বিশ্ব ক্যাথলিক খ্রীষ্ট মণ্ডলীর প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ৩ দিনের আধ্যাত্মিক সফরে ‘সম্প্রীতি ও শান্তির’ বার্তা নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসছেন ৩০শে নভেম্বর। পোপ ফ্রান্সিসের আগে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে উপকূলে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের পরপরই ২৬ নভেম্বর, ১৯৭০ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে সংক্ষিপ্ত যাত্রা বিরতি করেন পোপ ৬ষ্ঠ পৌল। দেশের সংগ্রাম, দুর্যোগ এবং চরম ক্রান্তিকালে পোপ ৬ষ্ঠ পৌলের সফর ছিলো আমাদের প্রিয় স্বদেশে কোন পোপের প্রথম সফর।
এরপর ১৯৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৯ শে নভেম্বর বর্তমানে সাধু পোপ ২য় জন পলের স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সফর। পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশের সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতি, নৃ-গোষ্ঠীর অন্তরে সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশে আসছেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এই দেশে পোপের আগমন তাই বাংলাদেশের সকল মানুষেরই সাফল্য। বিশ্বের প্রায় দেড়শ’ কোটি ক্যাথলিকদের সকলেই পোপকে যীশু খ্রীষ্টের প্রতিনিধিরূপে মান্য করেন। পোপ স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠায় খ্রীষ্ট ভক্তদের আধ্যাত্মিক পরিচর্যা করেন পিতৃস্নেহে। খ্রীষ্ট মণ্ডলীতে ভক্তগণ যীশুর মেষরূপে অভিহিত।
যীশুখ্রীষ্ট ক্রুশীয় মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের পর পিতরকে তাঁর শিষ্য ও অনুসারী ভক্তদের পরিচালনার দায়িত্ব দেন এবং নিশ্চিত করেন শত বৈরিতা এবং আঘাত সত্ত্বেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত মন্ডলীর বিরুদ্ধে শয়তানের শক্তি প্রবল হবে না। তাঁর প্রতিশ্রুত দ্বিতীয় আগমনের পূর্ব পর্যন্ত এ জগতে সাধু পিতরের উত্তরাধিকাররূপে দুই হাজার বছর ধ’রে অবিচ্ছিন্নভাবে পোপগণ এ জগতে খ্রীষ্টভক্তদের আধ্যাত্মিক পরিচর্যা করেন পিতৃস্নেহে, তাই পোপকে সম্বোধন করা হয় পুণ্যপিতারূপে। জগতের শীর্ষ পর্বতমালা হিমালয়ের দক্ষিণে এবং পূর্বের চিরসবুজ অরণ্য মুকুটে শোভিত মেঘালয়ের পাদদেশের, হাজার নদী প্রবাহিত স্বর্গের মতন সমভূমির এই দেশ বাংলাদেশে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের আগমন আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং নৈতিক গুরুত্ব বহন করে।
পুণ্যপিতার সংবাদ কার্যালয়ের পরিচালক গ্রেগ বার্কে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশপদের আমন্ত্রণ সানন্দে গ্রহণ করে দক্ষিণ এশিয়ার এ দু’টি দেশ সফরে আসছেন। পোপ ফ্রান্সিস ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ সফরে আসার আগে ২৭ থেকে ৩০শে নভেম্বর আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে আসছেন। এমন এক সময়ে পুণ্যপিতার বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সফর যখন এ দুটি দেশের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী দেশটির সামরিক অভিযানে প্রাণ রক্ষার্থে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিদিনই পাহাড়ি ঢলের মতো বাংলাদেশে আসছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ নিজেদের সংকট, সীমিত সামর্থ্য সত্ত্বেও বিপুল এই শরণার্থীদের শুধুমাত্র সদিচ্ছার জোরে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের যোগান দিচ্ছে।
পোপ ফ্রান্সিসের এ দু’টি দেশে সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুটির কার্যকর সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে আশা করা যায়। পোপ ফ্রান্সিসের কূটনৈতিক সফলতা বিশ্বকে আলোড়িত করেছে। প্রথমত মার্কিন-কিউবা সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা, কলম্বিয়ার অর্ধশতাব্দীর ফার্ক এবং সাইনিং পাথ বিদ্রোহের অবসান, যুদ্ধ বিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির অভিবাসীদের আশ্রয়দানে রাষ্ট্রপ্রধান ও বিশ্ব নেতাদের উৎসাহদান, ইসলাম ধর্মসহ অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে আন্তরিক সংলাপের সূচনা, কাথলিক এবং অর্থোডক্স মণ্ডলীর প্রায় এক হাজার বছরের বিচ্ছেদ অবসানে প্রথম ধর্মতাত্বিক উদ্যোগ উল্লেখ যোগ্য। তিনি প্রাণদণ্ড রহিতকরণে বিশ্বের মানবিকতা জাগিয়ে তোলার কঠিন প্রচেষ্টা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে ১৬টি কাথলিক ধর্মপ্রদেশে ২৯জন বিশপ রয়েছেন। পোপ ফ্রান্সিস দেশটিতে ২০১৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম ইয়াঙ্গুনের আর্চবিশপ চার্লস সং বোকে কার্ডিনাল পদে অভিষিক্ত করেছেন। একইভাবে পোপ ফ্রান্সিস মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে ঢাকার আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিওকে ২০১৬ খ্রীষ্টাব্দে কার্ডিনাল পদে অভিষিক্ত করেন, যা সমগ্র বাঙ্গালী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম কার্ডিনাল।
লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের কারণেই এই পদ লাভ সম্ভব হয়েছে। পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিস ২৬ নভেম্বর সোমবার মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশে রোমের ফিউমিসিনো বিমান বন্দর থেকে বিশেষ বিমানে ইয়াঙ্গুনের উদ্দেশে রওনা দেবেন। ২৭ শে নভেম্বর দুপুর ২টায় ইয়াঙ্গুন পৌঁছবেন। ২৮শে নভেম্বর সেখানে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট হেতিন কায়োর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। পরে চিফ স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী নোবেল জয়ী অং সান সু চি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। ২৯ নভেম্বর ইয়াঙ্গুনে সকাল সাড়ে ৯টায় কাইকাসান স্পোর্টস গ্রাউন্ডে খ্রীষ্টযাগ ও বাণী প্রদান করবেন তিনি। বিকেলে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংঘ সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্যদের উদ্দেশে ক্যাবা আয়ে প্যাগোডায় বক্তৃতা করবেন। পরে মিয়ানমারের সেন্ট মেরি’স ক্যাথিড্রালে বিশপদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন। এর পরই দক্ষিণ-পূর্ব প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি।
পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশ সফরের পূর্ণাঙ্গ অনুষ্ঠানসূচি
৩০ নভেম্বর ২০১৭ বিকেল ৩:০০টা ঢাকায় আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ ও বরণ অনুষ্ঠান, বিকেল ৪:০০টা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, বিকেল ৪:৪৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির জনকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও স্মৃতিগ্রন্থে সাক্ষর, বিকেল ৫:৩০টা বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ,সন্ধ্যা ৬:০০টা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সুশীল সমাজ ও কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা এবং পোপ মহোদয়ের বক্তব্য
১লা ডিসেম্বর ২০১৭ সকাল ১০:০০টা রমনার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খ্রীষ্টযাগ/খ্রীষ্টধর্মীয় উপাসনা ও যাজক অভিষেক অনুষ্ঠান, পোপ মহোদয়ের বক্তব্য, বিকেল ৩:২০টা ভ্যাটিকান দূতাবাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ , বিকেল ৪:০০টা রমনা সেন্ট মেরি’স ক্যাথিড্রাল পরিদর্শন, বিকেল ৪:১৫টা রমনার প্রবীণ যাজক ভবনে পোপ মহোদয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের বিশপদের বিশেষ মিটিং, বিকেল ৫:০০টা আর্চবিশপ্স হাউজের মাঠে শান্তির জন্য আন্তঃধর্মীয় ও আন্তঃমা-লিক সমাবেশে পোপ মহোদয়ের বক্তব্য
২ ডিসেম্বর, ২০১৭ খ্রীষ্টাব্দ সকাল ১০:০০টা তেজগাঁওয়ে ব্যক্তিগতভাবে মাদার তেরেসা ভবন পরিদর্শন, সকাল ১০:৪৫ টা যাজকবর্গ, সন্ন্যানব্রতী, উৎসর্গীকৃত নর-নারী, সেমিনারীয়ান ও নবিশদের সমাবেধে পোপ মহোদয়ের বক্তব্য, সকাল ১১.৪৫ তেজগাঁও পবিত্র জপমালার আদি গীর্জা ও কবরস্থান পরিদর্শন, বিকেল ৩:২০টা নটর ডেম কলেজে যুব সমাবেশে পুণ্যপিতা পোপ ফ্রান্সিসের বক্তব্য, বিকেল ৪:৪৫-৫:০৫ টা আনুষ্ঠানিক বিদায়, রোমের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ, রাত ১১:০০টা রোমের চামপিনো বিমান বন্দরে অবতরণ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)