জঙ্গিবাদ-জিহাদ আর যুদ্ধ দিয়ে মুসলমানরা কখনো এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবে না। জঙ্গি আর উগ্রপন্থী মুসলমানদের কারণেই দেশে বিদেশে সাধারণ মুসলমানদের উপর আজ এই বিপর্যয়। এদের কারণেই বিশ্ব আজ মুসলমানদের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

ভবিষ্যতের বিপর্যয় থেকে মুসলমানরা নিজেদের রক্ষা করতে চাইলে প্রথমেই এইসব জঙ্গি এবং উগ্রপন্থী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাধারণ এবং সচেতন মুসলমানদের আরও কঠোর হতে হবে। সংগঠিত হয়ে এদের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করতে হবে নানা মাধ্যমে। অন্য জাতি এবং ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সহনশীল সহাবস্থানের চর্চা বৃদ্ধি করতে হবে। আর নিঃসন্দেহে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশি আগ্রহী হতে হবে। একমাত্র এভাবেই কয়েক দশক চর্চার পরই মুসলমানরা আবার বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হবেন। জিহাদ আর যুদ্ধ করে মুসলমানদের ভাগ্যে শুধু বিপর্যয় আর ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই মিলবে না। ইউরোপ আমেরিকায় যারা বসবাস করছেন তাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে। বিষয়গুলি নিয়ে তাদের আরও বেশি ভাবতে হবে। তা না হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে এর খেসারত দিতে হবে, এ জন্য ভুগতে হবে। আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনার ভুলের কারণে আপনার সন্তান ভুক্তভোগী হোক।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)