আল মামুন: বছর কয়েক আগেও ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দটি এই ভূখণ্ডের জন্য এই অর্থে প্রযোজ্য না হলেও হালের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ এটি। ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দটি শুধু বাংলাদেশেই শোনা যাচ্ছে এমনটি নয়— এটি এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। ফলে বাংলাদেশে এটি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্নভাবে আত্মদান করেছেন; কিন্তু গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। তদুপরি বিকশিত হয়নি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও। প্রতিষ্ঠান ছাড়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয় কি না, বিপরীতক্রমে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ছাড়া গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়া সম্ভব কি না এই নিয়ে ভিন্নভিন্ন মত রয়েছে। কিন্ত দুইয়েরই যে দরকার সে বিষয়ে মতানৈক্য নেই। এরকম একটি পটভূমিকায় সাম্প্রতিককালে ‘জঙ্গিবাদের বিপদ’ যুক্ত হয়েছে। জঙ্গিবাদ বলতে আমরা যদি সহিংস উগ্রপন্থাকে বিবেচনা করি তবে তা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনীতির এক অবিভাজ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
এই দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতার সূচনা স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই। এর গত কয়েক দশকে এই ধারা আরও শক্তিশালী হয়েছে। বাংলাদেশে মূলধারার রাজনীতির বাইরে সহিংস উগ্রপন্থার রাজনীতিও নতুন নয়। আমরা যদি বৃটিশ ঔপনিবেশিক সময়ের ইতিহাসে নাও ফিরতে চাই, আমাদের স্বীকার করতেই হবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই এই অঞ্চলে সহিংস উগ্রপন্থার অনুসারী সংগঠন ছিলো। এ সব সংগঠনের কিছু কিছু শ্রেণিশত্রু নিধন ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা থেকে সহিংস চরমপন্থার রাজনীতি গ্রহণ করেছিল। স্বাধীনতার পরেও রাজনীতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘সশস্ত্র বিপ্লবের’ পথকে কোনো কোনো সংগঠন অনুসরণ করেছে এবং এখনও স্বল্পাকারে হলেও কেউ কেউ তা অব্যাহত রেখেছে। অন্যপক্ষে ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন সময়েই রাষ্ট্রশক্তি ও বিচার বহির্ভূত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে যা এই সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছে। কিন্তু এখন জঙ্গিবাদ বলতে আমরা সাধারণত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসের কথাই বুঝি, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলামপন্থী রাজনীতির একটি ধারা যা সহিংসতাকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে তাদের রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়ন করতে চায়। জঙ্গিবাদের এই উত্থানের একটি প্রেক্ষাপট হচ্ছে বৈশ্বিক, কিন্ত তার একটি অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটও আছে।
এছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অন্যতম দুটি বিষয় হলো— গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গত পয়তাল্লিশ বছরে অনেকে ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। শুধু পিছিয়ে আছে বললেই যথেষ্ট হবে না, এই সব বিষয়ে আলোচনাও এক ধরণের বৃত্তচক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সমসাময়িক এইসব বিষয় নিয়ে আমীন আল রশীদ লিখেছেন— ‘জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্র, আইনের শাসন।’
আমীন আল রশীদ দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত। তিনি সাধারণের থেকে বেরিয়ে এসে সমসাময়িক এই বিষয়গুলোকে দেখেছেন ভিন্ন দৃষ্টিকোণে, ভেবেছেন ভিন্নভাবে। সময়ের বহুল আলোচিত এবং চর্চিত বিষয়গুলো তাঁর বইয়ে দলিল হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। আমীন সমসাময়িক বিষয়গুলো সম্পর্কে তাঁর যে মতামত প্রকাশ করেছেন তা যে কোনো সাধারণ পাঠক মাত্রই সহজেই বুঝতে পারবেন। এক কথায় বলা যায় তাঁর এই লেখাগুলো হচ্ছে সময়ের রেখাচিত্র। অর্থাৎ ঘটনা প্রবাহের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই তিনি এগুলো লিখেছেন।
আমীন তাঁর ‘জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্র, আইনের শাসন’ বইয়ের লেখাগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করে উপস্থাপন করেছেন। বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সাথে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক, জঙ্গিবাদে মূলধারার রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা, দেশের সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা, বাংলাদেশে আইএস-এর মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা এবং এর ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৪৫ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চার বিশ্লেষণ করা হয়েছে যেখানে গণতন্ত্র সম্পর্কে বেশ কয়েকটি নিবন্ধ রয়েছে। গণতন্ত্রের অ্যাকাডেমিক ধারণার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায়োগিক চর্চার ফারাক, গণতন্ত্র নিয়ে বিভ্রান্তি ও সংশয়, গণতন্ত্রকে উন্নয়নের বিকল্প ভাবার বিপদ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নিয়মিত বিরতিতে জাতীয় নির্বাচন আর কাউন্সিলের মাধ্যমে দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচনকেই গণতন্ত্রের মানদণ্ড ভাবা যায় কি না— সেসব বিষয় নিয়ে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন। নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ এবং তার সাংবিধানিক ক্ষমতা, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্মদিন নিয়ে বিতর্ক, দুই নেত্রীর টেলিফোন আলাপ, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক, জাতীয় সংসদে লুই কানের নকশা ইস্যুতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর সরানোর উদ্যোগ ইত্যাদি সাম্প্রতিক ইস্যুগুলোর একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ রয়েছে এই বইতে।
তৃতীয় অধ্যায়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি, বাধা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে সংবিধানের সংশোধন, বিভিন্ন ইস্যুতে সংসদ-বিচার বিভাগ মুখোমুখি, সংবিধানের শপথ ভঙ্গকারী মন্ত্রীদের নৈতিকতার মতো ইস্যুগুলো যেমন রয়েছে, তেমনি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সারা দেশে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার রাজনীতি নিয়েও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। খুব সাম্প্রতিক ইস্যু নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করানো এবং কুমিল্লার কলেজছাত্রী তনু হত্যার বিষয়ও বাদ যায়নি। আছে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্বিত ৫৭ ধারা এবং প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে কিছু বিশ্লেষণ ও প্রশ্ন।
আমীনের লেখায় বাংলাদেশের প্রধান দুই দলের আচরণ বিষয়ে আলোচনা আসলে বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্যই তুলে ধরেছে। আইনের শাসন বিষয়ে তাঁর নিবন্ধগুলো সাংবিধানিক বিভিন্ন বিধানের বরখেলাফের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। তা ছাড়া রয়েছে গত কয়েক বছরে ক্ষমতাসীনদের গৃহীত ব্যবস্থাদি কী করে নাগরিকের অধিকারকে সংকুচিত করেছে সেই বিষয়। আমীন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিপদ এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ব্যবহারের ফলে যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে সেই বিষয়গুলো আমাদের মনে করিয়ে দেন।
এই বইয়ের ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন— ‘আমীনের এই বইকে আমি সময়ের রেখাচিত্র বলে মনে করি এই কারণে যে, তিনি স্বল্প পরিসরে বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করেছেন যেগুলো এই সময়ের রাজনীতির ঘটনা প্রবাহ এবং বৈশিষ্ট্যগুলো সহজে বুঝতে সাহায্য করে। সমসাময়িক রাজনীতির চিত্র বোঝা এবং কী ধরনের চিন্তা সমাজ ও রাজনীতিতে উপস্থিত আছে সেটা অনুধাবন করা যায় এই বইয়ের নিবন্ধগুলোতে। তাঁর ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি দুইই এই কাজে তাঁকে সাহায্য করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পূর্বে প্রকাশিত বইগুলোতেও (যেমন ‘সরকারি’ বিরোধী দল, দশম সংসদের প্রথম বছর) আমীন এই স্টাইল ব্যবহার করেছেন। এখানে বলা আবশ্যক যে আমীনের সঙ্গে আমার ভিন্নমত রয়েছে। এই বইয়ে আমীন যে সব বিষয়ের অবতারণা করেছেন তাঁর গুরুত্ব বিষয়ে আমি ভিন্নমত পোষণ করি না, কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে আমার অবস্থানের পার্থক্য এতটাই যে আমাদেরকে দুই মেরুর বাসিন্দা বলাই শ্রেয়। তা স্বত্ত্বেও আমি মনে করি আমীনের বক্তব্য পাঠ এবং তা বোঝার চেষ্টা করাটা গুরুত্বপূর্ণ।’
জঙ্গিবাদ, গণতন্ত্র, আইনের শাসন
আমীন আল রশীদ
প্রকাশক: ঐতিহ্য
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
মূল্য: ৪৩০ টাকা
সৌজন্যে: বইনিউজ