পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ছাত্র-ছাত্রীদের দৌড়াতে হয় দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। যে সময়ে নির্বিঘ্নে পড়াশুনা করার কথা সেই সময়ে ছাত্রছাত্রীদের ছুটতে হয় বাস-ট্রেন-লঞ্চের টিকেটের জন্য। কোথায় থাকবে, কী খাবে সে ভাবনাটাও বড় হয়ে দেখা দেয়। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য তো ভোগান্তির শেষ নেই।
বেশ কয়েক বছর ধরে এক যোগে দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা তথা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। মেডিকেল কলেজগুলোর মতো একই দিনে অভিন্ন প্রশ্ন পত্রে নিজ নিজ বিভাগে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থাকলে পরীক্ষার্থীরা আরামে পরীক্ষা দিতে পারবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও ছাত্র-ছাত্রীরা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার পক্ষে নিজেদের অভিমত ব্যক্ত করলেও দায়িত্ব নিয়ে এই পদ্ধতি প্রণয়নের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাইমুর লিখন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: এক-দেড় মাসের মধ্যে ২০ জেলায় ঘুরে ভার্সিটি পরীক্ষা দেওয়ার মতো কঠিন বিষয় আর নাই ৷ মধ্যবিত্ত দরিদ্র পরীক্ষার্থীরা এইটা ভালো বোঝে। থাকা, খাওয়ার ঝামেলা প্রচুর ৷ তার চেয়ে নিজ নিজ এলাকায় একসাথে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার মতো পরীক্ষা হলে আমার মনে হয় ভালো হবে।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সুবিধা অসুবিধা নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সমন্বিত পরীক্ষার সুবিধা হলো- শিক্ষার্থীদের ছোটাছুটি করতে হবে না। একমনে পরীক্ষা দিতে পারবে। আজ রাজশাহী, কাল সিলেট, এরপর পটুয়াখালী ছুটে বেড়াতে হবে না। এভাবে ছুটে বেড়ানো নারী শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের জন্য বড় একটা অসুবিধা।
‘এছাড়া শিক্ষার্থীরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়ে যায়। পরে দেখা যায় ওয়েটিং লিস্ট থেকে ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো কোনো সাবজেক্ট পেলে চলে যায়। এই শিক্ষার্থী যে সিটে ভর্তি হয়েছিল সিটটা অপচয় হয়। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিলে সিট অপচয় হবে না। বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে।’
তিনি বলেন: ওয়েটিং লিস্ট নিয়েও অনেক সময় অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠে। সমন্বিত পরীক্ষা হলে এই সমস্যাগুলো হবে না।
তবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় কিছু অসুবিধাও হতে পারে বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন: এতে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর চাপ পড়বে বেশি। এছাড়া প্রশ্ন ফাঁসের বিষয় সামনে চলে আসতে পারে। তবে মেডিকেলগুলো যদি পারে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ও পারবে বলে মনে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান বলেন: এটা পুরনো আলোচনা। আমাদের নজর এদিকে আছে। আমরা বিষয়টা নিয়ে ভাবছি। দেখা যাক কী হয়।
সমন্বিত পরীক্ষা ভালো-মন্দ দিক নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ৮৭টা কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা নিতে হয়। মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে আরমানিটোলা পর্যন্ত। এটা অকল্পনীয়।
‘তবে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সুবিধা-অসুবিধা দুই দিকই আছে। এটা ম্যানেজমেন্ট যেভাবে চিন্তা-ভাবনা করে। এজন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের নেতৃত্বে সব ভিসি বসে যদি একটা উপায় বের করেন সেটাই সবচেয়ে ভালো হয়।’
তিনি বলেন: শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হয়, তাতেই প্রশ্নফাঁস হয়ে যায়। সারাদেশে পরীক্ষা নিতে গেলে আরও সমস্যা হতে পারে বলে আমি মনে করি। কারণ, আমাদের দেশে তো সততার অভাব। কে কোনদিক দিয়ে কী করে বসে, কে প্রশ্নফাঁস করে ফেলে তার ঠিক নেই।
সমস্যার চেয়ে সুবিধা বেশি হওয়ায় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ভাবা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার রূপরেখা কেমন হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন: আমি তো ছোট মাস্টার। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করো? বড় মাস্টার যারা আছে, যারা নীতি নির্ধারক তাদের জিজ্ঞেস করো।
রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. কলিমউল্লাহ বলেন: কোনো সিস্টেম যত বেশি ইউজার ফ্রেন্ডলি হয় তত ভালো। ভর্তি পরীক্ষা ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা তাদের সেবা প্রদান করছি। এটা তাদের জন্য যত বেশি সহজ হবে তত ভালো হবে।
এ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের পদ্ধতি কেমন হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন: সবাইকে নিয়ে বসতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিষদ আছে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদাধিকার বলে এই পরিষদের সদস্য। পরিষদের সবাই মিলে বসে আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধানে আসতে হবে।
এ বিষয়ে আপনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এককভাবে এই পদক্ষেপ নিতে পারবো না। সবাইকে মিলে একত্রে কাজটা করতে হবে। মিটিংয়ে এ নিয়ে আলোচনা হবে কি না তাও বলতে পারবো না। এটা বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের বর্তমান সভাপতি ড. মো. হারুন অর রশিদ বলতে পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. হারুন অর-রশিদ বলেন: এর আগে বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতে কোনো একদিন হয়তো হবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু করা জরুরি। রোববার তার ফেসবুক পেজে দেয়া এক পোস্টে তিনি বলেন: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুরোধ করবো তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে একটি ভর্তি ব্যবস্থায় সম্মত হবেন যেন ভর্তি ইচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের সারাদেশ ঘুরে ঘুরে ভর্তি পরিক্ষা দিতে হয়রানি না হতে হয়।