রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার একটি প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এর রেশ না কাটতেই উত্তরের আরেক জেলা নীলফামারী সদর উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মডেল টেস্টের একটি প্রশ্ন নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
২৫ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন ছিল: পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম কী? (ক) পবিত্র কুরআন শরীফ (খ) পবিত্র বাইবেল (গ) পবিত্র ইঞ্জিল (ঘ) গীতা।
এরপর নীলফামারী সদর উপজেলার পঞ্চম শ্রেণির মডেল টেস্টে ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়ে একটি প্রশ্ন ছিল: তোমার পাড়ার একজন লোক মারা গিয়েছে। তোমরা তাকে অবশ্যই সবাই মিলে তাকে কবরে দাফন করলে। সে কোথায় যাবে? (ক) জাহান্নাম, (খ) দোযখ, (গ) নরক, (ঘ) বৃন্দাবন।
ধর্মীয় বিষয়ের প্রশ্নে বেহেশত, দোজখ বা স্বর্গ নরকের প্রসঙ্গ আসা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু চারুকলা অনুষদে ভর্তি পরীক্ষায় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থের নাম কোনটি জানতে চেয়ে সেখানে কোরান, বাইবেল, ইঞ্জিল বা গীতার নাম উল্লেখের উদ্দেশ্য কী? যিনি মুসলমান তিনি হয়তো লিখবেন কোরান, যিনি হিন্দু তিনি লিখবেন গীতা, খ্রিস্টান হলে তিনি কী লিখবেন, বাইবেল না ইঞ্জিল? বৌদ্ধ ধর্মের কোনো পরীক্ষার্থী এই প্রশ্নের কী জবাব দেবেন? সবাই যেহেতু নিজের ধর্মগন্থকেই শ্রেষ্ঠ মনে করবেন, সেক্ষেত্রে শিক্ষক কোন উত্তরটিকে সঠিক বলে নম্বর দেবেন? ওই শিক্ষক যে ধর্মের অনুসারী, তিনি কি তার বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে গেলে তাকে নম্বর দেবেন আর বাকিদের শূন্য দেবেন?
তিনটি ধর্মগ্রন্থের নামের আগে ‘পবিত্র’ শব্দটি লেখা হয়েছে। কিন্তু গীতার আগে পবিত্র লেখা হয়নি। তাহলে কি প্রশ্নকর্তা মনে করেন যে, গীতা পবিত্র নয়? এটা কি তিনি সজ্ঞানে লিখেছেন?
যিনি এই প্রশ্ন করেছেন, ধরে নেয়াই সঙ্গত যে, তিনি চারুকলারই শিক্ষক। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া হয় যে, চারুকলার শিক্ষকরা অগ্রসর চিন্তার মানুষ। কিন্তু এরকম উদ্ভট প্রশ্ন যার মাথা থেকে এলো, তিনি কী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেন? যে কমিটি এই প্রশ্ন অনুমোদন দিলো, তাদের প্রত্যেককে কি জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত নয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কি এর দায় এড়াতে পারেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম একটি সাম্প্রদায়িক এবং উদ্ভট প্রশ্ন করা হলো, সেখানে ভর্তি হয়ে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে? যিনি এই প্রশ্ন করেছেন, তিনি আসলে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের কী শেখান?
তৃতীয়ত, যে প্রশ্নটি করা হয়েছে, কোনো শিক্ষার্থী যদি মনে করেন যে, তিনি এই চারটির মধ্যে একটিকেও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ মনে করেন না, তাহলে তিনি কী উত্তর দেবেন? এখানে চারটির বাইরে আর তো উত্তর দেয়ার অপশন নেই। তাহলে তিনি কি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শূন্য রাখবেন? তাহলে তার যে নম্বর কাটা যাবে, তার দায় কে নেবে? আশার কথা, এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হলে বিষয়টি তদন্তে উপউপাচার্যকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।
একই কথা পঞ্চম শ্রেণির মডেল টেস্টের প্রশ্ন নিয়ে। এই প্রশ্নটি ইসলাম ধর্মের অনুসারী শিশুদের জন্য এটা ঠিক। কিন্তু তারপরও একজন পরীক্ষার্থী এরকম ফালতু প্রশ্নের কী জবাব দেবে? ইসলাম ধর্মমতে কারো মৃত্যুর পরে দাফন করতে হয়। কিন্তু মৃত্যুর পরে সে কোথায় যাবে––জাহান্নামে, দোযখ, নরক না বৃন্দাবন তা কী করে একজন শিশু জবাব দেবে? সে কি জানে মৃত ব্যক্তিটি পুণ্যবান ছিলেন নাকি পাপী? এখানে বেহেশতের তো অপশন রাখা হয়নি। জানতে চাওয়া হয়েছে, জাহান্নাম ও দোযখ। জাহান্নাম ও দোযখ দুটি একই অর্থ। তাহলে কি প্রশ্নকর্তা ধরেই নিয়েছেন যে, মৃত্যুর পরে সবাই দোজখেই যাবে? আর ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের জন্যই যদি এই প্রশ্ন করা হয়, তাহলে সেখানে নরক ও বৃন্দাবনের প্রসঙ্গ তিনি কেন টানলেন? এরক প্রশ্ন করা তো ইসলাম ধর্মমতে গর্হিত অপরাধ। কেননা, কারোর পক্ষেই এটা বলা সম্ভব নয় যে মৃত ব্যক্তি কোথায় যাবেন?
যিনি এই প্রশ্ন করেছেন, তিনি অবশ্যই একজন শিক্ষক। এরকম মূর্খ একজন লোক কী করে শিক্ষক হলেন? তিনি সারা জীবন কী শিখেছেন? কারা এই প্রশ্ন অনুমোদন দিলো? তারা কি কোনো জবাবদিহিতার মধ্যে আসবে?
ধর্মীয় শিক্ষা থাকবে কি থাকবে না, কোন শ্রেণি থেকে এটা থাকবে, এটা বাধ্যতামূলক নাকি ঐচ্ছিক হওয়া উচিত এসব অন্য তর্ক। কিন্তু শিক্ষার নামে যে ধরনের সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হচ্ছে, তা খুবই ভয়াবহ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং নীলফামারীর এই ঘটনাগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন’ ভেবে আমরা নিরব থাকতেই পারি। কিন্তু মনে হয় না এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা। ভেতরে ভেতরে আমাদের মধ্যে যে একটা সাম্প্রদায়িক চরিত্র প্রবল হচ্ছে, এই প্রশ্ন দুটি তারই প্রতিফলন কি না, তা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে বহুবিধ আলোচনা আছে। বিতর্ক আছে। খোদ শিক্ষামন্ত্রী সংসদে বলেছেন, আমাদের দেশে অন্তত ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু শিশুশিক্ষায় এরকম নৈরাজ্য পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে কি না আমরা জানি না। জিপিএ ফাইভের নামে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার যে বারোটা বাজানো হয়েছে, তা বোধ করি এখন কেউই অস্বীকার করবেন না। তার উপরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্লেজারিজম বা লেখা চুরির মতো ঘটনা তো আছেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও বিতর্ক কম নেই। সব মিলিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একটা অগস্ত্যযাত্রার দিকে যাচ্ছে কি না, তা ভেবে আপাতত শঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কীই বা করার আছে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)