চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সু চি’র বক্তব্যের সমালোচনায় যা বলছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা

রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতনের ঘটনায় মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ  নেতা অং সান সু চির বক্তব্যের পরপরই বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে স্বনামধন্য কূটনীতিক, মানবাধিকার কর্মী এবং দাতা সংস্থার কর্মকর্তারা তীব্র সমালোচনা করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

গত ২৫ আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা ও নিপীড়নের পর কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র সমালোচনার পর ওই ঘটনার কয়েকদিনের মাথায় মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি।

তিনি বলেছেন, অর্ধেকের বেশি রোহিঙ্গা গ্রাম সহিংসতায় আক্রান্ত হয়নি। নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে কেন তারা এক অপরের গলা চেপে ধরেনি তা দেখতে তিনি কূটনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাপী সমালোচনায় তার দেশ ভীত নয়।

সু চি’র বক্তব্যে রোহিঙ্গাদের উপর চলমান মানবাধিকার বিবর্জিত নিপীড়নের বিষয়টি স্বীকার করলেও তিনি অনেক বিষয় এড়িয়ে গেছেন বলে মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কাদামাটিতে মাথা লুকাতে চাইছে সু চি। রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চলছে তা জাতিগত নির্মূল প্রচেষ্টা।

সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখে যেখানে কমপক্ষে চার লাখ লোক বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে, সেখানে এই সংকটে নিজের ভূমিকার কথা উড়িয়ে দিয়েছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী এই নেতা। কিন্তু এরপরও টেলিভিশন ভাষণে সু চি তা অস্বীকার করেছেন।

জাতিসংঘ এই হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যার আদর্শ দৃষ্টান্ত হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে, সু চি তার বক্তব্যে এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে সু চি বলেন, নাগরিকত্ব প্রমাণ করা গেলে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে নেয়া হবে।

অথচ রোহিঙ্গাদের অনেক আগে থেকেই দেশটির নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে এবং তার বক্তব্য অনুযায়ী বাংলাদেশে পালিয়ে আসা কোন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো প্রকৃত অর্থে সম্ভব নয়।

তার এই বক্তব্যের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং প্রশান্ত অঞ্চলে নিযুক্ত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক জেমস গোমেজ বলেছেন, রাখাইন রাজ্যের ভয়াকহতা প্রকাশ না করে সু চি আজ দেখালেন তিনি এবং তার সরকার কাদায় মুখ লুকানোর চেষ্টা করছে। তার বক্তব্য ছিল মিথ্যা এবং ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে অভিযোগে সাজানো।

তিনি আরো বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জাতিগত নির্মূলে লিপ্ত তার অনেক প্রমাণ রয়েছে। সু চি যখন বলেছিলেন রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, তখন আশা জেগেছিল। কিন্তু আইনশৃংখলা বাহিনীর ভূমিকায় তিনি এখনো নিশ্চুপ।

বিশ্বব্যাপী সমালোচনাকে মিয়ানমার উপেক্ষা করছে জানিয়ে গোমেজ আরও বলেন, চলতি বছরের শুরুতে জাতিসংঘের করে দেয়া কমিশন সমাধানের পথে তারা সহযোগিতা করবে না বলে বার বার বলে আসছে। মিয়ানমার যদি কিছু নাই লুকাবে তবে তাদের উচিত জাতিসংঘের তদন্তকারী দলকে দেশে ঢুকতে দেয়া। সরকারের উচিত দেশের সব এলাকায় মানবাধিকারকর্মীদের জরুরি ভিত্তিতে অবাধ প্রবশাধিকার দেয়া।

হিউম্যান রাইট ওয়াচের এশিয়া ডিভিশনের সহকারি পরিচালক ফিল রবার্টসন সূচির বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রশ্ন তোলেন যে ‘যদি এগুলা সত্য না হয়, তাহলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাখাইনের যেসব গ্রাম ও ঘর-বাড়িতে আগুন জ্বলতে তা কারা করছে?

মিয়ানমারে নিযুক্ত ইউনিসেফের সহকারি প্রতিনিধি পল এডওয়ার্ড বলেন, সূচির বক্তব্য যদি আমরা সত্য ধরে নেই তাহলে রাখাইনে গত ৫ সেপ্টেম্বরের পর থেকে কোন সেনা অভিযান চলেনি। কিন্তু সে আসলে কি হচ্ছে তা আমরা কিভাবে জানবো, কাউকে তো আর সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

মিয়ানমারের ঘটনায় ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের চেয়ার মারজুকি দারুসম্যান বলেন, দুইটি বিষয় উঠে এসেছে, একটি হচ্ছে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের প্রস্তুতি। যদিও এই বক্তব্যের কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে দেশটির সরকার। এই দুইটি বিষয় ইতিবাচকতার পূর্ব লক্ষণ।

তবে মিয়ানমার সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে রাশিয়া ও চীনের দূত সূচির বক্তব্যের পক্ষে কথা বলেছেন। মিয়ানমারে চীনের দূত হোংলিয়ান বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের অবস্থান খুবই স্পষ্ট। রাখাইনে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারকে সহযোগিতা করবে চীন।

মিয়ানমারে রাশিয়ান দূত নিকোলাই এ লিসটোপাদোভ বলেন, রাখাইনে গণহত্যা বা জাতিগত নিধনের কোন স্পষ্ট প্রমাণ বা তেমন কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি যার জন্য নিন্দা জানাতে হবে।