চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সাংবাদিক নির্যাতন: শাস্তি পুলিশের উচ্চপদস্থদেরও হওয়া উচিত

সুন্দরবন রক্ষা ও রামপালের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প বাতিল অথবা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে আন্দোলনরতদের হরতালে পুলিশ হামলা চালিয়েছে, আহত হয়েছেন অনেকেই। এ হামলায় নারী, প্রবীণ নাগরিক, সাংবাদিকদের কেউ রেহাই পান নি। বৃহস্পতিবার ঢাকায় অর্ধদিবস হরতালে এমন ঘটনা ঘটে। ওই দিন তেল-গ্যাস বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকে কেবল রাজধানীতে হরতাল পালিত হয়।

জাতীয় কমিটি নামে যে কমিটি রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাতিল অথবা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করছে তার নেতৃত্বে আছেন বামপন্থীরা। তবু এ দাবি দেশের অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে নিজস্ব বিবেচনায়। এ দাবিতে আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী-সমর্থকেরও সমর্থন আছে সেটা বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া, পত্র-পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক থেকেই টের পাওয়া যায়। ফলে এ আন্দোলনকে বামদের আন্দোলন বলে মনে করাটা সমীচীন হবে না। আন্দোলনের নেতৃত্বে ও মাঠে বামপন্থীরা কাজ করছে বলে সাধারণ চোখে একে বামদের আন্দোলন বলে অনেকেই মনে করতে পারেন, কিন্তু সমর্থনের দিক থেকে এ দাবি কোনোভাবেই বামদের একার নয়; দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির।

বৃহস্পতিবারের ওই হরতালে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। লাঠিপেটা করেছে, কাঁদুনে গ্যাস ও গরম পানি ছুঁড়েছে, এমনকি শারীরিকভাবে নির্যাতনও করেছে। পুলিশ কেন এ বিষয়ে হঠাৎ করে অতি-উৎসাহী হয়ে পড়ল সেটার ভেবে দেখার দরকার আছে। এবং পুলিশের এ ভূমিকার কারণে সাদামাটা এক হরতাল বিশাল এক ইস্যু হয়ে পড়েছে। পুলিশ যদি এভাবে হামলা না চালাত তাহলে এটা মিডিয়ায়ও লিড হতো না, সরকারও পড়ত না সমালোচনার মুখে। তাছাড়া প্রতিবাদ ও দাবি আদায়ের যেকোনো কর্মসূচিতে সরকারি কোনো বাহিনীর এমন ভূমিকা থাকাও উচিত নয়।

পুলিশকে যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি হিসেবে বিবেচনা করা হয় তবে তাদের কাজ প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কোনোভাবেই সেটা নিপীড়ন নয়। নিরাপত্তা ও নিপীড়ন যেখানে পরস্পরবিরোধী সেখানে কেন তারা স্বীয় ভূমিকার বিপরীত কাজ করবে? এমন ত ছিল না যে হরতাল আহ্বানকারীরা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবু পুলিশ নির্বিচারে হামলা চালিয়েছে। আন্দোলনকারীদের মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে প্রথমে যে ভূমিকা নিয়েছিল তারা, পরবর্তীতে একপর্যায়ে সেটা নিপীড়নে গিয়ে ঠেকে।

ওই হরতালে পুলিশ একজন প্রবীণ নাগরিককে মাটিতে ফেলে টানাহ্যাঁচড়া করে নির্যাতন চালিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ছবি ভাইরাল হয়েছে, আর এতে সকল দায় গিয়ে পড়েছে চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারের ওপর। কারণ এটা বেশিরভাগই মনে করে যে সরকারের সিদ্ধান্ত ছাড়া এধরনের কিছু হতে পারে না। কিন্তু এমন পর্যায় নিয়ে যাওয়ার কি সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল? আমার অন্তত তা মনে হয় না। হরতাল ভণ্ডুল করে দেওয়া পর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্ত হলেও নির্যাতন পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া কেউ অন্তত চাইবে না। এমনকি এ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত এটা চাইবে না বলে মনে হয়। তবু তাই ঘটল।

এদিকে পুলিশ হরতালের সমর্থকদের পিটিয়েই থেমে থাকে নি, পুলিশের আক্রোশের শিকার হয়েছেন সংবাদকর্মীরাও। এটিএন নিউজের ক্যামেরাপারসন আব্দুল আলিম ও প্রতিবেদক এহসান দিদার পুলিশি নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। অভিযোগ ওঠেছে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পরেও ১০/২০ জন পুলিশ সদস্য তাঁদেরকে নির্যাতন করেছেন। শাহবাগ থানায় নিয়ে গিয়ে আব্দুল আলিমকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে সে ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এসেছে। ওই ঘটনায় শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক এরশাদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

পুলিশ কর্তৃক সাংবাদিক নির্যাতনের এ নজির বাংলাদেশের জন্যে নতুন কিছু নয়। সময়ে-সময়ে তারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে, মাঝেমধ্যে কেউ কেউ সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছে, এবং কিছুদিনের মধ্যে আবার কর্মস্থলে ফিরেও এসেছে। এতে করে পুলিশ বাহিনীর ওপর এমন সাময়িক শাস্তি কোনো প্রভাব ফেলে বলে মনে হয় না। যে কারণে বারবার এমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে আসছে। ফলে এধরণের সাময়িক শাস্তি স্রেফ লোকদেখানো অথবা আইওয়াশ বলে মনে করাটাই স্বাভাবিক। তাৎক্ষণিক এসব শাস্তির মাধ্যমে পুলিশ প্রশাসন পুরো ঘটনাটিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার কৌশলি ভূমিকায় নামে বলেই মনে করা সঙ্গত। আদতে তাই হয়। এধরণের শাস্তিদানের ফলে পুরো বিষয়টি ফের পুলিশের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, এবং এমন অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ত দূরের কথা ন্যুনতম শাস্তি পর্যন্ত হয় না।

এক্ষেত্রে কী করণীয় থাকতে পারে- এনিয়ে বিস্তর আলোচনা, গবেষণা ও সমাধানের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।

২৬ জানুয়ারির হরতালে পুলিশ কর্তৃক সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনায় প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল মৌলভীবাজারের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জানিয়েছিলেন, পুলিশ সাংবাদিকদের নির্যাতন করে নি, মাঝেমধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো স্পর্শকাতর ও দায়িত্বশীল একটা জায়গায় বসে এধরনের মন্তব্য কোনোমতেই দায়িত্বশীল বলে মনে হয় না। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যের দুই দিন পর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে তার পূর্বের মন্তব্যের জন্যে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। ওই অনুষ্ঠানে মন্ত্রী জানিয়েছেন তিনি আদতে প্রকৃত কী ঘটেছে সেটা জানতেন না। মন্ত্রী পরে বলছেন জানতেন না কী ঘটেছে, অথচ তার আগেই পুরো ব্যাপারে পুলিশ কৃত অপকর্মের সাফাই ঠিকই গেয়েছিলেন। এতে করে অপকর্মকারীরা যে উৎসাহিত হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রাথমিক পর্যায়ে ভুল মন্তব্য করলেও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) একেএম শহীদুল ইসলাম তার প্রাথমিক মন্তব্যেই দোষি পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন। এটা ইতিবাচক।

রামপালের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে সরকার ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি দিয়ে বলছে তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ কমাবে। তাছাড়া তাদের দাবি সুন্দরবন থেকে প্রকল্পের এলাকার যথেষ্ট দূরত্ব রয়েছে এবং এতে সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কা নেই। এটা সরকারের বক্তব্য, এবং এসব বক্তব্য যে পরস্পরবিরোধি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, আবার উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে দূষণ কমাবে- তাহলে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলে দাবি সেখানে আবার কম দূষণের জন্যে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের আশ্বাস কেন? এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামপালবিরোধী আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেছেন, রামপাল নিয়ে যারা আন্দোলন করছেন, তাদের অনুরোধ করব যে তারা যেন সুন্দরবনে যান, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সাথে দেখা করে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না। এটা কেমন বক্তব্য? বাঘ কী কথা বলতে জানে, অথবা বাঘের ভাষা মানুষের বুঝার ক্ষমতা আছে? কিংবা মানুষের ভাষা কীভাবে বুঝবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার? আদতে এসব বক্তব্যে কোন যুক্তি নেই, আছে কেবল লোকহাসানোর উপকরণ।

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সরকারের অবস্থান, এবং সেখান থেকে সৃষ্ট পুলিশের নিপীড়নের ঘটনায় দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোন শাস্তি হবে কীনা জানা নাই, তবে মনে হয় কেবল সাময়িক বরখাস্ত আর এক-দুইজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তি ভবিষ্যতের জন্যে সুফল বয়ে নিয়ে আসবে না। কারণ পুলিশের মত সুশৃঙ্খল একটা বাহিনী যেখানে চেইন অব কম্যান্ড মেনে চলে সেক্ষেত্রে কেবল নিম্নপদস্থদের সাময়িক শাস্তি দিয়েই আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা উচিত নয়। এর দায় দোষি সদস্যের রিপোর্টিং অফিসারকেও নেওয়া উচিত, এবং একই সঙ্গে যে প্রশাসনিক এলাকায় দায়িত্বরত ছিলেন অপরাধী পুলিশ সদস্য সে এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও এর দায় নেবেন না কেন? কারণ সুশৃঙ্খল একটা বাহিনী হিসেবে যেকোনো ভালো কাজের পুরষ্কার যখন উচ্চপদস্থরাও উপভোগ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে বাজে কাজের তিরস্কারও তাদের গ্রহণ করা উচিত।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে কী না হবে সেটা শেষ বিচারে সরকারের সিদ্ধান্ত ও গৃহিত পদক্ষেপের উপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু এক্ষেত্রে পুলিশ কোনো পক্ষই নয়। তাদের কাজ জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এখানে অতি-উৎসাহী ভূমিকা পালনের কিছু নেই। পুলিশ যখন তার কাজের বাইরে অতিরিক্ত কিছু করতে যায় তখনই বিপত্তি; ২৬ জানুয়ারির হরতালে তেমনই ঘটেছে। আর এতে পুরো পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তিই ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এটা পুলিশ বাহিনীর জন্যে বিশাল এক ক্ষতি, এবং এ ক্ষতির বিষয়টি তাদের অনুধাবন করা উচিত। প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষতির বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না বুঝলেও পরে বুঝেছেন, আইজিপি বুঝতে পেরেছেন; এখন এর বিহিত ব্যবস্থা গ্রহণের দরকার খুব। তাই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কেবল নিম্নপদস্থদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে চেইন ধরে উপরের দিকেও ওঠা উচিত। এটা যদি একবার সম্ভব হয় তাহলে অন্যেরাও সতর্ক হবে, এবং এতে করে আস্তে আস্তে পুলিশের মধ্যকার অপরাধ প্রবণতা কমে আসতে বাধ্য।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)