বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আটবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য এই জননেতা ছিলেন এক কথায় জনগণের নেতা। যখন সারা বাংলাদেশব্যাপী আওয়ামী লীগের জোয়ার, তখনও তিনি জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন অন্য দলের প্রতিনিধি হিসেবে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কোনো ভূঁইফোড় কিংবা আজকের বহুল প্রচলিত হাইব্রিড নেতার মতন ছিলেন না। রাজনৈতিক বিষয়ে তার তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, তীর্যক মন্তব্য, সিরিয়াস বিষয় নিয়ে মজাকরা, বিশেষ করে সংসদীয় বিতর্কের প্রসঙ্গ এলেই আমরা স্মরণ করবো এই উজ্জ্বল রাজনীতিবিদকে। বাংলাদেশের সংবিধানে অসাম্প্রদায়িক চেতনার অন্যতম রূপকার এই নেতা মৃত্যু পর্যন্ত বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল, তা অনেকটাই এখন ভূলুণ্ঠিত। এই ক্রান্তিকালে যে কয়জন মানুষ আমাদের আশারবাণী দেখিয়েছেন তিনি তাদের একজন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে মুহূর্তে তার দরকার খুব বেশি ছিল, তখন তার এই প্রস্থান দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। ১৯৪৫ সালের ৫ মে সুনামগঞ্জের আনোয়ারাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা কমিটির অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিতের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় বামপন্থী রাজনীতির মধ্য দিয়ে। স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদসহ তিনি আট বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে রাজনীতির কবি বলা যায়। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদের যে ভূমিকা, বাংলাদেশে তা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। কিন্তু এক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যেভাবে সংসদে তার উইট এন্ড হিউমার, প্রখর সূক্ষ্মবুদ্ধি সম্পন্ন বক্তব্য উপস্থাপন করতেন তা আর দেখা যাবে না। একজন জনপ্রতিনিধির যে সমস্ত গুণাবলী থাকা দরকার, সবটাই ছিল তার। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে তার মতো তুখোড় যুক্তিবাদী বাগ্মী আর দ্বিতীয় কেউ রইলো না। একজন নেতা হিসেবে তার যে মানবিক ভুলত্রুটি ছিল, তা কখনোই তার যোগ্যতাকে ছাড়িয়ে যায়নি। আমরা এখন জনপ্রতিনিধিদের যে রূপ দেখতে পাই- দেশব্যাপী আদর্শহীন হাইব্রিডদের ছড়াছড়ি, তাদের তুলনায় তিনি ছিলেন এক অনন্য উচ্চতার জনপ্রতিনিধি। প্রকৃত জনপ্রতিনিধি বলতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তক এদেশের আদর্শ হতে পারে। তার মানুষ হিসেবে সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু একজন আদর্শবান, অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুদক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে তার শূন্যস্থান পূরণ হওয়ার নয়। রাজনীতিতে যে শুদ্ধাচার, যে শিষ্ঠতা, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, আদর্শের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা থাকতে হয়, তা হাওড়ের দিরাই এলাকার জননেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রমাণ করে গেছেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেনো বেমানান হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সাম্প্রদায়িকতার নীরব উত্থান ঘটে চলেছে, তার বিপরীতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সর্বদা সরব ছিলেন। জাতীয় সংসদে তারই আরেক সহকর্মী আমির হোসেন আমুর বক্তৃতায় আমরা প্রমাণ পেয়েছি তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার। রাজনীতির মূলধারায় এই রকম সোচ্চার নেতার অভাব বোধ করবো আরো বহুদিন। দিরাইয়ের শোকাহত জনগণের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে বলতে চাই তিনি কেবল কোনো এলাকার নেতা ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের একজন জাতীয় নেতা। তার আদর্শে আস্থা রেখে তার অসম্পন্ন কাজ সমাপ্ত করার জন্য তারা যেনো ঐক্যব্দ্ধ থাকে তারই মতন অবিচল। তার বিদেহী আত্মার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।