রাজধানী ঢাকায় আদৌ কোনো গণপরিবহন ব্যবস্থা আছে কি না বা থাকলেও সেখানে কী রকম গণনৈরাজ্য চলে, তা ভূক্তভোগীরা প্রতিদিন টের পান। পকেটে পয়সা থাকলেও আপনি সময়মতো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে যাওয়ার মতো আরামদায়ক ও নির্ঝঞ্ঝাট বাহন পাবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার বাহন থাকলেও তার ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের অসন্তোষের শেষ নেই।
তবে এতসব নেই-এর ভেতরে কিছুটা আশার আলো জ্বেলেছিল ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়ায় চালানোর পদ্ধতি ‘উবার’ এবং মোটর সাইকেল সার্ভিস ‘পাঠাও’। কিন্তু নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ যে সিএনজি অটোরিকশার বিরুদ্ধে, তারাই এবার এই পাঠাও উবার বন্ধের দাবি জানিয়ে ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছে। এই ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব প্রতিক্রিয়া আসছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। অনেকে এরকম কথাও লিখেছেন যে, অটোরিকশার ধর্মঘট চলুক। অর্থাৎ মানুষের ক্ষোভ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সিএনজি অটোরিকশার সার্ভিস এই শহরে বন্ধ হয়ে গেলেও সম্ভবত কারো মন খারাপ হবে না।
যার বাসা রাজধানীর মিরপুরে কিন্তু অফিস মতিঝিল বা কারওয়ানবাজারে এবং যদি তার ব্যক্তিগত বাহন না থাকে, তাহলে তিনি জানেন প্রতিদিন এই যাওয়া-আসায় সকাল-সন্ধ্যা তাকে কী ভীষণ লড়াই করতে হয়। মিরপুর ১২ নম্বর থেকে সকালে পর্যাপ্ত বাস মিললেও বিকেলে বা সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে মতিঝিল, শাহবাগ, কারওয়ানবাজার ও ফার্মগেট এলাকায় মানুষের এক করুণ যুদ্ধের দৃশ্য মঞ্চায়িত হয়। ফলে আমরা যারা পায়ে হেঁটে বাসা-অফিস যাতায়াত করি, তারা নিজেদেরকে এই শহরের অল্পকিছু সৌভাগ্যবান মানুষের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করতে পারি।
ঢাকা শহরের রাস্তার মূল সমস্যা জ্যাম, এটি যেমন ঠিক, তেমনি সব রুটে পর্যাপ্ত বাস না থাকাও একটা বড় সংকট। কেবল মিরপুর রুটেই পর্যাপ্ত বাহন রয়েছে। কিন্তু কেউ যদি ফার্মগেট এলাকা থেকে গুলশান-বারিধারা বা ঢাকার পূর্ব প্রান্তে যেতে চান, তার ভরসা ৬ নম্বর লোকাল বাস এবং তাও পর্যাপ্ত নয়। ফলে কিছুটা স্বচ্ছল মানুষ আশ্রয় নেন সিএনজি অটোরিকশার। কিন্তু দেড়শো টাকার ভাড়া চালকরা আড়াইশো টাকা চেয়ে বসে থাকবেন এবং অসহায় যাত্রীরা তাতেই রাজি হয়ে উঠবেন। যদিও তাদের মিটারে যাওয়ার কথা। সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বহুবার হম্বিতম্বি দিয়েছেন যে, মিটারে না গেলে কঠোর ব্যবস্থা; কিন্তু সেই কঠোর ব্যবস্থার রূপটি আসলে কেমন, তা এই মহানগরীর মানুষের কখনো চোখে পড়েনি।
এরকম বাস্তবতায় যখন মোবাইল ফোনের অ্যাপভিত্তিক পরিবহন সেবা উবার ও পাঠাও এলো, তখন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন সিএনজি অটোরিকশার নৈরাজ্যে অতীষ্ঠ নাগরিকরা। সিএনজি অটোরিকশায় যে পথে যেতে তাকে গুণতে হত দুইশো টাকা, সেখানে এখন একজন যাত্রী ভাড়ায় চালিত মোটর সাইকেল বা পাঠাও সেবা নিয়ে যেতে পারছেন অর্ধেক টাকায়। আবার এসিওয়ালা সুন্দর প্রাইভেট কারে একসঙ্গে চারজন চলে যাচ্ছেন যে ভাড়ায়, তাও সিএনজি অটোরিকশার চেয়ে বেশি নয়। তাহলে মানুষ কেন আর অটোরিকশার নৈরাজ্যের কাছে মাথানত করবে?
যখন দেখা গেলো যে, সত্যিই তারা আর মাথানত করছে না, তখন সম্বিৎ ফিরে আসে সিএনজি অটোরিকশার। যাত্রী কমে যাওয়ায় এখন তারা উবার ও পাঠাও বন্ধের দাবিতে ধর্মঘটেরও ঘোষণা দিয়েছে। তবে চালকরা জানেন, এই হুমকি-ধমকিতে লাভ নেই। ফলে তারাও এখন চাইছেন, উবার ও পাঠাও-এর মতো অ্যাপের আওতায় আসতে। এজন্য আইন ও নীতিমালা প্রণয়নেরও দাবি জানিয়েছেন তারা। যদিও চালকদের এমন দাবিতে রাজি নয় অটোরিকশা মালিক এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তাছাড়া অ্যাপ পরিচালনায় চালক ও যাত্রীদের অনভিজ্ঞতা, পরিবহনে মোটরসাইকেলভিত্তিক সার্ভিসগুলোর চেয়ে সময় ও খরচ বেশি হওয়াসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথাও বলছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমান পরিস্থিতিতে আদৌ অ্যাপের মাধ্যমে সিএনজি অটোরিকশা সেবা চালু করা সম্ভব কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
তবে রাজধানীতে সিএনজি অটোরিকশার নৈরাজ্যের পেছনে প্রধানত দায়ী এর মালিক এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আইন অনুযায়ী একজন চালকের দৈনিক নয়শত টাকা জমা দেয়ার কথা। কিন্তু মালিকরা নিচ্ছেন দুই হাজার একশো টাকা। ফলে চালকরা মিটারে যেতে চান না। যাত্রীদের সাথে দরকষাকষি করে বাড়তি অর্থ নেন।
আবার মালিকদের দাবি, একটা অটোরিকশার যা দাম, নানা জায়গায় ঘুষ দিয়ে, লাইসেন্স করাতে কয়েক গুণ বেশি খরচ হয়। ফলে তারাও চালকদের কাছ থেকে বেশি টাকা নিয়ে খরচ ওঠানোর চেষ্টা করেন। অর্থাৎ সিএনজি অটোরিকশা যদি ন্যায্যমূল্যে আনা যেত এবং এর লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাজে পদে পদে ঘুষ দিতে না হত, তাহলে যাত্রীরা অনেক কম ভাড়ায়ই এই বাহনে চড়তে পারতেন। অর্থাৎ পরিবহন খাতের দুর্নীতি যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়ে গেছে, ফলে এখান থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি পাওয়া কঠিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)