নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার জনপ্রিয় চরিত্র মিসির আলী সিরিজের ‘মিসির আলীর চশমা’-নামের বইটি উৎসর্গ করেছিলেন একজন তরুণ ও মেধাবী নাট্য নির্মাতাকে। এমনি এমনি নয়, তার কাজ দেখে পছন্দ করার পরেই তিনি তাকে বইটি উৎসর্গ করেন। যে তরুণ নাট্য নির্মাতাকে তিনি বইটি উৎসর্গ করেছিলেন, তিনি এখন জিরো ডিগ্রী ও ভয়ংকর সুন্দর নামে দুটি সিনেমা নির্মাণ করে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত। তার নাম অনিমেষ আইচ। তৃতীয় সিনেমা নির্মাণের জন্য যিনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন।নতুন ছবি শুরুর আগে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে বেশকিছু বিষয় নিয়ে কথা বলেন নির্মাতা:
সবাইতো নির্মাতা অনিমেষকেই বেশি চেনেন। আজকে অভিনেতা অনিমেষ আইচকে নিয়ে একটু বলি, এরকম বলতে বলতে প্রথমেই নির্মাতা অনিমেষের কাছে প্রশ্ন, অভিনেতা অনিমেষ আইচকে কীভাবে দেখেন নির্মাতা অনিমেষ আইচ?
আমিতো অভিনেতা না। নিজেকে অভিনেতা বলে ভাবিওনি কখনো। দুয়েকবার কিউরিসিটি থেকে করেছি। অনেক কাছের মানুষের অনুরোধের জন্য করছি। এছাড়া আরেকটি কারণ ছিলো, অভিনেতার পেইনটা বোঝার জন্য একটু আগ্রহী হয়ে দুয়েকটা কাজ করেছি। কিন্তু আমি অভিনয়টা একদম উপভোগ করি না। ভাবতেও চাই না বিষয়টা।
‘তারপরও আঙুরলতা নন্দকে ভালবাসে’-নাটকে এতো ন্যাচারাল অভিনয় যেকোনো প্রফেশনাল অভিনেতার মধ্যে পাইনি। এটা বললে কি আমাদের অভিনেতাদের খাটো করা হবে? কিংবা আপনার ‘ফেরার কোনো দেশ নেই, ছিলো কোনো কালে’র কথা যদি বলি…
এটা পুরোপুরি ডিরেক্টরের কৃতিত্ব। আর আমি নিজে যেহেতু ডিরেক্টর, ফলে অভিনয় একসেন্টটা আমি বুঝি। তারপরেও অভিনয়ে আমার কোনোই আগ্রহ নেই। সামনেও কাজ করার আগ্রহ নেই। অনেকেই বলে, প্রস্তাব দেয় অভিনয় করতে কিন্তু আর অভিনয়ে নেই।
তারপরও কাছের কেউ যদি অনুরোধ করেন?
এটাইতো বললাম, অনুরোধের ঢেঁকি ঘিলেইতো কয়েকটা নাটকে অভিনয় করেছি। ও, সম্প্রতি হুমায়ূন আহমেদের গল্প অবলম্বনে মুক্তি প্রতীক্ষিত ‘দেবী’ সিনেমায় কাজ করেছি। জয়া আহসান আমার খুব খুব কাছের বন্ধু। তার অনুরোধ ফেলতে পারিনি। সে এমন করে ধরেছে যে, দেবীতে আমাকে অভিনয় করতেই হবে। জয়ার অনুরোধে এই সিনেমায় অভিনয় করলাম। মোটামুটি বেশ বড় চরিত্রেই।
নির্মাতা নয়, একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে গেল বছরের বাংলা ছবিগুলো নিয়ে আপনার অবজার্ভেশনটা জানতে চাই?
আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলা ছবির ক্ষেত্রে বিরাট পট পরিবর্তন হয়েছে। ভালো ছবির প্রবনতা বাড়ছে দিন দিন। ভালো ছবি মানে মৌলিক গল্পের ছবি। এক্সপেরিমেন্টাল ছবি হচ্ছে। এগুলোতো খুব ইতিবাচক ব্যাপার আমাদের জন্য। এক দিনেতো আর সব পাল্টাবে না, কিন্তু এভাবে মৌলিক গল্পের চর্চা সিনেমায় অ্যাপ্লাই হতে থাকলে আগামি পাঁচ বছরের মধ্যে সিনেমায় এক ধরনের পরিবর্তন নিশ্চয় আসবে।
কিন্তু ব্যবসায়িকভাবে সিনেমাশিল্প কতোটা দাঁড়াতে পারবে বলে মনে করেন?
আমাদের এখানে সিনেমা বিক্রির যে জায়গাটা এটা স্বচ্ছ নয়। যে ঘরানার সিনেমায় বলেন না কেন, সিনেমা বিক্রি নিয়ে বা সিনেমার ব্যবসা নিয়ে কেউ কিন্তু ভালো অবস্থায় নেই। বিক্রি করতে গেলেই সমস্যা। যে প্রডিডউসারের টাকায় সিনেমা বানাবেন, তাকে অন্তত পরবর্তীতে আরেকটি সিনেমা বানাতে উৎসাহিত করার পরিস্থিতি আমাদের এখনো তৈরি হয়নি। প্রডিউসারকে সিনেমায় ইনভেস্ট করতে উৎসাহিত করা যায় না আমাদের এখানে। সিনেমা বিক্রি করতে গেলেই দেখা মিলবে প্রচুর কারচুপির। বিশেষ করে হলগুলোতে। সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার ছাড়া স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নেই।
হলে সিনেমা বিক্রির এই অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার কথা সবাইকে বলতে শুনি, কিন্তু সম্বলিত আওয়াজ ক্রিয়েট করছেন না কেন আপনারা?
এরকম আওয়াজ অনেক ক্রিয়েট হইসে। কিন্তু পরে দেখা গেছে আমরা নিজেরাই ঠিক নাই। আল্টেমেটলি দিন শেষে সবাই লুজার। যাদের প্রজেক্টর তাদেরকে সিনেমা চালোনার জন্য টাকা দিতে হয়, হল মালিক, ডিস্ট্রিবিউটর, ব্যানার, পোস্টার বাবদ টাকা নেয়ার লোকজন প্রচুর। এদিকে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া না থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেকোনো হল থেকে আয় হওয়ার পরিবর্তে উল্টো তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। টিকেট ব্যবস্থা ডিজিটালাইজ না করলে এমনটা চলতেই থাকবে।
ব্যবসায়িক লাভ ক্ষতি দিয়ে একটা সিনেমার মান দণ্ড বিচার কতোটা যৌক্তিক?
ছবি ব্যবসা করলে প্রডিউসার আরেকটা সিনেমায় ইনভেস্ট করার সাহস পায়। এই দিক দিয়েতো ব্যবসায়িক লাভ ক্ষতির বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সিস্টেমে সমস্যা থাকার কারণে সেটারও সুযোগ ঘটছে না।
‘জিরো ডিগ্রি’ ও ‘ভয়ংকর সুন্দর’-এর মধ্যে যদি তুলনামূলক আলোচনায় যাই, তাহলে কোন ছবিটি আসলে ব্যবসায়িক সফল?
জিরো ডিগ্রি অনেক ব্যবসায়িক সফল একটি ছবি। লগ্নির প্রায় সব টাকায় তুলে এনেছিলো।
‘ভয়ংকর সুন্দর’ তাহলে পুরোপুরি ফ্লপ একটা সিনেমা?
হ্যাঁ, ‘ভয়ংকর সুন্দর’ ব্যবসায়িকভাবে ফ্লপ একটি সিনেমা। অনেক টাকা লস হয়েছে। যে টাকা আমরা পেয়েছি তা লগ্নি করা অর্থের ধারে কাছেও যেতে পারেনি।
আপনার দুই সিনেমাতেই ‘সাইকো-থ্রিল’ ব্যাপারটা ভীষণভাবে আছে…
আসলে একেক নির্মাতার একেরকম সাইন থাকে। হয়তো আমার সাইন এটাই। আমি যেরকম বলতেই চাই না কেন, এমনটা চলে আসে।
আপনার তিন নম্বর ছবিটার গল্পেও কি এমন কিছু থাকবে?
হয়তো বা না। আমি অন্য ধাঁচের একটা গল্প নিয়ে চিন্তা করছি এবার। আপাতত কিছু বলতে চাইছি না। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, খুব চুপচাপে ছবি বানাবো। রিলিজের আগে সবাইকে জানাবো।
বছরের শুরুতেই নতুন ছবি নির্মাণের ইঙ্গিত দিলেন। নতুন ছবির কতোদূর?
পরিকল্পনা করছি। এ বছরেই শুটিংয়ে যাবো এটা নিশ্চিত। তবে গত দুটো ছবি থেকে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, নির্মাণ করে যা বুঝেছি, সিনেমা নিয়ে আগে থেকেই ঢাকঢোল পিটিয়ে কোনো লাভ নেই। শেষ পর্যন্ত দর্শক তার বিচারেই হলে যায়। যদিও মানুষের হলে গিয়ে সিনেমা দেখার প্রবণতা এখন নাই-ই বলতে গেলে। তারপরও সিনেমা যদি ভালো হয়, মানুষই মানুষকে টেনে নিয়ে যায়। আপনি যদি ঢাকা অ্যাটাক বা আয়নাবাজির দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন আমার কথা কতোটা সত্য।
ছবি যদি কিছু হয়, তাহলে মানুষ এমনিতেই হলে এসে ছবি দেখবে। না হলে এতো প্রচার, প্রচারণা, টিভি, পত্রিকা, খবর মানুষকে খুব একটা প্রভাবিত করে না। তারা ইউটিউবেই নাটক ছবি সব দেখতে চায়।