চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সুপ্রিম কোর্ট থেকে ভাস্কর্য সরানোর দাবির আসল কারণ

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত ভাস্কর্যকে ‘গ্রিক দেবীর মূর্তি’ হিসেবে উল্লেখ করে তা অপসারণের দাবিতে প্রধান বিচারপতি বরাবর স্মারকলিপি, বিক্ষোভ মিছিলসহ কির্মসূচি পালন করছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে নিশ্চুপ। এ সুযোগে চরমোনাইয়ের পীরের দল এবং হেফাজতসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করেছে।

গত ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিসের’ ভাস্কর্য নির্মাণের পর থেকে ধর্মের নামে এ সংগঠনগুলো অপপ্রচার চালিয়ে এলেও সরকার কিংবা বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। সরকারের ব্যবস্থাতো দূরের কথা, বরং আওয়ামী ওলামা লীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাছানও ন্যায় বিচারের প্রতীক ভাস্কর্যকে গ্রীক দেবীর মূর্তি আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তা অপসারণের দাবি জানিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর ওলামা লীগের লিখিত আবেদনে বলা হয়: সুপ্রিম কোর্টের পার্শ্বে জাতীয় ঈদগাহ্ ময়দান। সালাতে সালাম ফেরানোর সময় চোখে পড়ে গ্রীক দেবীর মূর্তি। মুসলমানগণ একত্ববাদে বিশ্বাস করেন। মূর্তি একত্ববাদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান হওয়ায় এটা কিছুতেই মানতে পারছেন না তারা। এছাড়া ১৯৪৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হওয়ার ৬৮ বছর পর হঠাৎ করে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িপাল্লার জায়গায় গ্রীক দেবীর মূর্তি স্থাপন করে কী ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে সেটা জনগণের কাছে বোধগম্য নয়।

দাঁড়িপাল্লা যখন যখন যুগের পর যুগ দেশবিরোধী জামায়াতের নির্বাচনী প্রতীক ছিলো, এই দাঁড়িপাল্লাকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের কাছে জামায়াত যখন নিজেদেরকে ইনসাফভিত্তিক সংগঠন হিসেবে পরিচয় দিতো তখন কোথায় ছিল এই ওলামা লীগ? তাহলে কী আমরা ধরে নেব শিক্ষা ব্যবস্থা হেফাজতিকরণের পর ওলামা লীগের এই দাবি আওয়ামী লীগেরও নীতি ও আদর্শে পরিণত হচ্ছে? এটা যদি তাদের নীতি-আদর্শের বিরোধী হয়ে থাকে তবে ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজতি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক নির্জলা মিথ্যার পরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না কেন?

এ ভাস্কর্য যে কোনভাবেই বাংলাদেশের কারো পূজনীয় মূর্তি নয়, এটা ওলামা লীগ ও অন্যরাও ভালোভাবেই জানে। হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীও বলেছেন, ‘আমরা ভাস্কর্য এবং কোন সংস্কৃতির বিরোধী নই। বাংলাদেশের ঐতিহ্য বা ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে মিল রেখে ভাস্কর্যটি করা হলে আপত্তি ছিল না।’ তার মানে তারাও মানছেন, কোন ভাস্কর্য কখনোই ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে প্রতিমা জ্ঞানে পূজা বা সেজদা করা হয়। তাইতো যে ইরানে ইসলামী হুকুমত ও শরিয়া আদালত বিদ্যমান রয়েছে সেখানেও উচ্চতর আদালতের দেয়ালে ন্যায়বিচারের প্রতীক এই ‘জাস্টিসিয়া’ ভাস্কর্য খোদাই করা রয়েছে। এছাড়া সৌদি আরব, মিশর, তুরষ্ক, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়াসহ বহু মুসলমানপ্রধান দেশে নগরের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ভাস্কর্য রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্যকেও পূজা করতে বলা হয়নি। তাহলে এটা নিয়ে আন্দোলন কিংবা হুমকি-ধমকি দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। তবে এর রাজনৈতিক কারণ আছে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল এবং সরকার উৎখাতের জন্য জামায়াত-বিএনপির সহযোগিতায় হেফাজতিরা রাজধানীতে নজিরবিহীন তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সেখানে সফল হয়নি। হেফাজতিরা তাই জামায়াতের ইন্ধনে সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য অপসারণের নামে সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। কারণ দেশের সর্বোচ্চ আদালত ’৭১-এর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে, যার কয়েকটি কার্যকরও হয়েছে। তাই উচ্চ আদালতের প্রতি তাদের ক্ষোভ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আদালতের উপর অবশ্য তারা আগে থেকেই ক্ষিপ্ত। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের বিভিন্ন আদালতে সিরিজ বোমা হামলা এবং পরবর্তী সময়ে বিচারকদের ওপর হামলা ও খুনের ঘটনায় এসব বিষয় আমরা দেখেছি।

এছাড়া জামায়াতের নির্বাচনী প্রতীক যেহেতু এই সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করেছিলেন, তাই সুপ্রিম কোর্টে ন্যায় বিচারের প্রতীকের ওপর তাদের ক্ষোভ থাকাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। সাধারণ মানুষকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বকধার্মিকতার আশ্রয় নিয়ে তারা এখন এই ‘জাস্টিসিয়া’র বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। তাই সর্বোচ্চ আদালত এবং সরকারের অবিলম্বে ধর্মের নামে আদালত ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি হুমকি প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।

রোমানদের কাছে এটি ন্যায় বিচারের প্রতীক। রোমান আইন থেকেই যেহেতু আমাদের বিচার ব্যবস্থার উৎপত্তি, সে অনুযায়ী যেহেতু এখনো আমাদের বিচার ব্যবস্থা চলছে, তাই অন্যান্য দেশের মতো এখানে এ ভাস্কর্য থাকাটা অপ্রাসঙ্গিক নয়। এ ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য হলো- এর চোখ বাঁধা রয়েছে। এর অর্থ হলো- একজন বিচারক পক্ষপাতিত্ব করবেন না, তার কাছে সবাই সমান। ভাস্কর্যের বাম হাতে দাঁড়িপাল্লার অর্থ- একজন বিচারক সবার মাঝে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন। ডান হাতে তলোয়ারের অর্থ হলো- অন্যায়কারীকে একজন বিচারক দণ্ড প্রদান করবেন।

কিন্তু, অন্যান্য দেশে স্থাপিত ভাস্কর্যের সঙ্গে আমাদের দেশের ভাস্কর্যের পার্থক্য রয়েছে। অন্যান্য দেশে ভাস্কর্যের গায়ে স্কার্ফ পরা থাকলেও এখানে হেফাজতিদের ভয়ে শাড়ি পরানো হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য দেশে পায়ের নিচে সাপ থাকলেও এখানে এটি বাদ দেয়া হয়েছে। এর ফলেই তারা আজ ভাস্কর্য সরানোর দাবি করার দু:সাহস দেখাতে পারছে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)