লালনের (১৭৭৪-১৮৯০) টানে সারাবছরই কুষ্টিয়ায় দেশ-বিদেশের বাউল-ভক্ত-অনুরাগী-অনুসন্ধিৎসুর আনাগোনা চলে। তবে দোলপূর্ণিমা ও পহেলা কার্তিক ফকির লালন সাঁইয়ের তিরোধান দিবস উপলক্ষে যে দুটো বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয় তাতে যোগ দেয় লাখ লাখ মানুষ। পুরো শহরটাই কয়েকদিন উৎসব-আমোদে মেতে ওঠে। অবশ্য মূলমঞ্চ বা লালনের সমাধিক্ষেত্র ছেঁউড়িয়া কুষ্টিয়া শহরের প্রান্তবর্তী হলেও সদর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত নয়। গ্রামটি কুমারখালী উপজেলার অংশভূত। অর্থাৎ একরকম পশ্চাৎপদ এলাকাই বলা চলে। এখনও অনুষ্ঠান চলাকালেই উৎসবপ্রাঙ্গণ হতে পশ্চিমে একটু এগোলেই কুষ্টিয়া শহরের যে অঞ্চলটা পড়ে সেটি বেশ সুনসান। আর দক্ষিণ ও পূর্বে তো পল্লীগ্রাম। উত্তরে গড়াই বয়ে চলেছে আজো। পশ্চিমে যে জলাধার সেটিই যে একসময় প্রমত্তা-প্রশস্ত না হলেও জলধারা ছিল কালিগঙ্গা নামের কৌলিন্য নিয়ে, তা বোঝা ভার। এসব তথ্যে সহজেই অনুমেয়, শতবর্ষ পূর্বে জায়গাটি বেশ নির্জন-নিভৃতই ছিল।
একশ সাতাশ বছর আগে এক পূর্ণিমায় ‘গভীর নির্জন পথের যাত্রী’ ক’জন মিলেছিলেন কালিগঙ্গার তীরে এই স্থানে। সেকালের গ্রামীণ জনপদে সন্ধ্যার কিছু পরেই রাত নিশুতি হতো। সে রাতেও হয়েছিল। আশ্বিন শেষের সিন্ সিন্ করা বাতাস ছিল হালকা হিমেল। শীতের আগমনী যেন শোনা যায়। স্থানটির আশে-পাশে পানের বরজে মাঝেমধ্যে সজারুর কাঁটার ঝমঝম শব্দ। নদীর জলরাশির ক্ষীণ ধ্বনিসুর। বাঁশ আর নারকেল গাছের আন্দোলিত পত্রপল্লবের কারণে কয়েকটি কুড়ে ঘরের মাঝে ছোট্ট খোলা জায়গায় আলো-আঁধারির দোলায়মান নকশা। তদুপরি জিন্দা দেহে মৃতের সাদা পোশাক পরা সমবেত মানুষগুলোর চলাফেরা, একতারা উঁচিয়ে মাটির সুরের গান, তার তালে তালে নৃত্যের মতো দেহভঙ্গিমা মিলে কী এক অপার্থিব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে দলের মধ্যে শতোর্ধ্ব ব্যাক্তিযিনি মাসখানেক ধরে অসুস্থ, গত কদিনে রোগের প্রকোপ যার আরো বেড়েছে- তাকে কেন্দ্র করে সমাবেশটিতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের এক রহস্যময় বাতাবরণ রচিত হয়েছিল। মানুষটি নাকি তার মৃত্যুদিন ঘোষণা করেছেন এবং সে লগ্ন সমাসন্ন। তবে রোগগ্রস্ত বয়োবৃদ্ধ মানুষটি যখন একের পরে এক স্বরচিত গান ধরে চলেছেন, তখন আসরের অন্যেরা সব ভুলে সেই গভীর বাণীতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল।
পহেলা কার্তিকের গোলাকার চাঁদটি রাত বাড়ার সাথে সাথে উজ্জ্বলতর হচ্ছিল। সঙ্গীতের তালে তালে মানুষগুলোও মাঝেমাঝে উদ্বাহু হচ্ছিল। গানের কোনোটিতে ‘মনের মানুষের সনে’ মিলন হওয়ার আশাবাদ, কোনোটিতে ভানু পাটে বসার পর ঘাটে একাকী পড়ে থাকা মানুষের ‘পারে লয়ে যাওয়ার’ আকুতি, কোনোটিতে ‘আশা পূর্ণ হল না’ বলে মনের বেদনা প্রকাশিত। কোনো গানে সত্য বলা-সুপথে চলার আহ্বান, কোনো গানে ‘জাত গেল জাত গেল বলে’যে ‘আজব কারখানা’ চলেছে সমাজে তার প্রতি শ্লেষ। কোনো গানে যেমন আপনাকে জানার মতো গভীর নিদের্শনা, কোনো কেনো গানে আবার তাঁদের গোপন সাধনার প্রহেলিকাময় কথাবার্তা। ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’, ‘আঠারো মোকাম’, ‘বারামখানা’- এসব ‘শুনিলে প্রাণ চমকে ওঠে’। এমনিভাবেই গানে গানে রাত শেষ প্রহরে পৌঁছে। তাই চাঁদ কিছুটা ফ্যাকাশে। বৃদ্ধজন বললেন, ‘আমি চলিলাম’। এর কিছু পরেই তাঁর শ্বাসরোধ হয়; কাঁচা বাঁশের খাঁচা থেকে ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়’। শেষ হয় একশত ষোল বছরের দমের জীবন।
একশ সাতাশ বছরের আগের এই মৃত্যুমঞ্চকে কি চব্বিশ শত ষোল বছর আগে পৃথিবীর আরেক গোলার্ধে গ্রিসের এথেন্সে সক্রেটিসের (খ্রি.পূ. ৪৭০-খ্রি. পূ.৩৯৯) মৃত্যুবরণের সাথে মেলানো চলে? সক্রেটিস মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন; পালানোর প্রস্তাবও পেয়েছিলেন খোদ শাস্তিদাতা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেই। কিন্তু পলাতক জীবনের চেয়ে মৃত্যুকেই পছন্দ করেন তিনি। পেয়েলাভরা বিষপান করে কী সহজেই না বিদায় জানালেন স্বজন-পরিজনদের! “তোমার পিছে পিছে ঘুরছে সমন, কোনদিন হাতে দেবে দড়ি’ বলে আলংকারিক অর্থে লালনও মৃত্যুদণ্ডের কথাই বলেছিলেন। আমরা আমজনতা মৃত্যুকে দণ্ড হিসেবেই ভয় করি। কিন্তু সক্রেটিস বলেন, মৃত্যু হলো মানুষের সর্বাপেক্ষা বড়ো আশীর্বাদ। আমর লালন “এদেশে তো এ সুখ হলো, আবার কোথা যায় না জানি” বলে অপেক্ষা করেছেন মহামরণের। সেই প্রাচীন সভ্যতার ইউরোপে আর মধ্যযুগের উপান্তে বাংলায় জন্ম নেওয়া এ-দুজনের মৃত্যুকে এরূপ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ গ্রহণ করার মধ্যে মনীষার সমিল লক্ষ্য করা যায়।
তবে মৃত্যুর ম্যানুসক্রিপ্ট (manuscript) মুখ্য নয়; মৃত্যু তো সবারই শেষ নিঃশ্বাসটি ত্যাগ করা মাত্র। মৃত্যু জীবনের সীমানা, সেখানে পৌঁছানোর পরই মানুষের জীবনকে পরিমাপ করা যায়। সক্রেটিস ও লালনের স্বধর্মকে সেই জীবনের পরিমাপেই দেখতে হবে। সক্রেটিস দার্শনিক জিজ্ঞাসা ও যুক্তি দিয়ে জগৎজীবনকে চিনতে চেয়েছেন। লালন লোকায়ত ধর্মের সাধক হলেও দেখি এ কাজটি করেছেন দার্শনিকের মতোই আর দু’জনের ভাবনার সাধারণ মাপকাঠি ছিল মানবতা ও মঙ্গলচিন্তা। সক্রেটিসের ‘নো দাই সেলফ’ বা নিজেকে জানার নির্দেশনাটি অশিক্ষিত লালন সরাসরি শুনেছিলেন বলে মনে হয় না; তবে লালনের গানে ‘আপন ঘরের খবর নে না’, ‘ক্ষ্যাপা তুই না জেনে তোর আপন খবর যাবি কোথা’, ‘একবার আপনারে চিনতে পারলে যাবে অচেনা রে চেনা’ এমনি এতো এতো আত্মতত্ত্বমূলক গান প্রমাণ করে নিজেকে জানা যে জরুরি, এ ছিল তাঁর একান্ত অভিজ্ঞান। আর এই নিজেকে জানার গুরুত্বই, মানুষকে গরিমাদীপ্ত করে। তাই ধর্মীয় অনুষঙ্গ ধরেই মানবতাবাদকে যে দুজনেই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন, তা বলা চলে।
সক্রেটিস নিজে কিছু লিখে যাননি। বলে গেছেন ছাত্রদের। ছাত্ররাই বিশেষ করে প্লেটোর মতো কৃতিছাত্র সংলাপ আকারে লিখে তার বাণীকে সংরক্ষণ করেছেন। এই সংলাপ বিতর্কমূলক সত্যে পৌঁছানো যার লক্ষ্য। লালনও বাহাস করেছেন সে-ও তো সংলাপ। তবে নিজ সাধনপন্থার সুবাদে বাণীকে সংগীতে উন্নীত করেছেন। ভাবোন্মত্ত হয়েও গেয়েছেন। শিষ্যসাবুদেরা সেইসব সংগীতকে গেয়ে তার বাণীকে রক্ষা করেন। আপাত কবিবিদ্বিষ্ট হলেও অন্তরধর্মে কবিস্বভাব ছিলেন প্লেটো, তাই কিছুটা শিল্পিত হয়ে সক্রেটিসের বাণী আমাদের কাছে পরিবেশন করেছেন। লালন নিজেই অনবদ্য শিল্পরূপ দিয়ে গিয়েছিলেন তার বক্তব্যকে। অবশ্য মৌখিক পরম্পরার কারণে সেসবরে কিছুটা বদল ও বিকৃতি ঘটেছে। তবে লালন প্লেটোর মতো ছাত্র না পেলেও খানিক-ভাবশিষ্য হিসেবে এক প্রতিভাধরকে পেয়েছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ। তার কারণে প্রায় তিনশ’ গানতো তখনই একরকম লিখিত রূপ পেয়েই যায়। এরপর রবীন্দ্রপ্রচারে শিক্ষিতসমাজ গবেষক শ্রেণি আকৃষ্ট হওয়ায় লালনের গান সংগ্রহ-সংরক্ষণের ধারা সৃষ্টি হয়।
সক্রেটিস জিজ্ঞাসু হওয়ার দীক্ষা দিয়েছেন, লালনও তাইই করেছেন। তবে সক্রেটিসের শ্রোতৃবর্গ হলো তার ছাত্রবৃন্দ যারা ছিল সমাজের অভিজাত শ্রেণীয়। স্থান নগররাষ্ট্রের প্রধান শহর। লালনের শিষ্যরা সমাজের নিচুতলার মানুষ সমাজ নিপীড়িত, প্রায় শিক্ষা বঞ্চিত। উপনিবেশের পল্লীতে বাস। যার ফলে সক্রেটিসের বাণী তাৎক্ষণিকভাবে প্রচার-প্রসার পেয়েছে দেশ-দেশান্তরে। লালনকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। তবে কার্বনখনির বহু গভীরে যে হীরকখণ্ড থাকে, একদিন ঠিকই তা উদ্ধৃত হয়, দ্যুতি ছড়ায়। লালনের গানও তেমনি আজ নবাবিষ্কৃত হয়ে আভা ছড়িয়ে চলেছে। মানবতা-অহিংসা-সত্যসুন্দরের রঙে বর্ণময় সে আলোকচ্ছটা।
এ তুলনায় কাউকে বেশি মার্ক পাইয়ে দেওয়া আমাদের পরিকল্পনা নয়। সক্রেটিস সারা বিশ্বের সম্পদ। লালনও সেই স্বীকৃতি পেতে চলেছেন। আমরা শুধু সতৃপ্তি-সবিস্ময়ে অনুভব করতে চাইছি স্বদেশ-স্বজাতির একটি ঐতিহ্যের গভীরতা ও বিস্তৃতিকে। আমাদের অশিক্ষিত এক লোককবি আমাদের নিজস্ব আবহাওয়া ও অভিজ্ঞতায় বাস করে জ্ঞান ও জিজ্ঞাসার এতো যে উচ্চমার্গে পৌঁছেছিলেন, সেই প্রপঞ্চের উত্তরাধিকার আমরা এই অনুভূতি আজকের হানাহানিপূর্ণ বিশ্বে ও অবিশ্বাস-সন্দেহের স্বদেশে জরুরি হয়ে পড়েছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)